বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নাটকীয়তায় অনেকেই হতবাক হলেও নেপালিদের কাছে ওই গল্পটা খুব পরিচিত। সাবেক রাজাসহ নেপালি রাজনৈতিক নেতারা পদচ্যুত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে আলাদা কেউ নন। এরা সবার গণতন্ত্র ও স্বৈরাচার এবং সুশাসন ও দুঃশাসনের মধ্যকার রেখাকে হালকা করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের ভূমিকা এবং তার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তা আরও বেশি মনযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে।
নেপালের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য কাঠমান্ডু পোস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যে পররাষ্ট্রনীতির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দিল্লি এ যাবৎকাল তাদের সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছিল তা হাসিনার স্বৈরাচারী প্রবণতাকে উস্কে দিয়েছে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের যে গণতান্ত্রিক দাবি ছিল এবং তারা যে আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতি প্রবল ইচ্ছা পোষণ করছিল তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি।
বাংলাদেশের অবস্থান এবং কৌশলগত গুরুত্বের কারণে ভারতের একাধিক উদ্বেগ ও নিরাপত্তার বাধ্যবাধকতা ছিল। যার সুযোগে হাসিনা হয়ে ওঠেন ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র। দিল্লির সঙ্গে তার ঐতিহাসিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে দেশটির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা তাদের পক্ষে সহজ ছিল। হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের সমর্থনের কারণ হচ্ছে দিল্লির কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত হওয়া হাসিনার সরকার।
এ বছর জানুয়ারির নির্বাচনে হাসিনা এবং তার দলের প্রতি ভারতের প্রকাশ্য পক্ষপাতিত্ব স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ধরা পড়ে। ভারতের আধিপত্যের বিরোধী দলগুলোকে নানাভাবে বুঝিয়েও আওয়ামী সরকার তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের বৃহত্তর নাগরিক সমাজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্বাচন বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে ভারত।
যার ফল খুব একটা ভালো হয়নি। নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। এছাড়া নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম এবং কারচুপির খবর পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ভারত ওই নির্বাচনের ফলাফলের বৈধতা দিয়ে হাসিনার পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। এভাবে হাসিনার অন্যায় এবং জোরপূর্বক ক্ষমতায় পিষ্ঠ হওয়াকে সমর্থন করার কারণে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধীতা প্রবল আকার ধারণ করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র নীতি গত এক দশক ধরে বাস্তববাদ এবং নমনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। তবে এক্ষেত্রে তারা ভারতের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তার বই, দ্য ইন্ডিয়া ওয়েতে ‘কৃষ্ণের পছন্দ’ ধারণাটিকে সমান্তরাল বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। এর অর্থ হল সামষ্টিক ধার্মিকতার পরিবর্তে ধর্মকে স্বার্থসিদ্ধ হিসেবে ব্যবহার করা। এই ধরণের পররাষ্ট্রনীতি দক্ষিণএশিয়ায় ভারত বিরোধীতাকে ক্রমান্বয়ে উস্কে দিচ্ছে।
জয়শঙ্করের দর্শন অনুসারে ভারতের জনপ্রিয় হওয়ার প্রয়োজন নেই, তারা কেবল তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত করেত চায়। তবে এসব চিন্তাধারার বিপক্ষে দক্ষিণ এশিয়াতে ভারত বিরোধীতা প্রকট হচ্ছে।
এক্ষেত্রে যদি ভারত দক্ষিণএশিয়া এবং তার বাইরে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নেতৃত্বের দাবি করতে চায়। বৈশ্বিকভাবে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করতে চায় বা এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চায় তাহলে দিল্লিকে অবশ্যই তাদের পররাষ্ট্রনীতির স্তম্ভ হিসেবে গণতন্ত্রকে গ্রহণ করতে হবে। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রতিবেশী দেশগুলোর বৃহত্তর স্বার্থ বিশেষ করে গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে
আপনার মতামত জানানঃ