ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিউ) প্রকল্পের পরিধি কমিয়ে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে ৫৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের আওতায় একটি সফটওয়্যারে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত ১৭টি মডিউল ডেভেলপ করার কথা ছিল।
পরে দুদফা প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় ২৪ কোটি টাকা বাড়ানো হলেও কমানো হয়েছে ৮টি মডিউল। এমন প্রেক্ষাপটে প্রকল্পটি ব্যবসা সহজীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমদানি-রপ্তানিকারকদের মনে প্রশ্ন উঠেছে।
একইসঙ্গে মডিউল কমানো হলেও ব্যয় বাড়ছে কেন তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভেতরে-বাইরে সর্বত্র জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে এবং ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে উন্নতির লক্ষ্যে ২০১৭ সালে এনএসডব্লিউ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৫৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ৫২৯ কোটি টাকা এবং সরকারি খাতে ৫৫ কোটি টাকা অর্থায়ন করার কথা রয়েছে।
এ প্রকল্পের মূল্য উদ্দেশ্য ছিল আমদানি-রপ্তানি আবেদন গ্রহণ, প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিকারকদের সেবা সহজ করা। এর পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে খরচ ও সময় সাশ্রয় এবং পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস করা।
প্রকল্পটি ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় কমিয়ে প্রথম দফায় ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরে দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত এবং খরচ ২৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৬০৯ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় একটি সফটওয়্যারে ১৭টি মডিউল তৈরির কথা ছিল। ২০২১ সালে সরকারি অর্থের অপচয়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে সেখান থেকে ৮টি মডিউল প্রস্তুত না করার সিদ্ধান্ত নেয় এনবিআর!
এগুলো হচ্ছ-আমদানি পণ্যের মেনিফেস্টো জমা মডিউল, ডিক্লারেশন মডিউল, ভ্যালুয়েশন মডিউল, অথরাইজড ইকোনমিক অপারেট মডিউল, কাস্টমস ল্যাবরেটরি টেস্টিং মডিউল, কায়িক পরীক্ষা মডিউল, কেস ম্যানেজমেন্ট মডিউল ও ব্যাংক গ্যারান্টি মডিউল। অর্থাৎ প্রকল্প গ্রহণের সময় আমদানি পণ্যের শুল্কায়নসংক্রান্ত সব কার্যক্রম এনএস ডব্লিউ সফটওয়্যারে করার পরিকল্পনা রেখে প্রকল্পের খরচ ও সময় অনুমোদন দেওয়া হয়।
পরে সেগুলো বাদ দেওয়া হয়। এসব কাজ বর্তমানে কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এ কারণে উল্লিখিত মডিউলগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে না। বর্তমানে প্রকল্পের আওতায় কল সেন্টার মডিউল, স্টেক হোল্ডার রেজিস্ট্রেশন মডিউল, পোর্টাল মডিউল, সিএলপি মডিউল, বিজনেস ইন্টেলিজেন্স/ডাটা অ্যানালাইসিস মডিউল, পেমেন্ট মডিউল প্রস্তুত করা হচ্ছে। অর্থাৎ যেখানে মডিউল কমার কারণে খরচ কমার কথা, সেখানে মডিউল কমিয়ে খরচ বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদফা মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্পের পরিধি অর্ধেকে নামিয়ে আনার পেছনে কাস্টমসের প্রভাবশালী এক সদস্যের অদৃশ্য হাত রয়েছে। কারণ এনএসডব্লিউ প্রকল্পের সব মডিউল বাস্তবায়ন করা হলে অ্যাসাইকুডা সিস্টেম প্রয়োজনীয়তা হারাত। বর্তমানে সিস্টেম আপগ্রেডেশন ও মেইনটেন্যান্স বাবদ প্রতিবছর মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়।
এছাড়াও কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণের নামে বিদেশে প্রমোদভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন। মূলত এনবিআর চেয়ারম্যানের সততা ও সুনামকে পুঁজি করে এনবিআরের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আইটি উইংয়ের কেনাকাটার নামে শতকোটি টাকা খরচ করছেন। এই সিন্ডিকেট সেখান থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন আদায় করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অ্যাসাইকুডা সিস্টেম আপগ্রেডেশন ও নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ যে প্রতিষ্ঠান করছে, তারাই এনএসডব্লিউ প্রকল্পের সফটওয়্যার তৈরির কাজ পাওয়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানের লোকাল এজেন্ট। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে পরোক্ষভাবে অ্যাসাইকুডার ভেন্ডররা সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
অ্যাসাইকুডার ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানটি প্রশ্ন এড়াতে এবং নির্বিঘ্নে কাজের সুবিধার্থে এনবিআর থেকে অবসরে যাওয়া আইটি কর্মকর্তাদের নিজেদের ফার্মে চাকরি দিয়ে থাকে। পরে সেইসব কর্মকর্তা আইটি প্রতিষ্ঠানটির হয়ে এনবিআরে তদবির করে। মোটা দাগে এনবিআরের মতো আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে বাণিজ্য সহজীকরণে সরকারের আরও ৩৯টি মন্ত্রণালয় জড়িত রয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের আইটিসংক্রান্ত কার্যক্রম একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য অটোমেশনের জন্য এনএসডব্লিউ প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আমদানি-রপ্তানিকারকরা উপকৃত হবেন। কেন এই প্রকল্প দীর্ঘায়িত হচ্ছে সেদিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। তাছাড়া প্রকল্পটিতে মডিউল কমানো হলেও ব্যয় বাড়ল কেন সেটিও অনুসন্ধান করা উচিত। কারণ প্রকল্পের শুরুতে তো সব মডিউল নির্মাণ খরচ বিবেচনায় নিয়ে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এনবিআরের সবকিছু শুরুতে অটোমেটেড থাকে, পরে ম্যানুয়াল হয়ে যায়। যেমন অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে এখনো ম্যানুয়ালেও কাজ হয়। এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে, যাতে কাস্টমসের অসাধু লোকজন টাকা-পয়সা নিতে পারে। যেহেতু মেশিন পয়সা খায় না, মানুষ পয়সা খায়, সেহেতু মেশিনের (অটোমেশন) ওপর নির্ভরতা বাড়ালে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এনএসডব্লিউ প্রায়োরিটি প্রকল্প হিসাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে এনবিআরকে আরও উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এনবিআর সেটি তো করেনি উল্টো প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়িয়েছে। মডিউল কমানো হলে ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা দেখছি না। প্রকল্পটি আংশিক বাস্তবায়ন করলে আমদানি-রপ্তানিকারকরা এ থেকে সুফল পাবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে
সফটওয়্যার নির্মাতাদের সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, সফটওয়্যারের মডিউল কমানো হলে দামও কমার কথা। দাম কত কমবে বা কী হারে কমবে সেটি নির্ভর করছে কোন কোন মডিউল বাতিল করা হয়েছে তার ওপর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ডেভেলপাররা এখন বিশ্বমানের সফটওয়্যার বানাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে সময়। বড় সফটওয়্যার বানাতে অর্ডারকারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডেভেলপারদের সময় দেন না। এ কারণে বাংলাদেশে এ ধরনের সফটওয়্যার এখনো বানানো যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশি ডেভেলপারদের সেই সামর্থ্য আছে।
এ বিষয়ে এনএসডব্লিউর প্রকল্প পরিচালক এবিএম শফিকুর রহমান বলেন, দুই কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। প্রথমত, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, দ্বিতীয়ত, হার্ডওয়্যার আমদানির শুল্ক-কর। এনএসডব্লিউর খরচ ডলারে নির্বাহ করার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়াতে হয়েছে। অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুলসংখ্যক কম্পিউটার হার্ডওয়্যার কিনতে হবে। হার্ডওয়্যার আমদানিতে শুল্ক-কর রয়েছে। বিধায় প্রকল্পের আওতায় ক্রয়কৃত হার্ডওয়্যার শুল্ক-কর ব্যয়ে যুক্ত করা হয়েছে। এসব কারণে ব্যয় বেড়েছে।
মডিউল কমানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অ্যাসাইকুডা সিস্টেমের সঙ্গে কিছু মডিউলের ওভার ল্যাপিং হওয়া এনএসডব্লিউ প্রকল্পের সেসব মডিউল বাদ দেওয়া হয়েছে। আমি প্রকল্প পরিচালক হিসাবে যোগদানের আগে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
আপনার মতামত জানানঃ