কয়েকদিনের জল্পনা-কল্পনা শেষে অবশেষে মিয়ানমারে ক্ষমতা কেড়ে নিল সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি এবং ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতাদের আটক করে রেখে জরুরি অবস্থা জারি করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। সেই সঙ্গে একজন জেনারেলকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে বেসামরিক সরকার ও প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর মধ্যে কয়েকদিন ধরে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনার পর এ ঘটনা ঘটল।
এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী জানিয়েছে, দেশের ক্ষমতা কমান্ডার-ইন-চিফ মিন অং হ্লেইংয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অর্থাৎ মিয়ানমারের ক্ষমতা এখন সেনাবাহিনীর দখলে। খবর আল জাজিরার।
গত কয়েকদিন ধরেই সুচির বেসামরিক সরকার এবং দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সুচির এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তারপর থেকেই মূলত দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনার শুরু। প্রথম থেকেই সেনাবাহিনী নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ করে আসছে। নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনেই মূলত আজ সোমবার ক্ষমতা দখল করেছে সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে দেশজুড়ে এক বছরের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
এএফপির খবরে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আজ সোমবার দেশটিতে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে একজন জেনারেলকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরিচালিত মায়াওয়াদ্দি টিভিতে জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই ঘোষণায় বলা হয়েছে, মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এমন পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় ছিল।
সুচির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) মুখপাত্র মিও নয়েন্ট জানান, সোমবার ভোরে দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ কয়েকজন নেতাকে আটক করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর লোকজন দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে তাদের আটক করে নিয়ে গেছে বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। সুচিকে আটক করার পর সেনাবাহিনী রাজধানী নেইপিদো এবং প্রধান শহর ইয়াঙ্গুন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
মিয়ানমারের নেত্রী ও স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি ও তার ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে আজ ভোরে আকস্মিকভাবে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। এ ঘটনায় দেশে সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। পরে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চি সরকারকে হটানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে সেনাবাহিনী।
২০২০ সালের নভেম্বর মাসের নির্বাচনে এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। সেনাবাহিনী সমর্থিত প্রভাবশালী বিরোধী দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। কদিন আগে সেনাপ্রধান জেনারেল মিং অং হ্লাং বলেন, প্রয়োজন হলে সংবিধান বাতিল করা হতে পারে। তারপর থেকেই অভ্যুত্থানের গুঞ্জন শুরু হয়।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, ‘নির্বাচনে প্রতারণার’ অভিযোগ নিয়ে যে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা সমাধানে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ‘ব্যবস্থা গ্রহণের’ পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ওই ব্যবস্থা কী অভ্যুত্থান হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে এ সপ্তাহে সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র বলেছিলেন, সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এরপর অভ্যুত্থানের আশঙ্কা প্রকাশ করে এর নিন্দা জানায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। তবে এ আশঙ্কাকে ভুল বলে বিবৃতি দেয় সেনাবাহিনী। গত শনিবারে অফিশিয়াল বিবৃতিতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, সম্প্রতি তাদের প্রধান জেনারেল সংবিধান বিলোপের যে কথা বলেছেন, সংবাদমাধ্যমসহ কিছু সংস্থা তার অপব্যাখ্যা করেছে। এর দু’দিন পরই গ্রেফতার হলেন সুচি, মিন্টসহ দেশটির নির্বাচিত শীর্ষ নেতারা।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানী নেপিডো ও প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় রাস্তায় সেনারা টহল দিচ্ছে। প্রধান প্রধান শহরে টেলিভিশন, মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
কেন এই রাজনৈতিক অস্থিরতা, এই মুহূর্তে কেন হলো, চীনের ভূমিকা কী হবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিধা এবং রোহিঙ্গা সমস্যায় এর প্রভাব কী পড়বে তা নিয়ে সামনে চলে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মিয়ানমারের নেতৃত্বে যে-ই থাকুক তাদের রোহিঙ্গা নীতিতে কোনও পরিবর্তন হবে না। এজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ কোর্ট (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচারিক কোর্টে (আইসিজে) আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে বাংলাদেশের।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক বলেন, ১৯৬২ থেকে শক্ত হাতে মিয়ানমার শাসন করেছে সেনাবাহিনী। ২০১১ সালের পর থেকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওই বাহিনী ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব হারিয়ে ফেলছিল।
উদাহারণ হিসেবে তিনি বলেন, আগে নির্বাচন কমিশন গঠন করতো সেনাবাহিনী। এখন সেটি করছে বেসামরিক সরকার গঠন করছে। সুপ্রিম কোর্টে ৯ জন বিচারকের মধ্যে ৬ জন আগে নিয়োগ পেতো সেনাবাহিনী থেকে, যা এখন কমে গেছে। এ ধরনের আরও অনেক জায়গায় সামরিক বাহিনী তাদের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলছিল।
তিনি বলেন, ‘নভেম্বরের নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছে আর্মি। কিন্তু বেসামরিক নির্বাচন কমিশন সেটিতে কর্ণপাত করেনি। নির্বাচনের ফলাফল আর্মিদের পক্ষে না যাওয়ায় স্বভাবতই তারা খুশি ছিল না। এনএলডি ও আর্মির মধ্যে যে দূরত্ব সেটি আরও বেড়ে গিয়েছিল।’
আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে গত কয়েক বছরে এনএলডি ও সুচির চীনের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ায় বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যা তৈরি হওয়ার পর থেকে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ থেকে শুরু বিভিন্ন জায়গায় চীন ঢাল হিসেবে মিয়ানমারকে রক্ষা করেছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এবং এই অতিরিক্ত মাত্রায় ঝুঁকে পড়াটা আর্মি ভালো চোখে নেয়নি।’
তবে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করেন, বেসামরিক সরকার ও আর্মির মধ্যে প্রায় সব বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও রোহিঙ্গা নীতিতে দুইপক্ষের অবস্থান ছিল এক এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে উভয়ই দোষী।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মাদ শহীদুল হক বলেন, ‘এই নীতির কোনও পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই পালা বদলকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করতে পারে মিয়ানমার।’
মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের কড়া নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতারা। তারা মিয়ানমারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে অপসারণের নিন্দা জানান। রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা সম্প্রদায় মিয়ানমারে গণতন্ত্রকে হত্যার এই ঘৃণ্য চেষ্টার নিন্দা জানাই।আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি তারা যাতে এগিয়ে আসে এবং যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে’।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সুচির অবস্থান আগের মতো নেই। রোহিঙ্গা নির্যাতনে সমর্থন দেওয়ার কারণে নিন্দিত হয়েছে মিয়ানমারের নেত্রী। কিন্তু তারপরেও মিয়ানমারের গুরুত্বের কারণে দেশটির বিরুদ্ধে শক্ত কোনও অবস্থানে যাওয়ার আগে চিন্তা করবে পশ্চিমা বিশ্ব।
এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বের যেকোনও শক্ত অবস্থান মিয়ানমারকে চীনের দিকে ঠেলে দেবে এটি তারা জানে। এজন্য অবরোধ বা এ ধরনের কার্যক্রম সহসা দেখার কোনও সম্ভাবনা নেই বলে মনে হচ্ছে।অন্যদিকে মিয়ানমারের অগনতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে কিভাবে পশ্চিমা বিশ্ব যোগাযোগ ও সম্পর্ক বজায় রাখে সেটি এখন দেখার বিষয়।
তারা মনে করেন, ‘প্রথম যে বিবৃতি দেওয়া হয় সেটি খুব সহজ কারণ সেখানে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে, মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে বা এধরনের মন্তব্য থাকে কিন্তু পরবর্তীতে সম্পর্ক কীভাবে রক্ষা করা হয় সেটি গুরুত্বপূর্ণ।’
এদিকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচিসহ তার দলের অন্য নেতাদের গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। মিয়ানমারের জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে দেশটির সামরিক নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। মিয়ানমারের সবশেষ ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে তার মুখপাত্র স্টেফানি দুজারিক একটি বিবৃতিতে দিয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, নতুন পার্লামেন্ট শুরুর প্রাক্কালে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ত ও অন্য রাজনৈতিক নেতাদের আটক করার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমারে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা দেশটির গণতান্ত্রিক সংস্কারের ওপর মারাত্মক আঘাত।
মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংস্কারের বৃহত্তর স্বার্থে দেশটির সব নেতাকে কাজ করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, অর্থপূর্ণ সংলাপে বসতে হবে। সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে হবে। মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।
এদিকে মিয়ানমারে শীর্ষ নেতাদের আটকের পর বিরাজমান পরিস্থিতি বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল ও রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ