শুরুতে সবার ধারণা ছিল রুটির উৎপত্তি সমাজে কৃষিকাজের আবির্ভাবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এবং তা ঘটেছিল নিওলিথিক যুগে, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায়। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, রুটিজাতীয় খাবার খাওয়া হতো কৃষির আবির্ভাবেরও অন্তত চার হাজার বছর আগে (নাতুফিয়ান যুগে, ১৫০০০ থেকে ১১৫০০ বছর আগে)। অর্থাৎ, এখনো পর্যন্ত রুটির সবচেয়ে পুরানো যে নিদর্শন পাওয়া যায় তা ১৪৫০০ বছর আগের।
আন্তঃশাস্ত্রীয় বিশ্লেষণে দেখা যায় দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার কৃষির কিছু ফাউন্ডার ক্রপ ও মূলজাতীয় খাদ্য থেকে সমতল রুটিজাতীয় খাবার প্রস্তুত হতো। তবে আর্কিওবোটানিক্যাল প্রমাণ থেকে এটাও দেখা যায় নাতুফিয়ান যুগে দানাদার শস্যের ব্যবহার নিয়মিত ছিল না। দানাদার শস্যভিত্তিক খাবার যেমন রুটির ব্যবহার নিয়মিত হতে শুরু করে কৃষি ব্যবস্থা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর।
রুটি দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবারের অন্যতম। আটা বা ময়দায় পানি আর নুন মিশিয়ে পছন্দমতো আকারে সেদ্ধ বা ভেজে তৈরি হয়ে যায় রুটি। এমন জনপ্রিয় খাবারটি উৎপত্তির ইতিহাস কুয়াশাঘেরা। ইউরোপ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন নিওলিথিক সাইটে যেসব নমুন পাওয়া গেছে তাতে বোঝা যায় পুরোদমে কৃষি ব্যবস্থা চালু ও ফসলকে গৃহস্থকরণের সঙ্গেই রুটির উদ্ভব জড়িয়ে আছে।
কিন্তু একটু ভিন্ন বিষয় জানা যাচ্ছে এবার। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যে গম কিংবা যবের আদিপুরুষরা প্রকৃতিতে জন্মাত। আপার-প্যালিওলিথিক যুগের শিকারি-যাযাবর মানুষ তখনই সে বুনো শস্য থেকে আটা তৈরি শিখে গিয়েছিল। শস্য গুঁড়া করা, রুটির মতো খাবার তৈরি করা এপিপ্যালিওলিথিক যুগের শেষদিকে হয়তো শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে শস্যনির্ভর খাবারের নিয়মিত ভোগের বিষয়টি কৃষির আবির্ভাবের আগে সেভাবে পাওয়া যায় না।
শুবায়কা-১ প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট, যার অবস্থান উত্তরপূর্ব জর্ডানে। এটি নাতুফিয়ান যুগের প্রাথমিক ও শেষ পর্যায়ের একটি নিদর্শন স্থান। ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেনের প্রত্নতাত্ত্বিক অ্যালিসন বেটস ১৯৯০-এর দশকে স্থানটি খুঁজে পান। জর্ডানের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যান্টিকুইটির অধীন তিনি কাজ করছিলেন। ২০১২-১৫ সালের মধ্যে তিনি এখানে চারবার খনন কার্যক্রম চালান। এখানে দুটি স্থাপনা পাওয়া গেছে।
শুবায়কা-১ একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে আর্কিওবোটানিক্যাল অনুসন্ধানে মূল গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রথম স্থাপনায় থাকা দুটি চুলার ওপর। একটি চুলা ব্যাসল্ট পাথরে তৈরি গোলাকৃতির। সর্বশেষ ব্যবহারের পর চুলার সব উপাদান অক্ষত অবস্থায় ছিল। এসবই চাপা পড়ে গিয়েছিল ধুলো আর নানা উপাদানে। পরবর্তী সময়ে নতুন বাসিন্দারা এখানে আরেকটি চুলা তৈরি করেন। এ চুলার সর্বশেষ ব্যবহারের উপাদানও কালের ক্ষয় থেকে টিকে গেছে।
চুলার বিভিন্ন উপাদানের সিস্টেম্যাটিক স্যাম্পলিং ও বিশ্লেষণ থেকে রীতিমতো বিস্মিত হওয়ার মতো ফলাফল পাওয়া যায়। ৯৫টি গণের (ট্যাক্সা) ৬৫ হাজার উদ্ভিজ্জ অবশেষ কণা পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ক্লাব-রাশ টিউবারের (Bolboschoenus glaucus) নমুনা। আরো ছিল কপিজাতীয় উদ্ভিদ, এক ধরনের বুনো গম, বার্লি ও জই। এসব উপাদান অনেক খাদ্যের অবশেষের মধ্যে পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এসব খাবারের মধ্যে ২৪টি অবশেষকে রুটি হিসেবে বিবেচনা করেছে।
প্রত্নতত্ত্বে রুটি বা দানাদার শস্য থেকে তৈরি কোনো খাবারের পরিচয় নিশ্চিতকরণ একটি জটিল কাজ। আজকের দিনের রুটি বা কালিনারি টার্ম ব্যবহার করে প্রাচীন দুনিয়ার খাবারকে সরাসরি শনাক্ত করা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে নমুনার টিস্যু পরীক্ষা করে পাতলা রুটি, রুটি বানানোর জন্য আটার তাল ইত্যাদি শনাক্ত করার পদ্ধতি তৈরি হয়েছে।
শুবায়কা-১ সাইটে পাওয়া অন্তত ২৪টি খাদ্য নমুনাকে রুটি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২টি পাওয়া গেছে পুরনো চুলায় এবং দুটি পরবর্তী সময়ের চুলায়। এসব রুটির নমুনার গড় আকার প্রস্থে ৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার, উচ্চতা ২ দশমিক ৫ মিলিমিটার ও দৈর্ঘ্যে ৫ দশমিক ৭ মিলিমিটার। দানাদার ও অদানাদার—দুই ধরনের উদ্ভিদ উপাদান ব্যবহার করেই রুটি তৈরি করা হয়েছে।
নাতুফিয়ান সংস্কৃতিতে শুবায়কা-১ সাইটের বাসিন্দাদের রুটি তৈরির পেছনের কারণ অনুমান করা কঠিন। ধারণা করা যায়, পুষ্টির চাহিদা পূরণেই তারা এটা করেছিল। রুটি তৈরির প্রক্রিয়া উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিকর ও হজমযোগ্য নয় এমন উপাদান কমে যেতে থাকে।
শুবায়কা-১ সাইটের নিদর্শন পরীক্ষা করে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন এখানকার অধিবাসীরা এ স্থান ত্যাগের কিছুদিন আগে রুটি তৈরি করতে শিখেছিল। তাই তারা মনে করেন চলার পথে শুকনা খাবার হিসেবে সংরক্ষণের জন্য তারা রুটি তৈরি করেছিলেন। এটাও সম্ভব যে রুটি হয়তো বিশেষ খাবার হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। রুটি তৈরি তখন কঠিন কাজ ছিল।
তাই হয়তো কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান বা অতিথিদের জন্য রুটি তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে। কারণ সে যুগে দানাদার শস্যের ব্যবহার ছিল বিরল। নাতুফিয়ান যুগে ছোট বীজের উদ্ভিদ, ফল, বাদাম, উদ্ভিদ মূল ছিল মুখ্য খাবার। আর দানাদার শস্যের ব্যবহার ছিল সামান্য। আজ যেমন রুটি প্রতিদিনের খাবার, নাতুফিয়ান যুগে তা ছিল না। কৃষিকাজে মানবসমাজ দক্ষ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রুটি বিশেষ খাবার থেকে নিত্যদিনের খাবার হয়ে উঠতে থাকে।
নিওলিথিক আমলে রুটির ব্যবহার সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু শুবায়কা-১ সাইটের আবিষ্কার দেখিয়েছে যে মধ্যপ্রাচ্যে রুটিজাতীয় খাবার খাওয়া হতো কৃষির আবির্ভাবেরও অন্তত চার হাজার বছর আগে।
আপনার মতামত জানানঃ