হাওয়ায় উড়েই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে যাবে গাড়ি কিংবা বাইক। সাম্প্রতিক সময়ে এ-হেন উড়ন্ত ‘উভচর’ যান সাড়া ফেলে দিয়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে। বাণিজ্যিকভাবে বৈশ্বিক বাজারে বিক্রি চলে এসেছে এই আশ্চর্য প্রযুক্তি। কিন্তু উড়ন্ত ট্যাঙ্ক?
কয়েকশো টন ওজনবিশিষ্ট ট্যাঙ্ক আকাশে উড়ছে— এই দৃশ্য কল্পনা করা বেশ কঠিন যে কারোর পক্ষেই। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এমনই এক আশ্চর্য যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে দেখিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন (Soviet Union)।
অ্যান্তোনভ এ-৪০ (Antonov A-40)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (WW II) সময় প্রতিপক্ষের সেনাকে পরাস্ত করতে আবিষ্কৃত হয় আশ্চর্য সব যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধযান, বর্ম ও অন্যান্য সামগ্রী। সেই তালিকায় পরমাণু বোমা, বাদুড় বোমার মতো হাতিয়ারের সঙ্গেই উচ্চারিত হয় অ্যান্তোনভ এ-৪০-এর নাম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, স্থলজ যুদ্ধে ‘গেম-চেঞ্জার’-এর ভূমিকা নিয়েছিল ট্যাঙ্ক। কারণ, দ্রুত গতি-সম্পন্ন, শক্তিশালী ও ভারি সাঁজোয়া গাড়ি হাজার হাজার পদাতিক সৈন্যকে রুখে দিতে পারত মুহূর্তের মধ্যেই।
তবে ট্যাঙ্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় পরিবহন। অর্থাৎ, এক জায়গা থেকে ভিন্ন জায়গায় এত ভারি যুদ্ধযান স্থানান্তরিত করতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হত সেনাবাহিনীকে। জ্বালানির জন্যও বহন করতে হত বাড়তি খরচ। এই সমস্যার সমাধান হিসাবেই অ্যান্তোনভ এ-৪০-এর উদ্ভাবন।
১৯৪১ সাল। তখন পর্যন্ত সোভিয়েত যুদ্ধক্ষেত্রে মূলত ব্যবহার করছে দু-ধরনের ট্যাঙ্ক। যার মধ্যে ওজনে ভারি টি-৬০ ট্যাঙ্ক জার্মান বাহিনীকে প্রতিহত করতে যথেষ্ট সামর্থ্য হলেও, তা কেবলমাত্র মাটিতেই চলাচল করতে সক্ষম।
বিপরীতে হালকা এবং ছোটো ‘কেএস’ ট্যাঙ্ক এয়ারলিফটের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হত যুদ্ধক্ষেত্রে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মাটিতে অবতরণের সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হত। পাশাপাশি জার্মান প্রযুক্তির সঙ্গে যুত করে ওঠার মতো ক্ষমতাও ছিল না তাদের। ফলে, বিকল্প প্রযুক্তির চাহিদা বাড়ছিল দিনে দিনে।
এই জটিল ধাঁধার সমাধান করেন রাশিয়ান এভিয়েশনের জনক কনস্টান্টিনোভিচ অ্যান্তোনভ। প্রকাণ্ড দোতলা ডানাবিশিষ্ট একটি বিশেষ খাঁচা তৈরি করেন তিনি। যার মধ্যে অনায়াসেই আটকে যেতে পারত ভারি ‘স্থলচর’ টি-৬০ ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্কের ভেতরে বসে কেবলমাত্র একটি লিভারের মাধ্যমেই বিচ্ছিন্ন বা সংযুক্ত করা যেতে পারে প্রকাণ্ড ডানাটি। সঙ্গে ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে ডানার কৌণিক অবস্থান পরিবর্তনেরও ব্যবস্থা করেন তিনি।
মজার বিষয় হল, এই আশ্চর্য ডানাবিশিষ্ট ফ্রেমটিতে উড়ান নেওয়ার জন্য আলাদা করে কোনো ইঞ্জিনই সংযুক্ত করেননি অ্যান্তোনভ। বরং, পণ্যবাহী বিমানের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ওড়ানো হত এই গোটা ব্যবস্থাটাকে। একটি নির্দিষ্ট গতি পাওয়ার পর ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে ডানার কৌণিক অবস্থান পরিবর্তন করলেই দিব্যি উড়তে পারত ট্যাঙ্কটি। এ-তো গেল নকশার কথা। কিন্তু বাস্তবে কি এমনটা সম্ভব?
হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও, বাস্তবেই ফলপ্রসূ হয়েছিল অ্যান্তোনভের এই নকশা। ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২ সাল। প্রথমবারের জন্য আকাশে উড়ান নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই আশ্চর্য যুদ্ধাস্ত্র। টিবি-৩ বোমারু বিমানের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ওড়ানো হয়েছিল এই ট্যাঙ্ককে।
সফলভাবেই উত্তরণ এবং অবতরণ করেছিল এ-৪০। মাঝ আকাশে বিমান ও ট্যাঙ্কের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর ১৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে গ্লাইড করে কয়েকশো মাইল পথ অতিক্রম করেছিল এ-৪০।
তবে এ-৪০-র টেস্ট ফ্লাইট সফল হলেও, তা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহৃত হয়নি যুদ্ধক্ষেত্রে। তার কারণ, অবতরণের সময় প্রচণ্ড গতি এবং ঝাঁকুনিতে আহত হয়েছিল ট্যাঙ্কের চালক ও অন্যান্য কর্মীরা। পাশাপাশি অ্যান্তোনভ এ-৪০-এর ডানার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১৮ মিটার।
অর্থাৎ সবমিলিয়ে প্রায় ৮৫ বর্গ মিটার বা ৯২৩ ফুট জায়গার প্রয়োজন হত এই ট্যাঙ্ক অবতরণের জন্য। জঙ্গলাকীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্ক অবতরণের জন্য এই পরিমাণ বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গা প্রত্যাশা করা খানিকটা অবাস্তব তো বটেই। সবমিলিয়ে শেষ পর্যন্ত তাই এই প্রকল্পকে বাতিল করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এমনকি এই একটিমাত্রই প্রোটোটাইপ নির্মিত হয়েছিল সে-দেশে।
অবশ্য হার মানেননি বিজ্ঞানী অ্যান্তোনভ। পরবর্তীতে ইলিউশন ইল-২ নামের আরও একটি উড়ন্ত ট্যাঙ্ক তৈরি করেন তিনি। সেটি অবশ্য গ্লাইডার ও ট্যাঙ্কের সংমিশ্রণ নয়। ইলিউশন ইল-২ আদতে বিমান। তবে জার্মান গোলা-বারুদ ও মেশিনগানের থেকে এই বিমানকে রক্ষা করার জন্য তার আগে বসানো হয়েছিল ধাতুর তৈরি পুরু বর্ম। আর সে-জন্যই ‘ফ্লাইং ট্যাঙ্ক’ উপাধি দেওয়া হয় এই বিশেষ যুদ্ধযানকে। বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে এই বিমানই তুরুপের তাস হয়ে ওঠে সোভিয়েতের। সেই গল্প না-হয় বলা যাবে অন্য একদিন।
আপনার মতামত জানানঃ