খুন করার সেই যে ট্রেন চালু করেছেন, একেরপর এক স্টেশন এসে ট্রেন ক্ষাণিক বিরতী নিলেও তার খুন করার ট্রেন স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে। থানা পুলিশ র্যাব ইত্যাদি প্রশাসন তাকে ওইসব স্টেশনগুলোতে মাঝেমধ্যে থামালেও খুন করার ট্রেন তিনি সবসময়ই চালু রাখেন। খুনের মামলা হয়, গ্রেপ্তার হন, এতকিছুর পরও তার স্বীয়কার্যে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। এসব মামলা টামলা এখন তার সাময়িক বিরতিতে পরিণত হয়েছে। তিনি আর কেউ নন চট্টগ্রাম নগরের এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আগ্রাবাদের ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর তিনি। নগর রাজনীতিতে তিনি সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।তার বিরুদ্ধে সাতটি খুনসহ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও অপহরণের ২৯টি মামলা ছিল। এর মধ্যে সাক্ষীরা ভয়ে সাক্ষ্য না দেওয়ায় ২৩টি মামলায় খালাস পান তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে চারটি খুনেরসহ পাঁচটি মামলা। মামলা থেকে রেহাই পেয়ে তিনি যেন আরো গতি পান। বুক সটান করে নির্বিঘ্নে তার নিজের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। নগরের বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত আগ্রাবাদে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে নির্বিঘ্নে মাদকের কারবার, নির্বিচারে চাঁদাবাজি ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন।
আবদুল কাদের আবার আলোচনায় এসেছেন নির্বাচনী সহিংসতার খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে। এবারের সিটি নির্বাচনে দল থেকে সমর্থন না পেয়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। প্রচারণা শুরুর পাঁচ দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার রাতে তার এলাকা পাঠানটুলীর মগপুকুরপাড় এলাকায় দল মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় তার অনুসারীদের। এতে আজগর আলী ওরফে বাবুল নামের এক মহল্লা সরদার নিহত হন। আজগর ছিলেন বাহাদুরের সমর্থক। আজগরের পরিবার ও প্রার্থী বাহাদুরের দাবি, বাহাদুরের পক্ষে কাজ করায় পরিকল্পিতভাবে আজগরকে হত্যা করা হয়েছে। এমন সহিংসতায় শঙ্কায় আছেন কাদেরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও এলাকার মানুষেরা।
মোগলটুলী বাজারে মাছ কাটতেন বলে মাছ কাদের হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। আশির দশকে কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করেন। একপর্যায়ে নিজেই একটি অংশের নেতৃত্বে চলে যান। আগ্রাবাদ ও মোগলটুলী এলাকায় আধিপত্য বিস্তৃত হয় তার। দীর্ঘদিন কমার্স কলেজ ঘিরে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন গ্রুপের সঙ্গে তার বিরোধ ছিল তুঙ্গে। প্রায়ই দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি লেগে থাকত।২০০০ সালের ১ এপ্রিল গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৮ এপ্রিল কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনের আগে আ জ ম নাছিরকেই গুরু মেনে কাউন্সিলর নির্বাচন করেন কাদের। নির্বাচিত হয়ে ভালো মানুষের মুখোশ পরলেও এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আবারও স্বরূপে ফিরেছেন।
১৯৯৭ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র শফিউদ্দিন আজাদকে গুলি করে হত্যা করেন মাছ কাদের। এর আগে চাঁদাবাজি করে পরিচিতি পেলেও আজাদ হত্যার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৮ সালের ৭ অক্টোবর চাঁদা না পেয়ে নগরের ডবলমুরিং ক্রাউন কোম্পানির বাড়ির সামনে ব্যবসায়ী আবদুল কাদেরকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন সন্ত্রাসী মাছ কাদের। ১৯৯৯ সালের ২ মার্চ পাঁচলাইশ পলিটেকনিক এলাকার ফারজানা হোটেলে পলিটেকনিক ইনস্টিউিটের ছাত্র আবদুল কাদেরকে গুলি করে হত্যা করেন। ২০০০ সালের ৯ জানুয়ারি ঈদের দিন ডবলমুরিং মোগলটুলী এলাকায় ব্যবসায়ী আহাম্মদ আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালে এ চারটি হত্যা মামলাসহ পাঁচটি মামলা থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় রেহাই পান সন্ত্রাসী মাছ কাদের। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায়ও ছিল আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের।
২০০০ সালের ১ এপ্রিল একটি অপহরণ মামলায় কাদের গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘ নয় বছর এক মাস কারাবাসের পর ২০০৯ সালের ৭ মে মুক্তি পান। বেরিয়ে আবারও চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ সময় র্যাবের এক সদস্যের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন কাদের। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করেছিল র্যাব। ২০১১ সালে জামিনে বের হয়ে আত্মগোপনে চলে যান। সর্বশেষ ২০১৫ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী মাছ কাদের। ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আত্মগোপনে গেলেও এখন স্বরূপে ফিরেছেন তিনি। এবারের নির্বাচনেও এই শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রার্থী হওয়ায় শুরু থেকেই শঙ্কিত ছিল ভোটাররা।
আদালত সূত্র জানায়, নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত ইনামুল হক দানু, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কাদেরের নাম মামলা থেকে প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করেন। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখায় আবেদন করা হয়।
এ ব্যাপারে আ জ ম নাছির উদ্দীন গণমাধ্যমকে জানান, ‘রাজনীতি করলে মামলা থাকতে পারে। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা–নেত্রীসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না।’ অপহরণ, চাঁদাবাজি, খুনের মামলা প্রত্যাহার করতে সুপারিশ করা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এগুলো ষড়যন্ত্রমূলক। প্রত্যাহারযোগ্য হওয়ায় প্রত্যাহার হয়েছে।’ র্যাব-পুলিশের তালিকায় কাদেরের নাম থাকা বিষয়ে আ জ ম নাছির বলেন, ‘অনেক ভালো মানুষের নামও অনেক সময় যুক্ত করে দেয় তারা।’
আজগর খুনের পর নগর আওয়ামী লীগ আবার বুধবার রাতে জরুরি সভা করে সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বিদ্রোহীরা অনড় থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। ৩৪ ওয়ার্ডে ৮০ জনের বেশি বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন।
সংশিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি মামলার আসামি খালাস ও দায়মুক্তি পাওয়া নাগরিক সমাজের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। সরকারি ছায়ার নিচে থেকে লাগাম ছাড়া অপরাধকাণ্ড ঘটাতে সাহস পাচ্ছেন বলে জানান তারা। যার মাথার ওপর বড় বড় রাঘব বোয়ালরা থাকেন, ক্ষমতাসীন দলের আশির্বাদ থাকে, খুন করার সময় তিনি সাত পাঁচ না ভাবতেই পারেন যেহেতু তিনি জানেন, এসব মামলা তাকে আটকে রাখার জিনিস নয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার হওয়ায় সমাজে অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। সরকারি দলে যারা এসব সন্ত্রাসীর পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নইলে অপরাধ বাড়তে থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৬
আপনার মতামত জানানঃ