দোয়াত থেকে কয়েক ফোঁটা কালি গড়িয়ে পড়লো চামড়ার তৈরি শক্ত কাগজের উপর। সেটি দ্রুত শুকিয়ে গিয়ে কাগজের উপর দীর্ঘস্থায়ী একটি দুর্বোধ্য চিত্রাঙ্কনের সৃষ্টি করলো। সেই কাগজের উপর একজন লেখক নিবিষ্ট চিত্তে পত্র লিখে চলেছেন। দামী আসবাবপত্রে সাজানো হলঘরের মাঝে তামার তৈরী একটি চেয়ারে বসে তামার টেবিলের উপর সেই পত্র লেখা হচ্ছে। কক্ষের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা মূল্যবান আসবাবপত্রের অধিকাংশই তামার তৈরি।
এ যেন রূপকথার সেই তামার মুলুকের মাঝে এসে পড়েছি! কিন্তু এ কোনো রূপকথা নয়। আলাসিয়া নামক এই অদ্ভুত তামার সাম্রাজ্যের রাজার নির্দেশে লেখক পত্র লিখে চলেছেন। পত্রের প্রাপক তৎকালীন মিশর সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি ফারাও আখেনাটন। সম্প্রতি তিনি ফারাওদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চলেছেন। কিন্তু কাজটা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।
আলাসিয়ার রাজা পত্রের মাধ্যমে জানালেন, “মিশরের রাজাধিরাজের নিকট আপনার ভ্রাতৃতুল্য আলাসিয়ার রাজা পয়গাম পেশ করছেন। হে ফারাও! আমার দরবারে আপনার রাজদূতকে প্রেরণ করুন। আপনার চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ তামা আপনার দরবারে প্রেরণ করা হবে।”
এতটুকু লেখার পর রাজার সিলমোহর লাগিয়ে পত্রখানা ডাক পেয়াদার নিকট প্রেরণ করা হলো। কড়া নিরাপত্তার মাঝে সেই পত্র বিশাল সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলো ফারাও মুলুকে। ১৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বে লিখিত এই ঐতিহাসিক পত্রের মাধ্যমে আমাদের নিকট উন্মোচিত হয়েছে এককালের তামার স্বর্গরাজ্য আলাসিয়া সাম্রাজ্যের খণ্ডচিত্র। কূটনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াও বাণিজ্যের মোড়কে আলাসিয়ার মূল্যবান তামা পৌঁছে যেত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তরে।
প্রাচীন যুগ থেকে মানব সভ্যতার সাফল্যের পেছনে বিভিন্ন মূল্যবান ধাতব পদার্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেই ধাতুসমূহের ব্যবহার এবং প্রাপ্তির প্রাচুর্যের উপর ভিত্তি করে ইতিহাসবিদগণ লৌহযুগ, তাম্রযুগ ইত্যাদি নামকরণের মাধ্যমে সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে চিহ্নিত করেছেন। আলাসিয়ার কথা বলতে গেলে আমাদের সামান্য পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। ফিরে দেখতে হবে তাম্রযুগের পৃথিবীর ইতিহাসকে।
সে অনেকদিন আগের কথা। পৃথিবীতে তামার রাজত্ব কেবল শুরু হলো। পৃথিবীর সমৃদ্ধ নগরীর প্রাঙ্গন ছেয়ে গেল তামার তৈরি বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং কলকারখানার প্রাচুর্যে। প্রায় চার হাজার খ্রিস্টপূর্বের শেষের দিকে সাইপ্রাসের ত্রুদুস পর্বতের পাদদেশে বেশ কয়েকটি তামার খনির সন্ধান পাওয়া গেল। সাইপ্রাসের তামাগুলো অন্যান্য দেশের তুলনায় উন্নত মানের ছিল। তাই স্বাভাবিকভাবে তামার পূজারী রাজ্যগুলো সাইপ্রাসের তামার দিকে ঝুঁকে পড়লো। ভূমধ্যসাগরের জলবেষ্টিত সাইপ্রাসের বণিকরা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না। সাইপ্রাস থেকে শত শত জাহাজ তামা বোঝাই করে দূর সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যেতে থাকলো দেশ-দেশান্তরে।
ওদিকে ঘরের কামাররাও বসে নেই। তারা তামা নিয়ে কাজ করা শুরু করলো। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে তারা তামার বিভিন্ন সংস্করণ তৈরি করতে থাকলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় চমক দেখা দিলো খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। তামার সাথে সামান্য টিনের সংমিশ্রণে কামরারা তৈরি করলেন এক নতুন সংকর ধাতু, যার নাম দেয়া হয় ‘ব্রোঞ্জ’।
এই নতুন ধাতু সভ্যতার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে দিল। তামার তুলনায় কয়েকগুণ শক্ত ব্রোঞ্জের সাহায্যে বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ তৈজসপত্র প্রস্তুত হতে থাকলো। যুদ্ধবাজ রাজ্যগুলো সাইপ্রাস থেকে প্রচুর পরিমাণে ব্রোঞ্জ আমদানি করতে থাকলো। এদের মধ্যে তৎকালীন পরাশক্তি মিশরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ধীরে ধীরে নির্জন দ্বীপ সাইপ্রাস অর্থের প্রাচুর্যে বেশ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠলো।
ব্রোঞ্জ আমদানির জন্য সাইপ্রাসের ইনকুমি বন্দর বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠলো। এই ইনকুমি ছিল তৎকালীন আলাসিয়া সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক রাজধানী। তবে আলাসিয়া নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন থেকে যায়। আলাসিয়ার দ্বারা ঠিক সাইপ্রাসের কতটুকু অংশকে বোঝানো হয়েছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ১৪০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১১৫০ খ্রিস্টপূর্বের সময়ে আলাসিয়ার সাথে গ্রিসের ব্রোঞ্জ ব্যবসা শুরু হয়। শুধু গ্রিস কিংবা মিশর নয়, হিট্টাইট, উগ্রাইত, আক্কাদিয় অঞ্চলের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপিতে আলাসিয়ার নাম খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রাচীন মিশরের পতনের পরপরই আলসিয়া নামক সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। ধীরে ধীরে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যেতে থাকে তাম্রনগরী আলাসিয়ার নাম। একসময় মানব জাতি ভুলে যায় আলাসিয়ার কথা। কিন্তু সবাই আলাসিয়ার কথা ভুলে গেলেও শুধু এক জায়গায় সযত্নে বেঁচে থাকে সেই সমৃদ্ধ নগরীর সাতকাহন। ‘আমারনার প্রতিবেদন‘ নামক কয়েকটি কূটনৈতিক পত্রের মাঝে সবিস্তারে উল্লেখ করা ছিল আলাসিয়ার সাথে মিশর সাম্রাজ্যের তামা বাণিজ্যের যাবতীয় তথ্য। ১৮৮৭ সালে সর্বপ্রথম পত্রগুলো আবিষ্কৃত হয়। আমারনার প্রতিবেদনগুলো পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রাচীন কূটনৈতিক পত্রের মর্যাদা লাভ করেছে। চিঠিগুলোর মাধ্যমে আমরা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের সাথে মিশরসহ বিভিন্ন সভ্যতার বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা জানতে পারি।
আমারনার প্রতিবেদনগুলোর মাঝে আলাসিয়ার রাজা কর্তৃক মিশরের ফারাও আখেনাটনের নিকট প্রেরিত দুটো পত্র সংকলিত আছে। পত্রগুলোর মাধ্যমে তিনি মিশরের সাথে সাইপ্রাসের তামা লেনদেনের আবেদন করেন। প্রথম পত্রে আলাসিয়ার রাজা ফারাওকে ৫০০ টালি তামা প্রেরণ করেন। বিনিময়ে মিশরের উন্নতমানের রূপা, তেল এবং ষাড় বোঝাই জাহাজ প্রেরণ করার অনুরোধ করেন। এমনকি মিশরে নিহত এক আলাসিয়ান সৈনিকের ক্রয়কৃত জমির বিনিময়ে রৌপ্যবদলের চুক্তি করেন তিনি। এর দ্বারা সাইপ্রাসের তামার গুণগত মান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা
আমারনার প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাসবিদগণ আলাসিয়া রাজ্যের সম্ভাব্য অবস্থান বের করার কাজ শুরু করেন। তৎকালীন আলাসিয়ার সাথে বর্তমান সাইপ্রাসের আলাসাসহ আরো কয়েকটি স্থানের সূক্ষ্ম মিল পাওয়া যায়। হাজার বছরের গুপ্ত তামার রাজ্যের সন্ধানের শুরু হয় ইতিহাসবিদগণের বহুমুখী অভিযান। আলাসিয়ার সন্ধানে প্রথম মাটি খনন শুরু হয় ১৮৯৬ সালে। বর্তমান তুরস্ক নিয়ন্ত্রিত উত্তর সাইপ্রাসের একটি গ্রামে শুরু হয় এই অভিযান। এই অভিযানের নেতৃত্বে থাকেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ইতিহাসবিদ আলেকজান্ডার মারে। বিভিন্ন স্থানে মাটি খুঁড়ে প্রায় একশত সমাধি, সোনার অলংকার, ব্রোঞ্জের হাতিয়ার, বিভিন্ন মূল্যবান পাথরসহ বহু তৈজসপত্রের সন্ধান লাভ করেন। এতদূর পর্যন্ত ঠিকভাবে অগ্রসর হওয়া মারে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে বসেন কার্বন ডেটিং পরীক্ষায়। মধ্যযুগীয় কিছু সিরামিক সামগ্রী পরীক্ষা করে তিনি সেগুলোকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর নিদর্শন বলে ধারণা করেন। সঠিক ফলাফলের সাথে এই সময়ের ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার বছর!
এর ফলে কপাল পুড়লো মারের। এবার দৃশ্যপটে হাজির হন জন মায়ার্স নামক অক্সফোর্ডের এক অধ্যাপক। তিনি প্রায় তিন মাস ধরে সাইপ্রাসের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনার দেয়াল খুঁড়ে হারিয়ে যাওয়া তাম্রনগরীর অনুসন্ধান করেন। কিন্তু তিনিও মারাত্মক একটি ভুল করে বসেন। আলাসিয়ার নিদর্শন আবিষ্কার করার পরেও তিনি তা চিনতে ভুল করেন। তাই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান তিনি। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে আইনার গেরস্টাড নামক এক সুইডিশ প্রত্নতাত্ত্বিক এই প্রকল্পে কাজ করেন। কিন্তু তিনি আলাসিয়ার সমাধিক্ষেত্র এবং শহরের অবস্থানের হিসেবে ভুল করেন। তাই বারবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে থাকেন গবেষকগণ। আর এক অদৃশ্য অভিশাপের আড়ালে আরো কয়েক বছর পৃথিবীর অন্ধকারে থাকে আলাসিয়া।
ভ্রান্তিবিলাসের ভিড়ে যখন আলাসিয়া অভিযান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পালা ঠিক তখন ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লড শেফার। ১৯২৯ সালে তিনি আইনারের সমসাময়িক আলাসিয়ার সন্ধানে বের হন। তিনি সাইপ্রাসের বিপরীত সৈকতে সিরিয়া সীমান্তে উগারিত নামক প্রাচীন শহর থেকে অভিযান শুরু করেন। অভিযানের মাধ্যমে আবিষ্কৃত বিভিন্ন নিদর্শনের মাধ্যমে তিনি উগারিত এবং সাইপ্রাসের প্রাচীন সংস্কৃতির যোগসূত্রতা করেন।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে পরিচালিত এই অভিযানে তিনি ইনকুমি শহরের সিংহভাগ খনন করে ফেলেন। ইনকুমির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শত শত সমাধিক্ষেত্রের সন্ধান লাভ করেন শেফার। তিনি আর পূর্বসূরীদের ন্যায় ভুল করেননি। শেফারের হিসেবমতে, ইনকুমির নিদর্শনগুলোর সময়কাল ছিল ১৩৪০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বের মধ্যকার সময়। তিনি তামা এবং ব্রোঞ্জের সামগ্রী উৎপাদনের উপযোগী বিভিন্ন কারখানার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। এর ফলে প্রশ্ন উঠে, সাইপ্রাসের শহর ইনকুমি কি প্রাচীন আলাসিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল? শেফারের গবেষণার ফলে জানা যায়, ইনকুমি শুধু আলাসিয়ার অন্তর্ভুক্তই ছিল না, এটি আলাসিয়ার রাজধানীও ছিল।
আলাসিয়ার সন্ধান লাভ করার পরে অলিভিয়ার পেলনের তত্ত্বাবধানে নতুন করে গবেষণা শুরু হয়। যদিও অধিকাংশ গবেষক ইনকুমিকে প্রাচীন আলাসিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তবে অনেকেই এর রাজধানীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক কারণে ১৯৭৪ সালে আলাসিয়া অঞ্চলে অভিযান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে আধুনিক গবেষণাগারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে উদ্ধারকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উপর বিস্তর পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদগণ।
তাম্রনগরীর রহস্যময় নিদর্শনগুলো বর্তমানে বিখ্যাত ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সুসজ্জিত ক্যাবিনেটে সংরক্ষিত রয়েছে। এখন পর্যন্ত আলাসিয়া সম্পর্কে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই জানা যায়নি। সাইপ্রাসে আলাসিয়া রাজ্যের সর্বমোট আয়তন নিয়েও ইতিহাসবিদগণ কিছু সুরাহা করতে পারেননি। তবে অদূর ভবিষ্যতে আমরা আলাসিয়া সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লাভ করতে সক্ষম হবো, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে মিশর, সুমেরীয়, ব্যাবিলনসহ প্রভৃতি সমৃদ্ধশালী সভ্যতা গঠনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে আলাসিয়ার মতো ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো। তাই প্রাচীনযুগের পৃথিবী সম্পর্কে জানতে হলে আলাসিয়ার ন্যায় চালিকাশক্তি রাজ্যগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানার্জনের কোনো বিকল্প নেই।
আপনার মতামত জানানঃ