গত বছর ৮ নভেম্বরের ওই নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ করে আসছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। গত মঙ্গলবার দেশটিতে সেনাবাহিনী হুমকি দিয়েছিল, নির্বাচনের ফলাফলের তদন্ত না হলে তারা কঠোর পদক্ষেপে যাবেন। এই হুমকির মধ্যেই মঙ্গলবার সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি। নভেম্বরের নির্বাচনকে ঘিরে বেসামরিক সরকার এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনীর মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনার মধ্যে সামরিক হুমকিতে অভ্যুত্থানের যে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো। তবে আজ শনিবার(৩০ জানু) মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা কোনো অভ্যুত্থানে যাচ্ছেন না। তারা সংবিধানের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এবং আইন মেনে চলবে।
দীর্ঘদিন পর গত বছরের নভেম্বরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় প্রায় ৫০ বছরের সামরিক শাসনের পর্দা সরিয়ে গণতন্ত্রের পথে হাঁটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে মিয়ানমারে। ওই নির্বাচনে অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি জয়লাভ করে। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নির্বাচিত সদস্যদের পার্লামেন্টে বসার কথা রয়েছে। সেনাবাহিনী সমর্থিত প্রভাবশালী বিরোধীদল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলে। দাবি মানা না হলে সেনাবাহিনী ফের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেয় তারা।
বুধবার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং সেনাসদস্যদের জন্য দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “যদি সংবিধান মেনে চলা না হয় তবে সেটা বাতিল করাই উচিত।”
গত সপ্তাহে সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র বলেন, ‘নির্বাচনে প্রতারণার’ অভিযোগ নিয়ে মিয়ানমারে যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান না হলে ‘ব্যবস্থা নেওয়ার’ পরিকল্পনা আছে তাদের।
এটি কী অভ্যুত্থান হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র ‘সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না’ বলে মন্তব্য করলে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।
এই বিরোধ নিয়ে অবশ্য প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি সু চি। এনএলডি’র এক মুখপাত্র জানান, বৃহস্পতিবার দলের সদস্যরা সামরিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তবে তা সফল হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের উদ্বেগ রয়েছে তবে তা বড় ধরনের কিছু না। মুখপাত্র মিয়ো নিয়ুন্ট জানান, সংবিধান সংশোধনে এনএলডির পরিকল্পনায় উত্তেজনার আশঙ্কা তারা আগেই করেছিলেন। এই সংশোধনে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। রাজধানী নেপিদোতে পুলিশ ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক শুনানি হবে।
সংবিধান অনুসারে, সেনাবাহিনীর জন্য দেশটির পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত। এমন পরিস্থিতিতে পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু আগেই নির্বাচন নিয়ে তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে একটি প্রস্তাবনার দাবি জানিয়েছে সেনাবাহিনী। বুধবার সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাং সামরিক কর্মকর্তাদের বলেছেন, যদি মেনে চলা না হয় তাহলে সংবিধান বাতিল হওয়া উচিত। এসময় তিনি অতীতে মিয়ানমারের সংবিধান বাতিলের ঘটনা মনে করিয়ে দেন।
তবে শনিবার সেনাবাহিনীর দেওয়া বিবৃতি অভ্যুত্থান গুঞ্জনের পরিসমাপ্তি টানতে পারে বলে ধারণা অনেকের। অফিশিয়াল বিবৃতিতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, সম্প্রতি তাদের প্রধান জেনারেল সংবিধান বিলোপের যে কথা বলেছেন, সংবাদমাধ্যমসহ কিছু সংস্থা তার অপব্যাখ্যা করেছে।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী স্থানীয়ভাবে ‘টাটমাডো’ নামে পরিচিত।শনিবারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, টাটমাডো ২০০৮ সালের সংবিধানের সুরক্ষা দিয়ে আসছে; বাহিনীটি আইন অনুযায়ীই কাজ করবে। কিছু সংস্থা ও গণমাধ্যম তারা যা চায়, তাই ধরে নিয়েছে এবং লিখছে, তাতমাদাও সংবিধান বিলুপ্ত করবে।
জান্তা আমলে তৈরি মিয়ানমারের সংবিধানে সেনাবাহিনীকে বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া আছে। যেমন: পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসনের সদস্য সরাসরি সেনাবাহিনী থেকে আসবেন। এতদিন পর্যন্ত দেশটির বেসামরিক সরকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেই দেশ পরিচালনা করে আসছিল। নভেম্বরের নির্বাচন নিয়েই প্রথম দুই পক্ষ সরাসরি এতটা বিরোধে জড়িয়েছে। সোমবার পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরুর আগে বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার আলোচনা ভেস্তে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, সামরিকপন্থী বিক্ষোভকারীরা দুটি শহরে জড়ো হয়েছেন।
তবে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেনাবাহিনীর নরম সুর সরল করে দেখার সুযোগ নেই। ১৯৬২ সালের এক অভ্যুত্থানের পর দেশটি টানা ৪৯ বছর সামরিক বাহিনীর হাতে শাসিত হয়েছে। এতো অল্পতেই ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয় তারা। বিশ্লেষকরা এও ধারণা করেন, সুচির সরকার সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করার পাঁয়তারা চালালে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এমন হুমকি আসতে পারে। হয়তো অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটানোর জন্য উভয় পক্ষের আলোচনা চলমান বিধায় সেনাবাহিনী সুর নরম করেছে। তবে সেনাবাহিনী যেকোনো সময় ফুসলে উঠতে পারে বলে মনে করেন তারা। দেশটির অতিত ইতিহাস সেই আশঙ্কাকেই উস্কে দেয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০২
আপনার মতামত জানানঃ