রোক্সানা ছাড়াও আলেকজান্ডারের জীবনে প্রভাব রেখেছেন আরো কয়েকজন নারী। এদের মধ্যে মুখ্য ছিলেন তার মা অলিম্পিয়াস। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এ কারণে ভাগ্যবান ছিলেন যে তার জীবনে এমন কয়েকজন নারী ছিলেন, যারা তাকে সব ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন। ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে তিনি এ নারীদের দ্বারা সুরক্ষিত ছিলেন এবং তারা ছিলেন তার ক্ষমতার গোপন উৎস।
আলেকজান্ডারের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারী হলেন তার মা অলিম্পিয়াস, তবে স্ত্রী রোক্সানা ও বার্সিনেরও তার ওপর প্রভাব ছিল। মেসিডোনিয়ার কখেকজন রাজার সংক্ষিপ্ত প্রণয় তার জীবনকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তার পক্ষে এ ক্ষমতাশালী নারীরা না থাকা সত্ত্বেও যদি তিনি সফল হতেন, তাহলে তা হতো অবাক হওয়ার মতো বিষয়।
অলিম্পিয়াস: মা, অভিভাবক ও সেরা বন্ধু
অলিম্পিয়াস ছিলেন আলেকজান্ডারের মা, অভিভাবক ও সেরা বন্ধু। তিনি ছিলেন এমন এক নারী, যিনি তার পুত্রের সুরক্ষার জন্য সিংহের মতো লড়াই করেছিলেন। এমনকি আলেকজান্ডারকে সমর্থন করার জন্য তার স্বামী মেসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপকে পর্যন্ত বলিদান করেছিলেন। জন্মের সময় তার নাম ছিল মার্টল। তিনি এপিরাসের রাজা নিওপটোলেমাসের মেয়ে ছিলেন। জনশ্রুতি আছে, তার পূর্বপুরুষরা ট্রোজান যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
অলিম্পিয়াসের বিয়ে ভাগ্য ভালো ছিল না। তিনি পুনরায় গর্ভধারণে অক্ষম হয়ে পড়লে ফিলিপ অন্য নারীদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফিলিপ ছিলেন বহুগামী, যার জন্য অলিম্পিয়াসকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। অলিম্পিয়াসের নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে তিনি ফিলিপের অন্য পুত্রদের কাউকেই রাজা হতে দেবেন না। রাজা হবে শুধু তার নিজের সন্তান। তিনি ছিলেন আলেকজান্ডারের শিক্ষক ও সমর্থক। তিনি এমন লোকদের নিয়ে একটি সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলেন, যারা মোসিডোনিয়ার রাজা হওয়ার সম্ভাবনাময় সেই ছেলেটিকে রক্ষা করার জন্য প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিল।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রোক্সানা ও নাতি চতুর্থ আলেকজান্ডারের জন্য একই রকম সমর্থন ও শক্তির উৎস হতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন অলিম্পিয়াস। তিনি আশা করেছিলেন, তার নাতি আলেকজান্ডারের রাজত্ব অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু হয়নি। অলিম্পিয়াস খ্রিস্টপূর্ব ৩১০ অব্দের দিকে ক্যাসান্ডারের কাছে হেরে যান এবং হত্যা করা হয়।
বার্সাইন: পারসিক ইতিহাসের অভিজাত স্ত্রী
বার্সাইন একসময় মেমননের স্ত্রী ছিলেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন প্রভাবশালী আর্টাবাজুসের মেয়ে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৩ অব্দে মেমননের মৃত্যুর পর তিনি অনুভব করলেন যে এখন তিনি অন্য কোনো প্রণয়ের সম্পর্কে জড়াতে পারেন। আলেকজান্ডারকে দেখার পর তার মনে হয় তিনিই হতে পারেন তার জন্য সেরা বিকল্প। যেমন প্লুটার্ক লিখেছেন, ‘মনে করা হয়, আলেকজান্ডার তার শত্রুদের ওপর জয়লাভ করার চেয়ে একজন রাজা হিসেবে নিজের আবেগকে বশে রাখাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। তাই একমাত্র বার্সিন ছাড়া বিয়ের আগে তিনি কখনো কোনো নারীর ঘনিষ্ঠ হননি বা অন্য কারো সঙ্গে মেলামেশা করেননি।
গ্রিক ভাড়াটে সেনাপতি মেমননের বিধবা স্ত্রী এ নারী দামেস্কে বন্দি হয়েছিলেন। তিনি গ্রিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন, কোমল স্বভাবের ছিলেন এবং রাজপরিবারের উত্তরাধিকারের দাবি করতে পারতেন। কারণ তার বাবা আরতাবাজাস বিয়ে করেছিলেন পারসিক রাজাদের একজনের মেয়েকে। এ গুণাবলি আলেকজান্ডারকে আরো আগ্রহী করে তোলে। এছাড়া তিনি পারমিনিও দ্বারা উৎসাহিত হয়েছিলেন। তাই অ্যারিস্টোবুলাস আমাদের এমন সৌন্দর্যের ও অভিজাত বংশের কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে বলেছিলেন।’ (প্লুটার্ক, আলেকজান্ডার, ২১)
বার্সাইন সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে আলেকজান্ডারের পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। প্লুটার্কের মতে, আলেকজান্ডার সৌন্দর্যের জন্য বার্সাইনের প্রেমে পড়েছিলেন এবং হেরাক্লেস নামে তাদের একটি পুত্র ছিল। এটি লক্ষণীয় যে মৃত্যুর পর তার একমাত্র স্বীকৃত পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছিল। তাই বার্সাইনের সন্তানের অর্থ হলো আলেকজান্ডার জীবিত থাকাকালীনও তার একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিল।
বার্সাইন ছিলেন এমন একজন নারী, যিনি আলেকজান্ডারের শক্তি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং সম্ভবত তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য তৈরি করার জন্য তার পাশে থাকতে চেয়েছিলেন। তবে বাস্তবে এমনটি হয়ে ওঠেনি। তিনি কেবল আলেকজান্ডারের একজন প্রেমিকা হতে পেরেছিলেন, যদিও তিনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তবে তিনি কোনো রক্ষিতা বা উপপত্নী ছিলেন না।
মেসিডোনীয় রাজার অন্যান্য প্রণয়
উল্লিখিত নারীরা ছাড়াও আলেকজান্ডারের স্বল্পদৈর্ঘ্যের জীবনে আরো কয়েকটি প্রণয় সম্পর্ক ছিল। প্লুটার্কের মতে, তবুও রাজা যথাসম্ভব যত্নশীল হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জানতেন যে অনেক লোক তাকে হত্যা করতে চাইবে এবং প্রণয়ের সম্পর্কগুলোতে মনোযোগ দেয়ার চেয়ে শত্রুদের পরাজিত করতে তিনি অনেক বেশি আগ্রহী ছিলেন। তবে কয়েকজন নারী তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে পারসিক নারীদের সৌন্দর্যে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন এবং তারা ছিল তার দুর্বলতা। এমনকি কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে সুন্দর চোখযুক্ত একজন পারসিক নারী মেসিডোনিয়ার রাজার মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
আলেকজান্ডারের নারীদের মধ্যে ক্যালিক্সেনার কথা উল্লেখ করাও গুরুত্বপূর্ণ, যিনি তরুণ আলেকজান্ডারের প্রথম প্রেমিকা ছিলেন। তিনি তার সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত ছিলেন। তাদের সম্পর্ক তেমন গভীর ছিল না। তবে হবু রাজা এ নারীর সঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছিলেন।
আলেকজান্ডার ও অ্যামাজোনসের রানী থ্যালেস্ট্রিসের প্রেম হলিউডের কোনো চলচ্চিত্র থেকে নেয়া গল্পের মতো শোনায়। কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলে হিরকানিয়ায় তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। এটি খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দের শরত্কাল ছিল এবং তিনি রাজার সঙ্গে দেখা করতে ২০০ বা ৬০০ মাইল ভ্রমণ করেছিলেন, যিনি এরই মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। সাক্ষাতের নির্দিষ্ট স্থান সম্পর্কে সূত্রগুলো পরিষ্কার তথ্য দিতে পারে না। থ্যালেস্ট্রিসের সঙ্গে কোথায় কথা হয়েছিল সেটিও অজানা।
কোনো কোনো সূত্র থেকে জানা যায়, এটি কৃষ্ণ সাগরের কাছাকাছি কোনো জায়গা ছিল। যেখানেই এটি হয়ে থাকুক, থ্যালেস্ট্রিস যখন আলেকজান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন তার দেহ পুরোপুরি পোশাকে আবৃত ছিল না। তিনি অ্যামাজোনাস সংস্কৃতির একটি পোশাক পরেছিলেন। তাই তার বুকের বাম দিকটি উন্মোচিত ছিল। তিনি আলেকজান্ডারের চোখে একজন যৌনাবেদনময়ী নারী হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিলেন। আলেকজান্ডার তার শক্তি ও ক্ষমতা দেখে অবাক হয়েছিলেন। দম্পতি হিসেবে তারা ১৩ দিন একসঙ্গে কাটিয়েছিলেন। যা-ই হোক, এ সংক্ষিপ্ত প্রণয়ের পর তাদের সম্ভবত আর কখনো দেখা হয়নি। তবে এটাও বলে রাখা ভাল এই অ্যামাজোনাস রানীর সঙ্গে আলেকজান্ডারের সাক্ষাতের বিষয়টি পৌরাণিক গাথার মতো, ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই করা নয়।
রাজার পেছনের ক্ষমতাবান নারীরা
ইতিহাসে এমন আরো কয়েকজন নারীর নাম পাওয়া যায়, যারা আলেকজান্ডারের প্রেমিকা বা স্ত্রী হতে পারেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন রানী ক্লিওফিস, যিনি ক্যানড্যান্স নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি বর্তমান পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের একটি প্রাচীন রাজ্যের রাজধানী ম্যাসাগার রানী ছিলেন।
আলেকজান্ডারের জীবনে প্রিন্সেস স্ট্যাটিরা নামে পরিচিত এক নারী ছিলেন (প্রাক্তন মহান রাজা তৃতীয় দারিয়ুসের কন্যা), যাকে বার্সিন বা আরসিনো নামেও উৎসে উল্লেখ করা হয়েছে। আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দের ফেব্রুয়ারিতে তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। একই দিন তিনি পারসিক রাজা তৃতীয় আর্টাজারেক্সের কন্যা প্যারিসাটিসকে বিয়ে করেছিলেন। আলেকজান্ডারের জীবনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার অজুহাতে স্ট্যাটিরা ও প্যারিসাটিস দুজনকেই রোক্সানা খুন করেছিলেন। এটা স্পষ্ট যে আলেকজান্ডার তার কৌশল ও পরিকল্পনাগুলোতে তাদের জ্ঞান ব্যবহার করতেন।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ছিলেন নারীদের প্রিয় পুরুষ। দুর্ভাগ্যক্রমে যে নারীরা তার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন, তাদের বেশির ভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। আলেকজান্ডার ৩৩ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন, তাকে যে নারীরা তাদের মন, প্রাণ, সৌন্দর্য দিয়ে সেবা করেছিলেন তারাও কেউ দীর্ঘজীবী হতে পারেননি।
আপনার মতামত জানানঃ