আইসক্রিমকে ইতালিতে জেলেতো, ফ্রান্সে গ্লেস এবং রাশিয়ায় মোরোজেনো বলা হয়। আইসক্রিমকে ফার্সিতে বলা হয় বাস্তানি। এ ছাড়া ফালুদে বলেও একজাতীয় হিমায়িত মিষ্টি খাদ্য মেলে। এই ফালুদেই আমাদের ফালুদা বলি। টোকিও থেকে তুরিন, ডেনভার থেকে ঢাকা, গোটা দুনিয়ার মানুষই পছন্দ করে আইসক্রিম।
গায়িকা সারাহ ম্যাকলাচলান একবার গেয়েছেন, ইউর লাভ বেটার দ্যান আইসক্রিম। আইসক্রিমের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের সাথে তুলনা চলে এমন খাদ্য বা অন্য কিছু খুবই কম মিলবে।
কী এমন গুণের সমন্বয় ঘটেছে যে যার জোরে দুর্দমনীয় আর্কষণের অধিকারী হয়ে উঠেছে আইসক্রিম? প্রথমত, আইসক্রিম অতি মজাদার। ক্রিম বা ননি, দুধ, মিষ্টি, রুচিকর সুগন্ধ বা ফ্লেভারিং। এসবের মিশ্রণকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় হিমায়িত করলেই হয়ে ওঠে আইসক্রিম। আইসক্রিম মস্তিষ্কের আনন্দ অনুভবকারী অংশগুলোতে তৎপরতার তরঙ্গ বইয়ে দেয়। এ কারণেই আইসক্রিম খাওয়ার পর মানুষ প্রায়ই খুশি এবং তৃপ্ত অনুভব করে। নিল সাইমনের ব্রাইটন বিচ মেমোয়ার্স নাটকে ইউজিন জেরোম নামের এক কিশোরের মুখ থেকে শুনি, সত্যিই এটা অবাক করা বিষয় যে কেউ আপনাকে আইসক্রিম খেতে দিলে দ্রুতই আপনার চিত্তে আনন্দের নহর বয়ে যায়।
আইসক্রিম একই সাথে স্বাদগ্রন্থি এবং চোখ উভয়কেই আনন্দ এনে দেয়। আইসক্রিম স্মৃতিও উসকে দেয়। আইসক্রিম শব্দটির সাথে সাথেই ছোট বেলায় শোনা আ-ই-স-ক্রি-ম বা কু-ল-ফি- মা-লা-ই হাঁকটিও স্মৃতির কানে ভেসে উঠতে পারে।
আইসক্রিমের সাথে জড়িয়ে রয়েছে নানা ঘটনার আকর্ষণীয় ইতিহাস। চীনের সম্রাট থেকে ইংরেজ রাজা, সাবেক ক্রীতদাস থেকে চতুর ব্যবসায়ী, আমেরিকায় ইতালীয় অভিবাসী আইসক্রিম বিক্রেতাও রয়েছে এ ইতিহাসে লবকুশী হয়ে। বিলাসী খাদ্য হিসেবে বিত্তবানদের রসনার বাসনা পূরণ করার মধ্য দিয়ে আইসক্রিমের সূচনা। কালে কালে এর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। আমজনতার নাগালের মধ্যেও এসে যায় এর মূল্যমান।
মনে করা হয়, দুগ্ধজাত উপাদানের হিমায়িত মিষ্টি খাদ্য প্রথম চালু করে চীন। আইসক্রিম বলতে যা বোঝায়, তা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করে ইউরোপ। প্রধানত ইতালি এবং ফ্রান্স, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশও রয়েছে। পরবর্তীতে আমেরিকায় পথ করে নেয় আইসক্রিম। দেশটিতে ব্যাপক জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে যায় অল্প সময়ে। মার্কিনদের প্রিয় মিষ্টি খাবারই হয়ে ওঠে আইসক্রিমÑএমন কথাও শোনাবেন কেউ কেউ। অ্যাপেল পাইয়ের মতোই এটিও ঘরে ঘরে স্থান করে নেয়।
গোটা বিশ্বে আইসক্রিমকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে বিশাল ভূমিকায় ছিলেন মার্কিন আবিষ্কারক এবং ব্যবসায়ী মহল। আইসক্রিম কোনসহ অন্যান্য ধরনকে জনপ্রিয় করে তোলে দেশটি। আইসক্রিমের বাণিজ্যিক কারখানাও মার্কিন ব্যবসায়ীদের অবদান। আজকের দুনিয়ার নামকরা অনেক আইসক্রিম কোম্পানির শিকড় রয়েছে মার্কিন মুলুকে।
ইউরোপের পাকপ্রণালি বা রেসিপি এবং পাকানোর কৌশলগুলোর কাছে ঋণী হয়ে আছে মার্কিন আইসক্রিম। ইতালীয়, ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজ রন্ধন বিশারদ বা বাবুর্চিরা প্রাথমিক পর্যায়ের আইসক্রিম তৈরি করেন। এ আইসক্রিমের ধারাবাহিতকতা আজও রয়েছে। অর্থাৎ আজও আমরা এ রকম আইসক্রিম চাখছি। ইতালীয় অভিবাসীরা তাদের আইসক্রিম বানানোর দক্ষতা ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় নিয়ে আসে। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন এবং বার্লিনের মতো নগরীগুলোতে তারাই আইসিক্রম বিক্রেতার কাজও করে। এভাবেই আইসক্রিমকে রাস্তার খাবার হতে সাহায্য করে তারা।
মার্কিন প্রভাব সত্ত্বেও স্থানীয়ভাবে নির্মিত আইসক্রিমের ঐতিহ্য টিকে আছে। ইতালির জেলেতো, তুরস্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু কিছু এলাকায় অর্কিডের শিকড় দিয়ে তৈরি বিশেষ আইসক্রিম। এদিকে লং আইল্যান্ডে মার্কিন আইসক্রিম তৈরির উপকরণ ব্যবহার করে কুলফি তৈরি করেন এক আইসক্রিম প্রস্তুতকারক।
ইরানের বাস্তানিয়ে মাহাল্লি বা স্থানীয় আইসক্রিম এমনই এক ধারাবাহিকতা। জাফরান দিয়ে বানানো এ আইসক্রিমে দুপাশে বিস্কুটের মতো ওয়েফার থাকে। স্বাভাবিকভাবেই ওয়েফারের মুচমুচে ভাব এতে থাকে না।
প্রথম প্রথম হয়তো অনেকের কাছেই খেতে ভালো লাগবে না। ইরানে অবস্থিত বাংলাদেশের এবং বিশ্বের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার কূটনীতিবিদ ওয়ালিদ ইসলামেরও ভালো লাগেনি। তিনি একবার কথা প্রসঙ্গে বলেন, বাস্তানিয়ে মাহাল্লি মানে যে বিস্কুটের মধ্যে আইসক্রিম পুরে দেবে, তা ভাবতেও পারিনি।
অবশ্য, প্লাস্টিকের পাত্রেও বিক্রি হয় বাস্তানিয়ে মাহাল্লি। পাড়ায় পাড়ায় লাবানিয়াত বা দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রির দোকানে সারা বছরই পাওয়া যায় এ হিমপণ্য। তেহরানে আরেকটা জিনিস প্রত্যক্ষ করেছি, তুষারপাতের সময় আইসক্রিম খাওয়ার মধ্যে একধরনের মজা খোঁজে অনেকে। বিশেষ করে অল্প বয়সীদের মধ্যে এমন ঝোঁক দেখেছি।
স্থানীয় পার্কে তুষার ছোড়াছুড়ি করতে করতে আইসক্রিম খাচ্ছে এ দৃশ্য সেখানকার বরফ দিনরাতের একটি সাধারণ ঘটনা। ইরানে নানা পদের আইসক্রিম তৈরি হয়। এই ভিড়ের মধ্যেও বাস্তানিয়ে মাহাল্লি এখনো টিকে আছে।
বাইরের দুনিয়ার প্রভাব বলয়ে পড়ছে স্থানীয় আইসক্রিম। ইতালির আইসক্রিমের কথাই ধরুন। দিল্লিতে ডেস মাইনেসে জেলতোকে সবুজ চা এবং চেডার পনির দিয়ে তৈরি করে পরিবেশন করা হয়। আদা এবং মসলা মেশানো আজটেক চকোলেটসমৃদ্ধ জেলাতো ফ্লোরেন্স এবং রোমে দেখা যায়। এমনকি কেউ কেউ প্রশ্নও করতে পারেন, জেলাতো কী সত্যিই একচ্ছত্রভাবে ইতালীয় খাদ্যপণ্য?
সাধারণভাবে ইরানিরা ঝাল খায় না। দেশটিতে খাবারে মসলার ব্যবহারও খুবই কম। সে দেশেও ঝাল আইসক্রিম দেখেছি একবার। সে উদ্যোগ অবশ্য জনপ্রিয় হয়নি। পরে আর দেখতে পাইনি ওমন আইসক্রিম বা বাস্তানি।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের খ্যাতিমান প্রতীকের রূপ পেয়েছে আইসক্রিম। পিকাসোর মতো বিশ্বখ্যাত শিল্পীর চিত্রকলা থেকে শুরু করে হলিউডের জনপ্রিয় সিনেমা পর্যন্ত সর্বত্রই দেখা যাবে আইসিক্রিমকে। ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ চলচ্চিত্রে জর্জ বেইলির কথা ভাবুন।
স্থানীয় আইসক্রিমের দোকানে মেরিকে চকোলেট আইসক্রিম পরিবেশন করতে করতে বলছে, চিরকাল তাকে ভালোবাসবে।
ইতিহাসবিদদের বহুকালের তর্কবিতর্ক গড়ে উঠেছে আইসক্রিমকে কেন্দ্র করে প্রচলিত কিংবদন্তি এবং গালগল্প নিয়ে। সত্যিই কি ক্যাথরিন ডি মেডিসি আইসক্রিমকে ফ্রান্সে চালু করেন? আইসক্রিম সানডে কে আবিষ্কার করেন?
আইসক্রিমের সূচনা হয়ছে সর মাখন বা দুগ্ধজাত খাবারের হিমায়িত প্রক্রিয়া থেকে নয়; বরং অদুগ্ধজাত হিমশীতল পানীয় থেকে। হিমায়িত পানীয়র স্বাদ প্রাচীনকাল থেকেই গ্রহণ করছে মানুষ। গ্রিস এবং রোমানদের সময়েও এমন পানীয়র চল ছিল। বলা হয়, সম্রাট নিরো মদ বা মধুর স্বাদসমৃদ্ধ বরফ-পানীয় পান করতে পছন্দ করতেন।
শীতল পানীয় বানানো প্রাচীনকালে সহজ ছিল না। বরফকে দীর্ঘ সময় ধরে ঠিক রাখাই ছিল সেকালের প্রধান সমস্যা। ফ্রিজ আবিষ্কারের আগে বরফ বাগানোর জন্য পাহাড়ের চূড়ার ঢুঁ মারতে হতো। সে বরফ যেন গলে পানি হয়ে না যায়, তার ব্যবস্থা করতে হতো। হাজার হাজার বছর আগে, মেসোপটেমিয়ার মতো অঞ্চলে বরফ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ভবন বানাত মানুষ। পাহাড় থেকে বরফ সংগ্রহ করে বিশেষ গর্তে সংরক্ষণ করত গ্রিক ও রোমানরা। ইরানেও এ রকম চল ছিল। ফার্সিতে সাধারণ ফ্রিজকে ইয়াকচল বলা হয়। ইয়াক মানে বরফ। চল মানে গর্ত। সহজেই বোঝা যায় এমন নামকরণের উৎস কী!
চীনে প্রায় ১১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে খাবারকে তাজা রাখার জন্য বরফ সংগ্রহ করত মানুষ। ৮৩৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রেত্রা জয় করেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। বরফ সংগ্রহ করার গর্তের দেখা সেখানে পান তিনি।
চতুর্থ শতকে জাপানের সম্রাট নিনতোকু বরফের খাদ্য সংরক্ষণ সক্ষমতায় যারপরনাই বিস্মিত হন। তিনি জুন মাসের পয়লা তারিখকে তার সাম্রাজ্যে জাতীয় বরফ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ঘটনাক্রমে মাটি খুঁড়ে খড় দিয়ে ঢেকে বরফ সংরক্ষণের বিষয়টি এক রাজপুত্র জানতে পারেন। স্থানীয় চাষি-গেরস্থদের কাছ থেকে এ বিদ্যা শিখেন তিনি। রাজপুত্র বরফ সংরক্ষণের এই অবাক বিদ্যার কথা সম্রাট পিতাকে তড়িঘড়ি জানান। নিনতোকু অবলিম্বে বরফ সংরক্ষণের এ বিদ্যা লুফে নেন।
তাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ) সম্রাটরাই প্রথম আইসক্রিমতুল্য হিমায়িত খাবার উপভোগ করেন। এখকার আইসক্রিমের সাথে আদি এ হিমায়িত খাবারের মিল ছিল না। প্রাচীনকালের সেই আইসক্রিম বানাতে ছাগল, মহিষ বা গরুর গেঁজানো দুধ, ময়দা এবং কর্পূরের ব্যবহার করা হতো। এতে স্বাদ বাড়ানোর জন্য কথিত ড্রাগনের মস্তিষ্কের টুকরা এবং চোখের তারা বা আই বল যোগ করা হতো। অবশ্য ড্রাগনের মস্তিষ্কের টুকরা এবং চোখের তারা বলতে ঠিক কোন উপাদানকে বোঝানো হতো, তা জানা যায় না। যতদূর অনুমান করি এখনকার সময়ে আইসক্রিমের উপরে, বিশেষ করে কোন আইসক্রিমের উপরে যে বাদাম বা অন্য নানা জাতীয় জিনিস: খুদে বলের মতো, কণার মতো ছিটানো থাকে, সেরকম কিছুই হবে!
হিমায়িত মিষ্টিকে তুষারকণার মতো করে তুলতে ব্যবহার হতো কর্পূর। কর্পূরের ভেষজগুণ আছে বলেও সেকালে মানুষ বিশ্বাস করতেন। এই পুরো মিশ্রণকে একটি ধাতব পাত্রে রেখে সে পাত্র বরফে ঢেকে দেওয়া হতো। একই পদ্ধতিতে ভারতবর্ষে কুলফি তৈরি করা হয়। আর আমরা এ সময়ে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফির হাকডাক গরমের দিনে তো রাস্তায় হামেশাই শুনি।
চীন থেকে আইসক্রিমের শুরু নিয়ে অনেক সব গালগল্প আছে। তা-ও খুঁটিয়ে দেখা যাক। অভিযাত্রী মর্কোপোলো (১২৫৪-১৩২৪) দূরপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে আইসক্রিম নিয়ে গেছেনÑএমন চিত্তাকর্ষক কাহিনি প্রচলিত আছে। রন্ধন বিষয়ক ঐতিহাসিক এলিজাবেথ ডেভিড মনে করেন কুমিজ নামে পরিচিত গেঁজানো ঘোড়ার দুধ হয়তো মঙ্গোলিয়ায় চেখেছেন মার্কো। তারই ভিত্তিতে আইসক্রিম নিয়ে কাহিনি ছড়িয়েছে মার্কো পোলোর নামে। অন্যান্য ঐতিহাসিক মনে করেন, ভেনিসবাসী এই অভিযাত্রী চীনে হয়তো হিমায়িত খাবার খেয়েছেন।
কিন্তু মিষ্টিকে হিমায়িত করার প্রণালি বা এ বিষয়ে কোনো তথ্য তিনি ইতালিতে নিয়ে যাননি। এ বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত ঐতিহাসিকগণ। তা না হলে খাদ্য হিমায়িত করার বিষয়কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে কেন আরও তিন শতাব্দী দেরি করতে হলো ইতালীয়দের? পণ্ডিতদের আরেক দল মনে করেন, ইউরোপে আইসক্রিমের বিস্তারও ঘটাননি মার্কোপোলো। এমন ভাবনার কারণ কী? তারা বলেন, অসীম সাহসী এই অভিযাত্রী দূরবর্তী বিস্ময়কর সে ভূমি কখনোই সফর করেননি।
আইসক্রিম নিয়ে আরেক কিংবদন্তি গড়ে উঠেছে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হেনরির বধূকে ঘিরে। তখনো হেনরি রাজা হয়নি; তিনি হলেন ডিউক অব অরলিন্স। তার বধূ ক্যাথরিন ডি মেডিসির বয়স চৌদ্দ। ১৫৩৩-এ ক্যাথরিনকে বিয়ে করেন। ফ্রান্সে আইসক্রিমের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেন ক্যাথরিন। কিন্তু রোমান্সে ঘেরা এ কিংবদন্তিকে সমর্থন করার মতো ঐতিহাসিক কোনো আলামতই নেই।
মধ্যযুগ থেকেই আরবীয়রা শরবত খেত। পারস্য এবং তুর্কিতেও পছন্দের ছিল শরবত। চেরি, আনার বা নাশপতির নির্যাস এবং খোশবুতে ভরপুর শরবত। ভ্রমণকারীদের সঙ্গী হয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে আসে এ পানীয়। অল্প সময়ের মধ্যেই ইউরোপের সব অভিজাত পরিবারে সমাদৃত হতে থাকে শরবত।
রান্নাবিষয়ক ইতিহাসবিদ আলবার্তো ক্যাপাতি এবং ম্যাসিমো মন্তনারি লিখেছেন, হিমায়িত পানীয় তৈরির ক্ষেত্রে অবিসংবাদিত দক্ষতা ছিল ইতালীয়দের। ইতালির এই পানীয়র প্রচণ্ড প্রভাব ছিল ফ্রান্সে। ফ্রান্সের মিষ্টি প্রস্তুতকারক নিকোলাস অডিগার ১৬৯২-এ প্রকাশিত লা মেসন রেগলি পাঠকদের পরামর্শ দেন যে শীতল এবং হিমায়িত তরল পানীয় তৈরির জন্য ইতালীয় কৌশল যেন গ্রহণ করা হয়।
বরফ দেওয়া শীতল পানীয় তৈরিতে মদ, মসলা বা নাশপাতিসহ নানা ফল, চিনি এবং পানি ব্যবহার হতো। আইসক্রিম স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়Ñএ রকম অভিযোগ ইতিহাসের নানা পর্যায়েই উঠেছে। কোনো কোনো চিকিৎসক শীতল পানীয়কে সরাসরি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ঘোষণা করেছেন। চিকিৎসাবিদরাও শীতল পানীয়র বিরুদ্ধেই নানা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
অতি শীতল খাদ্য প্যারালাইসিসের মতো রকমারি বিপদ-আপদ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু এতে দমে যাননি ইতালির মানুষ। তারা চিকিৎসাবিদদের কথাকে কানেই তোলেননি। বরফ দেওয়া পানীয় খাওয়া থেকে বিরত হননি তারা। আজকের দিনে চর্বিজাত খাদ্য রক্তনালির বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। তারপরও অতিমাত্রায় তেল-চর্বিজাত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত হয়েছেন কয়জন মানুষ?
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বরফ দেওয়া পানীয় জমাট বা হিমায়িত মিষ্টিতে রূপ নেয়। চিনির সাথে স্ট্রবেরি, লেবু বরফ যোগ করে তৈরি হতে থাকে এ খাদ্য। হিমায়িত এ মিষ্টিকে ‘সুরবেত্তো’ নাম দেওয়া হয়। মনে হয় এমন খাদ্য প্রথমে তৈরি হয় ইতালিতেই। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, আজকের দিনের আইসক্রিমের জনক গিয়ামবাতিস্তা দেলা পোর্তা। কবি, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং ভাষাবিদ ফ্রান্সিস রেদি বরফ-খাদ্য খাওয়ার তৃপ্তি ও আনন্দ নিয়ে কবিতা, আরিয়ানা ইনফেরমা রচনা করেন।
নেপলসে স্প্যানিশ ভাইসরয়ের পাকশাল এবং খাদ্যবিষয়ক তত্ত্বাবধায়ক আন্তোনিও লাতিনি প্রথম ‘সুরবেত্তো’ তৈরির প্রণালি এবং পরিবেশনের পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করেন। নেপলসে কেবল অভিজাতবর্গরাই নয়, সাধারণ মানুষজনও ‘সুরবেত্তো’ পান করতেন। তারপরও তিনি মনে করেন, এই হিমায়িত খাদ্য তৈরির কৌশল আরও উন্নয়নের অনেক সুযোগ আছে।
ফলের নির্যাসের সাথে সাথে তিনি এ পানীয়তে চকোলেটও যোগ করেন। ষোড়শ শতকে মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকা জয় করে স্পেনীয়রা চকোলেটের সাথে পরিচিত হয়। তখন এটি তুলনামূলকভাবে ইউরোপের খাদ্যজগতে নবাগত হিসেবেই পরিচিত। তিনি কোনো কোনো জাতের পাইনের বীজ এবং বেগুনও এই হিমায়িত খাবারে যোগ করেন। এ ছাড়া দুধ দিয়ে ‘সুরবেত্তো’ তৈরির প্রণালিও লিপিবদ্ধ করেন।
রন্ধন ঐতিহাসিকদের বেশির ভাগই লাতিনির এই ‘দুধ ‘সুরবেত্তো’কে প্রথম আইসক্রিম হিসেবে উল্লেখ করেন। দুগ্ধজাত মিষ্টিকে হিমায়িত করার এ প্রক্রিয়াকে তখন নতুন পদ্ধতি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। তবে দুগ্ধজাত ননি বা ক্রিমসমৃদ্ধ মিষ্টির চল মধ্যযুগের ইউরোপে ছিল। কিন্তু তাকে হিমায়িত করার কথাও লাতিনির আগে হয়তো যথাযথভাবে কেউ চিন্তা করেননি।
লাতিনির ‘সুরবেত্তো’ তৈরির প্রণালি প্রকাশের ২০ বছর আগেই বরফ দেওয়া খাবারের প্রথম পাকপ্রণালি প্রকাশ করেন ফরাসি নাগরিক নিকোলা লেমেরি। এর দুই দশক পরে লেমেরির পাকপ্রণালিসহ অন্যান্য লেখা মর্ডান কিউরিসিটিস অব আর্ট অ্যান্ড নেচার নামে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।
এরই মধ্যে ফ্রান্সে নতুন খাদ্যপ্রতিষ্ঠান তৈরি হলো; যা কিনা আইসক্রিমের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করে তোলে। খাদ্যের এ প্রতিষ্ঠানকে পৃথিবীর প্রথম ক্যাফে হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৬৮৬-এ একজন সিসিলীয়, ফ্র্যান্সেকো প্রোকোপিও দেই কোলতেল্লি প্যারিস ইল প্রোকোপ নামে এ ক্যাফে প্রথম চালু করেন। হিমায়িত খাদ্যসহ অন্যান্য নানা হালকা খাবারের সাথে রাজনীতি এবং সাহিত্য নিয়ে আড্ডাবাজি জমে ওঠে এখানে। নেপোলিয়ন, ভলতেয়ার, ভিক্তর হুগো, বালজাক এবং বেনজামিন ফ্রাংকলিন সবাই এল প্রোকোপের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, রাজনীতিবিদদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এর দুই শ বছর পরে একই আদলে গড়ে ওঠে মার্কিন আইসক্রিম পার্লার।
পরে ইতালির হিমায়িত ‘সুরবেত্তো’-জাতীয় পানীয় তৈরির প্রক্রিয়াও দেশটি সফর করে আসা ফরাসিদের মাধ্যমে বিস্তার ঘটে। এ ছাড়া হিমায়ন প্রক্রিয়ার খানিক উন্নয়ন ঘটানো হয়। হিমায়িত করার সময় মিশ্রণটি নেড়েচেড়ে দেওয়া হতে থাকে। এতে ফুলো ফুলো ভাবের সৃষ্টি হয়।
আধুনিক আইসক্রিম উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ননি বা ক্রিম, শরবত এবং নির্যাস বা ফ্লেভারিং। তবে এ ক্ষেত্রে অন্য আরেকটি গুরুত্ববহ বস্তু হলো বরফ। বরফ যে প্রাগ-ফ্রিজ যুগে বিলাসী পণ্য ছিল, সে কথা এখন চিন্তা করাই মুশকিল। ইতিহাসের বেশির ভাগ সময়জুড়ে বরফ বলতে দামি, দ্রুত ক্ষয় হয় এমন পণ্যকেই বোঝাত। ১৯ শতক পর্যন্ত এ অবস্থাই ছিল। বরফ সংরক্ষণের জন্য দেশে দেশে কী করা হতো, তা নিয়ে আগেই কথা বলা হয়েছে।
এখানেও একটা কিন্তু রয়ে গেছে। শীতল পানীয় বানাতে বরফ দিলেই কাজ হবে। কিন্তু যদি খাদ্যকে জমাতে হয়, তাহলে শুধু বরফে রাখলে হবে না। বরফের সাথে নুন যোগ করতে হবে। এ বিষয়টা চীন, আরব ও ভারতবর্ষের মানুষ ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। নুন দেওয়া হলে বরফের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নামিয়ে আনা হয়। একে বিজ্ঞানের ভাষায় এনডোথারমিক এফেক্ট বা তাপহারী বিক্রিয়া বলা হয়। এটি জানা না থাকলে আজকের দিনে আইসক্রিম বলতে যা বুঝি, তার স্বাদ পেত না মানুষ। পেত অর্ধগলিত শীতল খাবার।
১৮ শতক থেকে ইংল্যান্ডে সমৃদ্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটতে থাকে। তাদের নানা রকমের মিষ্টি খাবারের চাহিদা মেটাতে ইংরেজ বধূরা আইসক্রিম তৈরির প্রণালিসহ পাকপ্রণালি প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু এরপরও আইসক্রিম উদ্ভাবনের পন্থার কথা বলা হলে, অর্থাৎ নতুন নতুন প্রণালি এবং হিমায়নের কৌশল বিষয়ে এগিয়ে থাকে ইতালি ও ফ্রান্স।
আপনার মতামত জানানঃ