“তিনি প্রতিদিন বিষ খেতেন।” প্রথম সুলতান মাহমুদ শাহ বেগ সম্পর্কে এ কথা বলেন একজন ইতালীয় পর্যটক। এই সুলতান ৫৩ বছর ধরে পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্য শাসন করেছিলেন।
মুজাফফরি রাজবংশের অষ্টম সুলতান ১৪৫৮ থেকে ১৫১১ সাল পর্যন্ত গুজরাট শাসন করেন। এই সাম্রাজ্য ১৫৭২ সালে মুঘলদের গুজরাট বিজয়ের আগে প্রায় ২০০ বছর স্থায়ী ছিল। এ সাম্রাজ্য ১৪০৭ সালে তার পিতামহ সুলতান জাফর খান মুজাফফর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
লেখক সাদুপ্তা মিশ্রের মতে, গুজরাটের প্রথম সুলতান মাহমুদ শাহ’র শাসনামলে তার সাম্রাজ্যের অবস্থান শীর্ষে পৌঁছেছিল। সে সময় এই সাম্রাজ্য পূর্বে মালওয়া ও পশ্চিমে কাচ উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
প্রথম সুলতান মাহমুদ শাহ-এর আসল নাম ছিল ফতেহ খান যার পিতা দ্বিতীয় মুহাম্মদ শাহ ছিলেন গুজরাটের শাসক। তার মাতা বিবি মুগালি ছিলেন সিন্ধুর সামা সাম্রাজ্যের শাসক জাম জুনার কন্যা।
“আমি জানি না এটা ফতেহ খানের বাবার নাকি মায়ের সিদ্ধান্ত ছিল, সুলতান মাহমুদের শরীরে বিষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য শৈশব থেকেই তাকে বিষ পান করানো হয়েছিল।”
এ কারণে ইতালীয় পরিব্রাজক ও দুঃসাহসিক অভিযাত্রী লুডোভিকো ডি ভার্থিমা লিখেছেন, “আমার সঙ্গী জিজ্ঞেস করলো কীভাবে এই সুলতানদের বিষ দেয়া হতো? কিছু বণিক উত্তরে জানায় যে তাদের বাবা তাদেরকে ছোটবেলা থেকেই বিষ খাইয়েছিলেন।”
পর্তুগিজ লেখক দুয়ার্তে বারবোসার মতে, “তারা বিষের ছোট ছোট ডোজ গ্রহণ করতেন যাতে কোনও শত্রু তাদের বিষ দেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের ক্ষতি না হয়।”
ইতিহাসবিদ মনু পিল্লাই বলেছেন, এটা সত্যি যে মাহমুদের শৈশবে সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল।
জেমস ক্যাম্পবেল ও এস কে দেশাইয়ের মতে, দ্বিতীয় মুহম্মদ শাহ অকালে মৃত্যুবরণের পর, তার পুত্র দ্বিতীয় কুতুবউদ্দিন আহমদ শাহ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ফতেহ খানের সৎ ভাই।
ফতেহ খানের বিরুদ্ধে কুতুবউদ্দিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভয়ে বিবি মুগালি তার ছেলেকে নিয়ে বোন বিবি মুরকির কাছে আশ্রয় নেন এবং তার বোনের মৃত্যুর পর তার স্বামী শাহ আলমকে বিয়ে করেন।
কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর সাথে সাথে তার সাত বছরের শাসনের অবসান ঘটে এবং তার চাচা দাউদ খান দায়িত্ব নেন।
কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সর্দাররা তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে এবং ১৩ বছর বয়সী ফতেহ খানের কাছে শাসনভার হস্তান্তর করে।
তখন ১৪৫৮ সালে তিনি আবুল ফতেহ নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ প্রথম নামে সুলতান হন। তিনি নিজেকে সুলতান আল-বাহার উপাধিও দিয়েছিলেন।
পিল্লাই লিখেছেন যে, মাহমুদ তার সৎ ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে (রূপ মঞ্জারি বা রূপ মাতি, যার নামে আহমেদাবাদে একটি মসজিদ রয়েছে) বিয়ে করে তার রাজত্ব শুরু করেছিলেন।
তবে রূপ মঞ্জারি তার বিরুদ্ধে সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্র করছেন এমন ঘটনা বেরিয়ে এলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
বার্ড হিস্ট্রি অফ গুজরাট ও মারাত-ই-আহমাদি বই অনুসারে, তাদেরকে বেগ বা বেগরা বলার পিছনে দুটি কারণ রয়েছে।
একটি হচ্ছে তাদের গোঁফ ছিল ষাঁড়ের শিংয়ের মতো এবং এই রকমের ষাঁড়কে বলা হতো বাগরু।
দ্বিতীয়ত, তিনি ১৪৭২ সালে গিরনারের জুনাগড় এবং দশ বছর পর চাম্পানের পাভাগড় – দুটি দুর্গ জয় করেন। গুজরাটি ভাষায়, ‘বে’ শব্দটি দুই অংক বোঝাতে এবং ‘গড়’ শব্দটি বলতে দুর্গ বোঝানো হয়।
এভাবে, দুটি দুর্গ দখলের কারণে তিনি ‘বে গাড়হা’ নামে পরিচিত হন যা বিবর্তন হতে হতে ‘বেগরা’ শব্দে পরিণত হয়।
ইতিহাসবিদরা বলেন, সাহসিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন, ন্যায়বিচার ও বিচক্ষণতার কারণে সুলতান মাহমুদ গুজরাটের রাজাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হন।
ক্যাম্পবেলের মতে, জমির মালিকানার ধারাবাহিকতা ছিল মুরাত-ই-সিকান্দারির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মালিকের পর পুত্র বা তার অনুপস্থিতিতে সম্পত্তির অর্ধেক পাবে কন্যা। জমিদারদের উচ্ছেদ না করার দৃঢ় নীতির ফলে রাজস্ব দুই, তিন এবং কিছু ক্ষেত্রে দশগুণ বেড়ে যায়।
তার আমলে ভ্রমণ ও ব্যবসা নিরাপদ ছিল। সৈন্যদের জন্য সুদে ঋণ নেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। দরিদ্র সৈন্যদের তাদের প্রয়োজন অনুসারে অর্থ দেওয়া হতো যা তাদের বেতন থেকে নির্দিষ্ট কিস্তিতে সংগ্রহ করা হতো। সুলতান মাহমুদ ফল গাছ আবাদে অনেক মনোযোগ দিয়েছিলেন।
ক্যাম্পবেল লিখেছেন যে, সুলতান মাহমুদের শাসনামলে, কিছু বণিক ইরাক ও খোরাসান থেকে ঘোড়া ও অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছিল, যখন তারা সিরোহি অঞ্চলে পৌঁছায়, তারা ডাকাতের কবলে পড়ে।
রাজা তাদের কাছ থেকে তাদের ঘোড়া ও মালপত্রের দাম লিখিতভাবে নেন, এবং রাজ কোষাগার থেকে অর্থ পরিশোধ করেন। পরে সিরোহির রাজার কাছ থেকে সেই অর্থ আদায় করেন তিনি।
মারাত-ই-সিকান্দারি বইতে আলী মুহম্মদ খানের উদ্ধৃতি অনুসারে, “সুলতান মাহমুদ তার ন্যায়বিচার ও দানশীলতা, সমস্ত শরিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং পালনের কারণে গুজরাটের সমস্ত রাজাদের মধ্যে সেরা ছিলেন।”
পিল্লাইয়ের মতে, তার সময়ের সবচেয়ে সফল রাজাদের মতো, মাহমুদও ছিলেন একজন বিজয়ী ও দক্ষ শাসক, কিন্তু তিনি ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলেন।
উদাহরণস্বরূপ, সিন্ধুতে স্থানীয় সর্দাররা তাদের বশ্যতা স্বীকার করার পরে, তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের ইসলাম এখনও হিন্দু সাংস্কৃতিক অনুশীলনে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল, যার ফলে তারা কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনেন।
সিন্ধুতেই, তার শাসনামলে নির্মিত হয় একটি ছোট কিন্তু নান্দনিক মার্বেল পাথরের মসজিদ। যার অবস্থান শাহনগর পারকার থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে।
ছাদে বসানো লাল পাথরটি করুঞ্জার পাহাড় থেকে আনা হয়, যার পাদদেশে ভোদেসর এলাকার এই মসজিদটি পাঁচ শতাব্দী ধরে জ্বলজ্বল করছে। ত্রিশ ফুট লম্বা ও প্রশস্ত মসজিদটির স্থাপত্যশৈলীতে জৈন প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
আবদুল গনি বাজিরের গবেষণা অনুসারে, তিনি শান্তি পুনরুদ্ধারের জন্য ১৫০৫ সালে তৃতীয়বার ভোদেসর আক্রমণ করেছিলেন। সেখানে ঘামসানের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সুলতান তার সেনাবাহিনীর মুসলিম সৈন্যদের এখানে বসতি স্থাপন করতে বলেন এবং ভোদেসর মসজিদ নির্মাণ করেন।
তার পূর্বসূরি মাহমুদ গজনভী যে স্থানে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করেছিলেন সেই স্থানেই মসজিদটি তৈরি করা হয়। এখানে তার সৈন্যদের কবরও রয়েছে।
মাহমুদ দোয়ারকা শহর ধ্বংস করে দেন কারণ এখানে জলদস্যুরা আশ্রয় নিতেন এবং সেখানে কোনও তীর্থযাত্রী গেলে তাদের লুটপাট করা হতো। তিনি পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন যা ব্যর্থ হয়।
মাহমুদের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা ছিল।
তার শাসনামলে অনেক সাহিত্য আরবি থেকে ফারসিতে অনুবাদ করা হয়। রাজ দরবারের কবি ছিলেন উদীরাজ যিনি সংস্কৃত ভাষায় কবিতা রচনা করতেন।
ইতালীয় পর্যটক তালভি ভার্থিমা সুলতান মাহমুদ সম্পর্কে লিখেছেন, “সুলতান যখন সকালে ঘুম থেকে উঠতেন, তখন পঞ্চাশটি হাতি তাকে শ্রদ্ধা জানাতো। তিনি যখন খেতেন তখন পঞ্চাশ-ষাট ধরনের ঘণ্টা বাজানো হতো।
তার গোঁফ এতই লম্বা ছিল যে তিনি তা মাথায় বেঁধে রাখতেন, যেমন নারীরা চুল বাঁধতেন। তার সাদা দাড়ি ছিল, যা তার নাভি পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
ভার্থিমা বলেন, “তারা প্রতিদিন বিষ খেতেন। তবে, ধরে নেবেন না যে এই বিষ তিনি পেট ভরে খেতেন। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খেতেন।’
ভার্থিমা বলেছেন যে, সুলতানের হেরেমে তিন, চার হাজার নারী ছিল – যাদের সাথে তিনি ঘুমাতেন, সকালে তাদের অনেককে মৃত অবস্থায় পাওয়া যেতো।
তিনি প্রতিদিন নতুন পোশাক পরতেন। ব্যবহৃত পোশাকগুলো পুড়িয়ে ফেলা হতো।
বারবোসা লিখেছেন যে, তিনি এতটাই বিষাক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, যদি কোনও মাছি তার হাত দংশন করতো, সেটি মারা যেতো এবং তিনি যে সমস্ত নারীর সাথে শুয়েছিলেন তাদের অনেকেই একই কারণে মারা গিয়েছিলেন।
“তবে, তিনি নিজের সাথে এমন একটি আংটি রাখতেন যে, তার সাথে ঘুমানো নারী যদি শোয়ার আগে সেই আংটি মুখের মধ্যে রাখতেন, তবে বিষ তার উপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারতো না।”
যেহেতু স্থানীয় ইতিহাসবিদরা নারীদের এভাবে মারা যাওয়ার কথা উল্লেখ করেননি, তাই সম্ভবত ইতিহাসবিদ মনু পিল্লাই এই অতিরঞ্জিত কাহিনী এড়িয়ে যেতে বলেছেন।
ইতিহাসবিদ ক্যাম্পবেল লিখেছেন, খলিল খান মানে যিনি পিতার উত্তরাধিকারী হন, তিনি ছাড়া মাহমুদের আরো তিন পুত্র ছিল – মুহাম্মদ কালা, আপা খান ও আহমদ খান।
কালা তার বাবার জীবদ্দশায় মারা যান। দ্বিতীয় পুত্র আপা খান একজন আমিরের হারেম পরিদর্শন করতে গিয়ে ধরা পড়েন এবং সুলতান তাকে বিষ প্রয়োগের নির্দেশ দেন। তৃতীয় পুত্র আহমদ খান সুলতান মাহমুদের জীবদ্দশায় সিংহাসনে বসার চেষ্টা করেন।
এই ছেলেরা রূপমাতির গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন এবং তারা নিশ্চয়ই কোনও উপায়ে বিষের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে পৃথিবীতে আসেন। এই খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বাদ দিয়ে, সবাই অবশ্য মাহমুদ বেগড়ার অত্যধিক খাওয়ার বিষয়ে একমত বলেই মনে হয়।
বলা হয়, সকালের নাস্তায় এক কাপ মধু, গলিত মাখন আর দেড়শ’ কলা খেতেন তিনি।
ইতিহাসবিদ বারবোসা ও ভার্থিমা বলেছেন যে, সুলতানের দৈনিক রেশন ছিল প্রায় ৩৫ থেকে ৩৭ কেজি, যা গুজরাটে এক মন বা এক মান্নার সমান। সুলতানের পেট না ভরলে শুকনো ভাতের তৈরি প্রায় পাঁচ কেজি মিষ্টি খেতেন।
ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র বলেন, মাহমুদ দিনে প্রচুর খেতেন। তারপরও রাতে তার বিছানার দুই পাশে সমোসা রাখা হতো যাতে ক্ষুধা লাগলে খেতে পারেন।
এত কিছু খাওয়ার পরও সব ইতিহাসবিদদের মতে, মাহমুদ বেগরা পেশীবহুল শরীরের অধিকারী ছিলেন।
আপনার মতামত জানানঃ