ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হওয়া কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, লেখক মুশতাক আহমেদসহ অন্যান্য শিল্পীদের অবিলম্বে মুক্তির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এছাড়া চলচ্চিত্র পরিচালক অনন্য মামুন, অভিনেতা শাহীন মৃধা, বাউল রিতা দেওয়ান, কার্র্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাকের বিরুদ্ধে সব ধরণের অভিযোগ প্রত্যাহার করতেও কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে। একইসাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল কিংবা এর ‘দমনমূলক ধারা’র সংশোধনের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল বৃহস্পতিবার(২১ জানুয়ারি) অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানিয়েছে।
লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংগঠনটি বলছে, বাংলাদেশে সম্প্রতি নির্বিচারে আটক কিংবা অন্যান্য উপায়ে হয়রানির মাধ্যমে শিল্পীদের মতপ্রকাশের অধিকার ব্যাহত হওয়ার মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশে বেআইনিভাবে আটক সব শিল্পীদের মুক্তি, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানুষের শৈল্পিক অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশ নিশ্চিত করা উচিত।
গত বছরের মে মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনাভাইরাস নিয়ে সরকার বিরোধী ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। কার্টুনিস্ট কিশোরকে কাকরাইল ও লেখক মুশতাককে লালমাটিয়ার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। ওই বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে ফেসবুকে পোস্ট করা কিশোর-এর কোভিড-১৯-এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে ব্যঙ্গকারী “লাইফ ইন দ্য টাইম অফ করোনার” কার্টুন পরে মে মাসে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দেশের কোভিড-১৯ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ এবং ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাকে ডিজিটাল সুরক্ষা আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কিশোরের বিরুদ্ধে “আমি কিশোর” নামে ফেসবুকের একটি পেজ থেকে সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন পোস্ট করার অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা একটি যৌথ বিবৃতিতে বলেছিলেন, “রাজনৈতিক বিদ্রূপ ও কার্টুনের মাধ্যমে সরকারী নীতি সমালোচনা, মত প্রকাশের অধিকার এবং সাংস্কৃতিক অধিকারের অধীনে অনুমোদিত এবং এটিকে অপরাধী করা উচিত নয়।”
অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, কিশোর একজন আন্তর্জাতিক পুরষ্কার বিজয়ী কার্টুনিস্ট যিনি সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের নীতির সমালোচনামূলক কার্টুন আঁকার কারণে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
এদিকে গ্রেফতারকৃত অপর ব্যক্তি, মুশতাকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে কয়েকটি আইডি থেকে এবং ‘মাইকেল কুমার ঠাকুর’ নামে একটি পেজ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। মুশতাক আহমেদ কুমির চাষের ডায়েরি নামে বইয়ের লেখক, তিনি “মাইকেল কুমির ঠাকুর” নামে একটি ফেসবুক পাতাও পরিচালনা করেন, যাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য উঠে আসে।
তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় আনা “মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে”, “জাতির জনক” “জাতীয় সংগীত” বা “জাতীয় পতাকা”র বিরুদ্ধে “প্রোপাগান্ডায়” বা “প্রচারণায়” যুক্ত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
২০২০ সালের মে মাসে আটক করার পর তাদেরকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বার বার তাদের জামিন আবেদন নাকচ করেছে আদালত। কোভিড-১৯ এর কারণে তাদের সাথে পরিবারের সদস্যদের দেখা করা বন্ধ করা হয়েছে এবং পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও এখনো করা সম্ভব হয়নি। অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে এর নিন্দা জানানো হয়েছে।
এদিকে ‘নবাব এলএলবি’ নামে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে পুলিশকে হেয় করার অভিযোগে করা মামলায় নির্মাতা অনন্য মামুন ও সেই দৃশ্যে অভিনয় করা অভিনেতা শাহীন মৃধার বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়েছে। আই থিয়েটার নামে অনলাইন অ্যাপে মুক্তি পাওয়া ওই চলচ্চিত্রে পুলিশকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে পুলিশের অভিযোগ। একটি দৃশ্যে ধর্ষণের শিকার এক নারীকে থানায় পুলিশের একজন এসআই ধর্ষণ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এ দৃশ্যটি নিয়েই আপত্তি জানিয়েছে পুলিশ। অভিযোগে বলা হয় যে, এটি মানুষের মধ্যে পুলিশের কাজ নিয়ে ভুল বার্তা দেবে।
স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাতারা এই সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে একে দেশে শৈল্পিক অভিব্যক্তির প্রকাশের স্বাধীনতায় হুমকি বলে উল্লেখ করেন।
এদিকে পালাগানের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চারটি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি খারিজ করে দেয় আদালত। বাকি তিনটির বিচার চলছে। ২০২১ সালের ১৩ই জানুয়ারি ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল একটি মামলায় রিতা দেওয়ানকে জামিন দেয়। রিতা দেওয়ান ছাড়াও তার দুই মেয়ের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। যদিও রিতা দেওয়ান পরে তার এক ইউটিউব চ্যানেলে এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমা চেয়ে ভিডিও আপলোড করেছিলেন।
অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে আটক শিল্পীদের মুক্তি দেয়ার দাবি ছাড়াও ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল কিংবা অ্যামনেস্টির ভাষায় এর ‘দমনমূলক ধারা’র সংশোধনের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশের উচিৎ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের নির্দেশনা সমুন্নত রাখা এবং শৈল্পিক ও সৃজনশীল অভিব্যক্তি যাতে কোন ধরণের ভয় ছাড়াই প্রকাশিত হতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে শারীরিক পরিস্থিতি অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে অনতিবিলম্বে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে মুক্তি দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের তিন বিশেষজ্ঞ। বিবৃতিতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘রাজনৈতিক বিদ্রূপ বা কার্টুনের মাধ্যমে সরকারের নীতির সমালোচনা করা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আওতায় অনুমোদিত। এর জন্যে কাউকে অপরাধী করা উচিত নয়।’
বিবৃতি দেওয়া জাতিসংঘের ওই বিশেষজ্ঞরা হলেন— জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক অধিকার-বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি কারিমা বেনুন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা-বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি আইরিন খান এবং প্রত্যেকের সর্বোচ্চ মানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার-বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি লালেং মোফোকেং।
আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অসঙ্গতি এবং এটি ব্যবহার করে কণ্ঠরোধ করার বিষয়ে বারবার গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদের নিঃশর্ত মুক্তি চেয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন নেটিজেনরা। একইসাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের দমন পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা। তারা জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মূলত সরকারকে নিরাপত্তা দেওয়ার আইন। সরকারের বিরুদ্ধে যায়, এমন যেকোনো কথাকেই তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে বেঁধে রাখেন। পান থেকে একটু চুন খসে পড়লেই চলে গ্রেপ্তার নিপীড়ন। ফলে স্বাভাবিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা চূড়ান্তভাবে ব্যহত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন নেটিজেনরা।
এসডব্লিউ/বিবিসি/কেএইচ/১৩৩৭
আপনার মতামত জানানঃ