স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ৩টিতে ভোট পড়ার হার ৪২ শতাংশের নিচে ছিল। এর দুটিই অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১০ বছরে। গত এক দশকে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও দেখা গেছে, ভোটারদের বেশির ভাগ ভোট দিতে যাননি। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৪১ দশমিক ৮০ শতাংশ। অবশ্য ভোটের এই হার নিয়ে নানা সন্দেহের পাশাপাশি প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
নির্বাচন বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ভোটের প্রতি সাধারণ মানুষের একধরনের অনাগ্রহ তৈরি হতে থাকে। ওই নির্বাচনে বিনা ভোটে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য জয়ী হন। তখন বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করে এবং ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। মূলত এসব ঘটনায় নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ কমতে থাকে। এর পর থেকে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৫৫ থেকে ৭৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। তবে সে নির্বাচনগুলো নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক ছিল।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও অনিয়ম এবং ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে। আর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ভোট দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ সামনে আনে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যথাযথ ভূমিকা নিতে পারেনি। ফলে নির্বাচনব্যবস্থা ও ইসির প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছে বলেও মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকেরা।
তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি টানা নির্বাচন বর্জন করায় নির্বাচন হয়ে পড়েছে অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। সব মিলিয়ে এখন নির্বাচনের ফল নির্ধারণে ভোটারদের গুরুত্ব নেই, এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। এ কারণেও ভোটারের মধ্যে ভোটবিমুখতা তৈরি হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ভোটারদের বড় অংশ মনে করছে, ভোট দেওয়া না দেওয়ায় কিছু যায় আসে না। এই পরিস্থিতি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। ১৯৯১ থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রায় সব নির্বাচনে মানুষ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, নির্বাচনে নানা রকম কারসাজির কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনপ্রক্রিয়া কারসাজিমুক্ত না করে ভোটার দিবস পালন করা অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ২ মার্চ জাতীয় ভোটার দিবস পালন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সঠিক তথ্যে ভোটার হব, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব’। দেশে ভোটার দিবসের প্রচলন শুরু হয় ২০১৯ সালে। মূলত ভোটার হতে এবং ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহিত করতে এই দিবস পালন করা হয়।
আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৩ সালে গাজীপুর, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৬২ থেকে ৭৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন।
একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ, ২০১৪ সালের দশম ও চলতি বছরের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাদে অন্য সব জাতীয় নির্বাচনে ৫১ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৫৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ, সপ্তম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬ সালের জুনে) প্রায় ৭৫ শতাংশ, অষ্টম সংসদ নির্বাচনে (২০০১ সালের) ৭৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং নবম সংসদ নির্বাচনে (২০০৮ সালের ডিসেম্বরে) দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ ভোট পড়ে।
২০০৮ ও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও ভোটার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৬৮ শতাংশের কিছু বেশি। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৭৫ থেকে ৮২ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে গিয়েছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৩ সালে গাজীপুর, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৬২ থেকে ৭৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন।
মূলত ২০১৪ সালে বিএনপির বর্জনে একতরফা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমতে শুরু করে। ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায় আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা। সে নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৪০ শতাংশ।
দশম সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয়েছিল ছয়টি ধাপে। এখানে ভোট পড়ার হার ছিল ৫৯ থেকে প্রায় ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত। তবে ওই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এরপর স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে আবারও ভোটার উপস্থিতি কমতে শুরু করে। ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোট দিয়েছিলেন ৪৮ শতাংশ ভোটার।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৫৫ থেকে ৭৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। তবে সে নির্বাচনগুলো নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক ছিল। এই নির্বাচনগুলোতে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর ইসির কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ওই পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে তখনকার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তাঁর বইয়ে (নির্বাচননামা: নির্বাচন কমিশনে আমার দিনগুলো) লিখেছেন, ‘সামগ্রিক পর্যালোচনায় আমার কাছে মনে হয়েছে, নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের হাত থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তরিত হয়ে গেছে।’
এরপর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ সব কটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া হিসাবে ওই নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ৮০ শতাংশ। তবে ওই নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক আছে। বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচনের আগের রাতে বিভিন্ন জায়গায় ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়। সব জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন ফলাফল নিয়ে বই আকারে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।
ওই নির্বাচনের পর থেকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতেও আবার ভোটারদের অনীহা দেখা যায়। বিএনপিও স্থানীয় সরকারের বেশির ভাগ নির্বাচন বর্জন করে। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৩৬ থেকে ৪৩ শতাংশ।
২০২০ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ভোট দিতে গিয়েছিলেন মাত্র ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোটার। আর দক্ষিণে ভোট দিয়েছিলেন ২৯ শতাংশ ভোটার। আর গত বছর অনুষ্ঠিত গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আগের বারের তুলনায় ভোটার উপস্থিতি আরও কমে আসে। এই পাঁচ সিটির মধ্যে সর্বনিম্ন ৪৬ দশমিক ৭১ শতাংশ ভোট পড়েছিল সিলেটে, সর্বোচ্চ ৫৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল গাজীপুরে।
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো ছিল ক্ষমতাসীনদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এ জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৫৮ শতাংশ ভোটারকে ভোটকেন্দ্রমুখী করা যায়নি।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ভোটের হার কমছে কেন এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো গবেষণা নেই। রাজনৈতিক দলগুলো এই ধরনের গবেষণা করতে পারে। নির্বাচন কমিশন ‘রেফারি’র ভূমিকা পালন করে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে এবং ভোটারদের ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করতে যত প্রচার-প্রচারণা দরকার, কমিশন তা করে থাকে।
২০০১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৪৩ লাখের কিছু বেশি। ওই বছর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৭ কোটি ৪৯ লাখের কিছু বেশি। অর্থাৎ তখন ভোটার ছিল মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ। ওই নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৭৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
অন্যদিকে এখন দেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এর মধ্যে ভোটার প্রায় ১২ কোটি বা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ ভোটার। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ৪১ দশমিক ৮০ শতাংশ ভোটার।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভোটার হওয়ার জন্য মানুষ আগ্রহী। কারণ, ভোটার হওয়ার সঙ্গে এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সম্পর্কিত। এনআইডি পেতে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হতে হয়। আর ব্যাংক হিসাব খোলা থেকে শুরু করে চাকরি, বিয়ে নিবন্ধন, জমি কেনা-বেচাসহ অতিপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন সেবা পেতে প্রয়োজন এনআইডি। এই সেবা ইসির হাত থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চলে গেলে ভোটার হওয়ার প্রতিও নতুনদের অনীহা দেখা দিতে পারে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে চারটি প্রশ্নের জবাব পাচ্ছেন না ভোটাররা। এই প্রশ্নগুলো হলো: ১. ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কি পছন্দমতো প্রার্থী পাব? ২. প্রার্থী পেলেও নিজের পছন্দ অনুযায়ী কি ভোট দিতে পারব? ৩. ভোট দিতে পারলেও সেটা কি সঠিকভাবে গণনা হবে? ৪. ভোটের ফলাফলে এই ভোট কি ভূমিকা রাখবে? প্রায় ১৫ বছর ধরে জাতীয় নির্বাচন বা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে এই প্রশ্নগুলোর জবাব না পাওয়ার কারণে ভোট দেওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে।
আপনার মতামত জানানঃ