রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ বড্ড জটিল জিনিস। সাধারণ নাগরিকদের তা বোধে আসে না। মুক্তিযুদ্ধে যে মানুষটি তার স্বজনদের হারিয়েছে, বোনকে ধর্ষিতা হতে দেখেছে, তাকে রাজনৈতিক মলম দিয়ে সব ভুলে যাওয়ার আশ্বাস দেওয়া একরকম ধৃষ্টতা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠানে যে স্থবিরতা চলছে তাতে এবার নতুন ফতোয়া যোগ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে আদালত যখন (কাদের মোল্লার রায়ে) উল্লেখ করে দেন, তখন সংগঠনটির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের নাগরিক দাবিকে উপেক্ষা করে সম্প্রতি ভিন্ন সুর শোনানো হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলের তরফে।
যুদ্ধাপরাধের মধ্যেই রয়েছে হত্যা, ধর্ষন, উচ্ছেদ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধ। এখানে ভিকটিমরা সশস্ত্র বা সামরিক বাহিনীর সদস্য নয়, বেসামরিক লোকজন যারা যুদ্ধের পক্ষ নয় কিন্তু যুদ্ধকালে হিংস্রতার শিকার। একইভাবে যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যেই রয়েছে ঘাতক ও দালালের সংজ্ঞাও । দালাল তারাই যারা মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সব ধরণের সহায়তা করেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে। ঘাতক তারাই যারা পাকিস্তানীদের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে হত্যা-ধর্ষণ ও লুন্ঠনে মেতেছে। তাই জামায়াত সদস্যদের ঘাতক বলা হয়েছে দালাল বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী বলা হয়নি এটা হচ্ছে মূর্খের দাবি, যা অল্পশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিতদের কনভিন্স করবে। অবশ্য জামায়াত বরাবরই এদেশে শিক্ষায় অনগ্রসর অংশটাকে পুজি করে যা তা বুঝিয়ে ফায়দা লুটেছে। সময় এসেছে সেই মিথ্যাচারের মুখোশ খোলার।
১৯৭৩ সালে যে আইনটি করা হয়েছিলো সেটা পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী ও তাদের এদেশীয় দালাল দুইপক্ষের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছিলো। এর আগে ’৭২ সালের দালাল আইনে যে বিচার চলছিলো তা ছিলো এদেশীয় আইন।এই বিচারকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতেই স্পেশাল ট্রাইবুনাল এক্ট করা হয়। সেই আইনের শুরুতেই স্পষ্ট করে লেখা আছে:
ACT NO XIX OF 1973: An Act to provide for the detention, prosecution and punishment of persons for genocide, crimes against humanity, war crimes and other crimes under international law (Published in the Bangladesh Gazette, Extra., on July 20, 1973).
Whereas It is expedient to provide for the detention, prosecution and punishment of persons for genocide, crimes against humanity, war crimes and other crimes under international law and for matters connected therewith; It is hereby enacted as follows :
1. Short title, extent and commencement.
(1) This Act may be called the International Crimes (Tribunals) Act 1973.
(2) It extends to the whole of Bangladesh.
(3) It shall come into force at once.
2. Definitions. In this Act, unless there is anything repugnant in the subject or context.-
(a) ‘auxiliary forces’ includes forces placed under the control of the Armed Forces for operational, administrative, static and other purposes;
(b) ‘Government’ means the Government of the People’s Republic of Bangladesh;
(c) ‘Republic’ means the People’s Republic of Bangladesh;
(d) ‘service law’ means the Army Act, 1952 (XXXIX of 1952), the Air Force Act, 1953 (VI of 1953) or the Navy Ordinance, 1961 (XXXV of 1961) and includes the rules and regulations under any of them;
(e) ‘territory of Bangladesh’ means the territory of the Republic as defined in article 2 of the Constitution of the People’s Republic Of Bangladesh;
(f) ‘Tribunal’ means a Tribunal set up under this act.
3.Jurisdiction of Tribunal and crimes.
(1) A tribunal shall have the power to try and punish a person irrespective of his nationality who, being a member of any armed, defence or auxiliary force, commits or has committed in the territory of Bangladesh, whether before or after the commencement of this Act, any of the following crimes.
(2) The following acts or any of them are crimes within the jurisdiction of a Tribunal for which there shall be individual responsibility, namely : –
(a) Crimes against Humanity : namely murder, extermination, enslavement, deportation, imprisonment, abduction, confinement, torture, rape or other inhumane acts committed against any civilian population or prosecution on political, racial, ethnic or religious ground whether or not in violation of the domestic law of the country where perpetrated;
(b) Crimes against Peace : namely planning, preparation, initiation or waging of a war of aggression or a war of violation of international treaties, agreements or assurances;
(c) Genocide : meaning and including any of the following acts committed with intent to destroy in whole or in part, a national ethnic, racial, religious or political group, such as :
(i) killing members of the group;
(ii) causing serious bodily or mental harm to members of the group;
(iii) deliberately inflicting on the group conditions of life calculated to bring about its physical destruction in Whole or in part;
(iv) imposing measures intended to prevent births within the group;
(v) forcibly transferring children of the group to another group;
(d) War Crimes : namely, violation of laws of customs of war which include but are limited to murder, ill treatment or deportation to slave labour or for any other purpose of civilian population in the territory of Bangladesh; murder, ill treatment of prisoners of war or persons on the seas, killing of hostages and detenues, plunder of public or private property, wanton destruction of cities, towns or villages or devastation justified by military necessity;
(e) violation of any humanitarian rules applicable in armed conflicts laid down in the Geneva Conventions of 1949;
(f) any other crimes under international law;
(g) attempt abetment or conspiracy to commit any such crimes;
h. complicity in or failure to prevent commission of any such crimes.
4. Liability for Crimes.
(1) When any crime specified in section 3 is committed by several persons, each of such person is liable for that crime in the same manner as if it was done by him alone;
(2) Any Commander or superior officer who orders, permits, acquiesces or participates in the commission of any of the crimes specified in section 3 is connected with any plans or activities involving the commission of such crimes or who fails or omits to discharge his duty to maintain discipline or to control or supervise the actions of the persons under his command or his subordinates or any of them commit any such crimes or who fails to take necessary measures to prevent the commission of such crimes is guilty of such crimes.
আইনে স্পষ্ট করেই উল্লেখ হয়েছে সামরিক বাহিনী এবং তাদের সহযোগী বাহিনীর কথা। এখানে সামরিক বাহিনী মানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। তাদের সহযোগী বাহিনী হচ্ছে রাজাকার (আল-শামস ও আল-বদর), মুজাহিদ, ইপিসিএএফ-এর মতো আধা-সামরিক বাহিনীগুলো। যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের স্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এই আইনে।
জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তানের আমির গোলাম আযম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং শীর্ষ নেতাদের একজন ছিলো। শান্তি কমিটির নেতৃত্বে সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ভার তার এবং তার সংগঠনের ওপর বর্তায়।
জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যাবতীয় তৎপরতাকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছিলো। এসব তৎপরতায় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং বাস্তভিটা থেকে উচ্ছেদের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ অন্তর্ভূক্ত। এসব অপরাধের সমান দায় তাদেরকে নিতেই হবে।
জামায়াতে ইসলামী রাজাকার বাহিনী এবং এর অধীনস্থ বিশেষ ঘাতক সংস্থা আল-বদর গঠন করে। এসব বাহিনী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত। এখানে এটা উল্লেখ করা দরকার যে রাজাকার বাহিনীকে (আল-শামস ও আল-বদর নামে বিভক্ত) ব্যবহার করে জামাতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নির্মূল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ চালাচ্ছে এমন অভিযোগ তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোই সেসময় করেছিলো। জামায়াত এসব সমালোচনাকে ইসলাম ও পাকিস্তান বিরোধী বলে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে নিজেদের কর্মকান্ডকে নায্য বলে দাবি করে।
আল-বদর বাহিনী সুনির্দিষ্টভাবে গঠিত হয়েছিলো জামায়াতের ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তানী ইসলামী জামায়াতে তালাবা বা ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির)সদস্যদের নিয়ে। বিজয়ের আগে বুদ্ধিজীবি হত্যার জন্য এই আল-বদর সদস্যরা অভিযুক্ত। দেখা যাক এই অভিযোগগুলোর স্বপক্ষে কি কি প্রমাণ আছে আমাদের হাতে।
প্রসঙ্গ নৃশংসতায় জামায়াতের দলীয় দায়
জামাতে ইসলামী দলীয়ভাবে কি ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তার প্রমাণ হিসেবে তুলে দেওয়া যেতে পারে একটি ভিডিও ফাইল। ব্রিটেনভিত্তিক চ্যানেল ফোর প্রযোজিত ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ নামের তথ্যচিত্রটি থেকে নেওয়া এই ফুটেজে সিলেটে জামাতের একটি জনসভার কর্মকান্ড এবং তারপর সংঘটিত একটি হত্যাকান্ডের বর্ণনা শোনা যাক প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে। প্রসঙ্গত এ হত্যাকাণ্ড জামাত রাজাকার বা আলবদরের সামরিক লেবাসে ঘটায়নি:
প্রসঙ্গ শান্তি কমিটির নেতৃত্বের দায়:
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল নুরুল আমিনের নেতৃত্বে খাজা খয়েরউদ্দিন এবং গোলাম আযমসহ ১২ জন রাজনৈতিক নেতা পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে এবং সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার আশ্বাস দেয় এবং এ জন্য ‘সর্বদলীয় নাগরিক কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব দেয়। এ বিষয়ে ৫ এপ্রিল প্রকাশিত পূর্বদেশ পত্রিকায় লেখা হয় প্রতিনিধিদল টিক্কা খানকে ‘অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসনকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস এবং জনগণের মন থেকে ভিত্তিহীন ভয় দূর করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়।’ টিক্কা খান তাদের ‘শুধু বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের অখন্ডতা রক্ষায় ফলপ্রসু কাজ করতে নির্দেশ দেন।’ …‘বৈঠক শেষে নেতৃবৃন্দ রেডিওতে ভাষণ দিয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তার প্রতিজ্ঞা করেন’ সে প্রতিজ্ঞা পালন করেছিল গোলাম আযম ।
টিক্কা খান চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের এসব মৌলবাদী দল একই প্লাটফর্মে থেকে সামরিক বাহিনীকে সার্বিক সহযোগিতা করবে। সেটা ধাক্কা খায় শান্তি কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে জামাতের সঙ্গে নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগের তিনটি অংশ (কাউন্সিল, কাইয়ুম ও কনভেনশন) এবং পিডিপির সংঘাতে। বিশেষ করে মৌলভী ফরিদ আহমদ (নেজামে ইসলামী প্রধান) ও নুরুজ্জামান (পাকিস্তান পিপলস পার্টির পূর্ব পাকিস্তান প্রধান) জামায়াতের নেতৃত্বে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ কারণে ৬ এপ্রিল পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক হামিদুল হক চৌধুরীকে নিয়ে টিক্কা খানের সঙ্গে আবারও দেখা করে গোলাম আযম এবং আগের প্রস্তাবনাটি আরেকটু ঘষামাজা করে ‘নাগরিক শান্তি কমিটি’ গঠনের অনুমোদন চায়। মূলত হামিদুল হক চৌধুরীর মধ্যস্থতাতেই জামায়াতের সঙ্গে অন্য দলগুলোর মতপার্থক্য ভুলে রাজনৈতিক সমঝোতা হয় সর্বদলীয় শান্তি কমিটি গঠনে।
৯ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে শপথ নেয় টিক্কা খান। একই দিন খাজা খয়েরউদ্দিনকে আহবায়ক করে ১৪০ জন সদস্য নিয়ে ঢাকায় নাগরিক শান্তিকমিটি আত্মপ্রকাশ করে। এর সংগঠক হিসেবে নাম দেওয়া হয় তিনজনের: অধ্যাপক গোলাম আযম, এ.কিউ.এম শফিকুল ইসলাম এবং মওলানা সৈয়দ মাসুম। তবে পত্রিকায় এই খবর আসে ১১ এপ্রিল। কারণ গঠনের পরপরই এর নেতৃত্বে আবারও কোন্দল দেখা দেয়। ১০ তারিখ মৌলভী ফরিদ আহমদকে সভাপতি করে ৯ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে মূল শান্তি কমিটি থেকে বের হয়ে যায় এবং গঠন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও কল্যান কাউন্সিল’।
১৩ এপ্রিল বায়তুল মোকাররমে জোহারের নামাজের পর একটি মিছিল বের করে শান্তি কমিটি। ‘পাক-চীন জিন্দাবাদ, দুষ্কৃতিকারীরা দূর হও, মুসলিম জাহান এক হও, ভারতকে খতম করো’ ইত্যাদি ফেস্টুন নিয়ে মিছিলটি ঢাকার প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে নিউমার্কেটে শেষ হয়। মিছিল শেষে খাজা খয়েরউদ্দিন বক্তৃতা করে এবং মোনাজাত পরিচালনা করে গোলাম আযম। সমাবেশ শেষে মিছিলকারীরা আজিমপুর কলোনী, শান্তিনগর, শাখারি বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বাঙালীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় এবং অনেককে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখে।
১৪ এপ্রিল নাগরিক শান্তিকমিটির বৈঠক বসে। সেখানে নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি’ রাখা হয়। এর ফলে কমিটি সারা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে বলে সভার প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়। প্রস্তাবে আরো বলা হয় প্রয়োজন অনুসারে কমিটি যে কোনো সময় সদস্য সংখ্যা বাড়াতে পারবে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিট গঠন করে ‘মিশনের কাজ’ সাফল্যমন্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভা যে কোন বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কার্যকর করার জন্য ২১ সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করে যার অন্যতম সদস্য ছিল গোলাম আযম। বর্ষীয়ান খায়েরউদ্দিনকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করলেও জামায়াতে ইসলামীর হাতেই ছিলো এর নেতৃত্ব। যার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় অফিসের ঠিকানা। মগবাজারের ৫ নং এলিফেন্ট লেনের সেই বাড়িটি এখন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৬ এপ্রিল আবার টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করে নিজেদের কার্যক্রম শুরু করার কথা জানায় গোলাম আযমসহ শান্তি কমিটির শীর্ষ নেতৃত্ব।
প্রথমেই এটা জেনে নেওয়া যাক শান্তি কমিটি আসলে কতখানি শক্তিধর ছিলো যে তাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো একই যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে! বিস্তারিত আখ্যানে যাওয়ার আগে সে সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটা আমলে আনা যাক। পূর্ব পাকিস্তান তখন সামরিক আইনের আওতায় চলছিলো এবং সামরিক বিধিবলে সব ধরণের মিটিং-মিছিল এবং বেসামরিক লোকজনের সশস্ত্র চলাফেরা নিষিদ্ধ ছিলো। তবে ইসলামী সমাবেশের ক্ষেত্রে এই আইন ছিলো শিথিল, শান্তি কমিটির ক্ষেত্রে পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হয়েছিলো আইনটিতে। ১৫ জুন সামরিক অধ্যাদেশ নং-২১ জারি করে এলাকাভিত্তিক ও আঞ্চলিক সব স্থানীয় কমিটিকে বিলুপ্ত করার অধিকার আদায় করে টিক্কা খানের অধীনস্থ প্রশাসন। মহল্লার সর্দার প্রথা, ইউনিয়ন কমিশনার কিংবা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা বিলুপ্ত করে সে জায়গাটা এককভাবে দেওয়া হয় শান্তি কমিটিকে। তারাই সরাসরি সামরিক প্রশাসকের বেসামরিক প্রতিনিধির মর্যাদা পায়। একইভাবে অস্ত্রবহন ও স্থানান্তরের বিধিটিও (সামরিক অধ্যাদেশ নং-১২২) শান্তি কমিটির অধীনে অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং তাদের সেগুলো ব্যবহারের অনুমোদন জায়েজ করা হয়।
শান্তি কমিটির দেশজুড়ে স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতায় কতখানি সংশ্লিষ্ট ছিলো তার প্রমাণ হিসেবে আমরা কিছু উপাত্ত তুলে ধরতে পারি: ঢাকা শহরের একজন রাজাকারের পরিচয়পত্র। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত এ পরিচয়পত্রটিতে শান্তি কমিটির উল্লেখ লালদাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে:
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে কষ্ট করে ঘরে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করতে হতো না। বরং শান্তি কমিটিই তাদের জন্য নিয়মিত মেয়ে সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিলো। প্রমাণ হিসেবে একটা চিঠি তুলে দেওয়া যেতে পারে। ‘৭১এর ২৮ মে বরিশালের ঝালকাঠি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছলিমুদ্দিন মিয়া এক চিঠি পাঠিয়েছিলেন কীর্তিপাশা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আজহার মিয়াকে। শান্তি কমিটির আঞ্চলিক প্যাডে লেখা চিঠির কথাগুলো এরকম:
ভাই সাহেব, সালামবাদ সমাচার, আপনার কীর্তিশালা কমিটিতে ইউনিট কমান্ডার হিসেবে আঃ রবের নাম শাহ আলম ছার পাশ করিয়া নিয়েছেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে উত্তর দিকের শয়তান দমন করার জন্য যাইতে হইবে। আপনার এলাকার সব ইন্ডিয়ান দালালদের যত তাড়াতাড়ি পারেন ধরিয়া ক্যাম্পে পাঠাবেন। ওদের হেদায়েত করার পর উত্তর দিকের অপারেশন শুরু করা হইবে। এদিকে ইতিপূর্বে পাঠানো অস্ত্র যেন ইন্ডিয়ার দালালরা খুঁজে নিতে না পারে। বেগ সাহেবের জন্য ভালো মাল পাঠাবেন। রোজ অন্তত একটা অন্যদের জন্য মাল পারেন। খোদা আমাদের সহায় আছেন। আল্লাহ হাফেজ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত এই চিঠিটি বঙ্গবন্ধুকে লিখেছিলেন এক বীরাঙ্গনার বাবা। ১৩ ডিসেম্বর তার বাড়ি ঘেরাও করে তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পাশাপাশি মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় রাজাকাররা।
৩১ জুলাই নাটোরের মিনার সিনেমা হলের ম্যানেজারকে পাঠানো চিঠি। প্রশিক্ষণরত রাজাকারদের মাইন্ড রিফ্রেশের জন্য নাইটশোতে বিনে পয়সায় সিনেমা দেখানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শান্তি কমিটির প্যাডে: ভুরুঙ্গমারির এক মুসলিম লীগ নেতার ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন পত্র। শমসের-ই-মূর্তজা নামে ওই লোক দাবি করে মুক্তিবাহিনী তার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে এবং রংপুরে একটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে সেখানে বাড়ি নির্মাণে সহায়তা চেয়ে ১৮ হাজার ৩২০ টাকা দাবি করে। তার আবেদনটি মঞ্জুর করে শান্তি কমিটি : ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী এবং দুষ্কৃতিকারীদের (দুটোই ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের জামায়াতি সম্বোধন) নিয়মিতই তারা হত্যা করছিলো এবং সেগুলো খবরও হচ্ছিলো। প্রমাণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে ৬ আগস্ট পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের একটি সাফল্যের খবর। কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে ৬ জন ভারতীয় দালালকে (মুক্তিযোদ্ধা) হত্যা এবং দুজনকে বন্দী করার ওই খবরে স্থানীয় শান্তিকমিটির চেয়ারম্যানের (জামায়াত সদস্য) স্ত্রীও অংশ নিয়েছেন বলে লেখা হয়।
প্রসঙ্গ :পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক সমর্থনের দায়
জামাতের রাজনৈতিক সহযোগিতার প্রমাণ হিসেবে আমরা আমলে নিতে পারি ১৯৭১ সালের ১৮ থেকে ২১ আগস্ট লাহোরে অনুষ্ঠিত জামাতের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের সারবেত্তাকে। টানা চারদিনের ওই বৈঠক শেষে জামাতে ইসলামী এর কেন্দ্রীয় নেতাদের সম্মতিক্রমে একটি রাজনৈতিক সংহতিপত্র (পলিটিকাল রেজ্যুলুশন) প্রকাশ করে যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যাবতীয় কর্মকান্ডকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং তাতে সমর্থন জানানো হয়। একই বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের শান্তি শৃংখলা ফেরাতে সেনাবাহিনীকে আরো কঠোর হওয়ার আহবান জানায় তারা। ২০ আগস্ট পাকিস্তানী বার্তাসংস্থা পিপিআইর বরাত দিয়ে ‘ Jamaat upholds action to crush armed rebellion’ শিরোনামে দ্য মর্নিং নিউজ পত্রিকায় লেখা হয়:
The action taken by the Government of Pakistan to crush the armed rebellion in East Pakistan by the outlawed Awami League in connection with Indian warlords and their agent has been fully upheld by the central council of the Jamaat-i-Islami which went into session for the third consecutive day here today under the presidentship of the Deputy chief of the party Maulana Abdur Rahim.
আগেই বলা হয়েছে সামরিক সমর্থনে বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে আলাদাভাবে নিজেদের চেনাতে উদ্যোগী ছিলো জামাত। এর নমুনা মেলে গোলামের একটি বক্তব্যে। ১৭ আগস্ট ওই বৈঠক উপলক্ষ্যে লাহোরে নামার পর পাকিস্তানি সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেয় সে।পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জোটে জামাতের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে গোলাম স্পষ্ট জানায় : Jamaat had nothing to do with the merger of various political parties. The Jamaat, he said, would keep its entity as it could not accept readymade leadership. (morning news 18th august 1971)
দলীয় সংবিধানে এই সমর্থনকে সর্বসম্মতিতে পাশ করানোর আগে থেকেই অবশ্য বক্তৃতা বিবৃতিতে এসব কথা বলে আসছিলো গোলাম আযম। প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে ২০ জুন লাহোরে জামাত কার্যালয়ে তার বক্তৃতার অংশবিশেষ। ২১ জুন বার্তাসংস্থা এপিপির বরাতে ‘সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে রক্ষা করার বিকল্প ছিলো না’ শিরোনামে গোলামের বক্তব্য ছাপে পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রিকা।
আপনার মতামত জানানঃ