বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের প্রচারণা জোরালো হচ্ছে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং দেশের ভিতরে কিছু বিরোধী পক্ষ থেকে তা আলিঙ্গন করায় এর গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ মাসের শুরুর দিকে বিতর্কিত একপক্ষীয় নির্বাচন সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ।
এ নির্বাচন বর্জন করেছে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। অন্যদিকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকার প্রতি জোর দিয়ে আহ্বান জানিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে এ নির্বাচনকে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিহিত করেছে। একই সময়ে অনেকেই বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ভারতের সাধারণভাবে ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অমসৃণ। এক্ষেত্রে নয়া দিল্লি তার পছন্দ বেছে নিয়েছে।
‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন হিটস আপ ইন বাংলাদেশ আফটার লুপসাইডেড ইলেকশন- শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছে অনলাইন নিক্কেই এশিয়া। এতে সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম লিখেছেন, এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারত বিরোধিতা গতি পাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক। কেউ কেউ #ইন্ডিয়াআউট হ্যাসট্যাগ ব্যবহার করছেন। গত বছর মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়।
তাতে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজু। সেখানে যেমন ভারতের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গতি পেয়েছে, বাংলাদেশেও একই অবস্থার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট মুইজু ১৫ই মার্চের মধ্যে ভারতীয় সেনাদেরকে ভারতে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তার দেশের কূটনীতি ঝুঁকে পড়ছে চীনের দিকে।
এ বিষয়ে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো জবাব দেয়নি। বাংলাদেশের এই আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন চিকিৎসক পিনাকী ভট্টাচার্য। সরকারের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানির মুখে তিনি ২০১৮ সালে দেশ ছাড়েন। মধ্য জানুয়ারিতে তিনি চালু করেন #বয়কটইন্ডিয়া হ্যাসট্যাগ। ফেসবুকে তার আছে প্রায় ৫ লাখ অনুসারী। তাদেরকে তিনি বলেছেন, আমাদের প্রত্যেকে, যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, এই স্বারক উদ্যোগের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে আহ্বান জানাই। আমাদের সম্মিলিত সংকল্প, অটল সিদ্ধান্ত এবং আমাদের মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালবাসা উদ্বীপিত করে। তা আমাদের আবদ্ধ সব শৃঙ্খলকে ভেঙে দেবে।
হাজার হাজার মানুষ তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা এই বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ ভারতীয় পণ্যের ছবির ওপর ‘ক্রস’ (কাটা চিহ্ন) ব্যবহার করছেন।
প্রতি বছর বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৪০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ভারত। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য নয়া দিল্লির ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল ঢাকা। দুই দেশের সরকার ভারতীয় খামারে উৎপাদিত পণ্যের বার্ষিক কোটা নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছে। তাই ব্যাপকভাবে বর্জনের ফলে দুই দেশের সম্পর্কে বড় রকম বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ২২৩টি আসনে আওয়ামী লীগের জয়ের পর ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্বাচনের অন্য প্রার্থীদের বেশির ভাগকেই স্বতন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনকে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে চেয়েছে। এর সঙ্গে ছিল জাতীয় পার্টি, তারা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে মিশে আছে।
নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন খাত্রা মিডিয়াকে বলেছিলেন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মান দেখাই। দেশটিকে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ এবং প্রগতিশীল হিসেবে দেখতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা অব্যাহতভাবে সমর্থন করি।
নির্বাচনের ফল প্রকাশ হওয়ার পর পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে পশ্চিমা সরকারগুলো ছিল কঠোর সমালোচনামূলক। সফলভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে নির্বাচন পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতকে ‘মহান বন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ভারতবিরোধিতা শুরু হয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের সঙ্গে যুক্ত উদীয়মান রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদ (ভারতীয় পণ্য) বর্জন অনুমোদন করেছে। ঢাকায় গত সপ্তাহে এক র্যালিতে দলটির প্রধান নূরুল হক নূর বলেছেন, জনগণ দেখেছে আমাদের গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিভাবে হস্তক্ষেপ করেছে ভারত। আমাদেরকে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা শুরু করতে হবে সবাইকে।
ভারতীয় প্রকাশনাগুলো লক্ষ্য করেছে এবং কোনো কোনো মাধ্যম রিপোর্ট করেছে যে, এই প্রচারণায় বিএনপির হাত আছে। এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। তবে ভারত বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন। রিজভী বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু, রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়ে এবং গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নয়া দিল্লি যে ভূমিকা পালন করেছে তা নিয়ে জোর গলায় কথা বলছে বিএনপি। তিনি বলেন, এখনও দলের হাই কমান্ড ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়ে আলোচনা করেনি এবং ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণায় সমর্থন দেয়নি।
বিএনপির একটি সাব-ডিস্ট্রিক্ট ইউনিটের প্রেসিডেন্ট মীর শাহি আলম (বর্জনের) ধারণাকে সমর্থন করেছেন। তিনি এক মিটিংয়ে বলেছেন, ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে হবে আমাদের। আমরা ভারতীয় পণ্য কিনবো না এবং আমাদের আত্মীয়দেরকেও তা না কিনতে অনুরোধ করবো।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশি পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভ রয়েছে বাংলাদেশিদের মধ্যে। গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার কাছে যখন ভারত হেরে যায়, তখন স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দ প্রকাশ করেন বাংলাদেশিরা। এটা শুধু ক্রিকেটে পরাজিত হওয়ার কারণে নয়।
বহুবিধ কারণে ভারতের বিরুদ্ধে এমন ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বৈষম্যমূলকভাবে ভারতই বেশি সুবিধা পাচ্ছে বলে তিনি যুক্তি তুলে ধরেন। বিরোধীদের দমনপীড়নে আওয়ামী লীগকে উৎসাহিত করেছে নয়া দিল্লি। তিনি আরও বলেন, জনগণ বিশ্বাস করেছে যে- ভারতের সমর্থন পেয়ে ‘সাজানো একটি নির্বাচনে’ গিয়েছে ক্ষমতাসীন দল।
রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক আবু রুশদ সম্পাদনা করেন বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল। তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ভারতের যুক্ত থাকায় গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়েছে বহু বাংলাদেশির মধ্যে। এ কারণে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। কিন্তু এবার জনগণ আশা করেছিল যে, ভারত সরকারের বোধোদয় হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমর্থন দেবে।
কারণ, ভারত হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। পক্ষান্তরে প্রচ্ছন্নভাবে এমনকি প্রকাশ্যে ভারত ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ নিয়েছে এবং তারা একটি ভুয়া নির্বাচনের জন্য চাপ দিয়েছে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক দিয়ে এই বর্জনের ডাক যৌক্তিক নাও হতে পারে। কিন্তু ভারত কর্তৃপক্ষকে বার্তা দেয়ার অবশ্যই এটি একটি উত্তম উপায়।
আপনার মতামত জানানঃ