গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।
নিহত ওই ব্যক্তি হরদীপ সিং নিজ্জার। কানাডা পুলিশ বলছে, নিখিলের বেশ কয়েকজন টার্গেটের মধ্যে হরদীপ একজন। কারণ নিখিল তাঁর সেই পরিচিতজনকে লিখেছিলেন, ‘আমাদের অনেক টার্গেট রয়েছে।’
মার্কিন কৌঁসুলিদের মতে, নিখিল নিউইয়র্কভিত্তিক আইনজীবী এবং শিখস ফর জাস্টিস সংগঠনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে মার্কিন গোয়েন্দাদের তৎপরতায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন, শিখস ফর জাস্টিসের দুই নেতা পান্নুন এবং নিজ্জার স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সপক্ষে বৈশ্বিক গণভোট আয়োজনে কাজ করছিলেন। এ কারণেই তাঁদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, এই গণভোটের মাধ্যমে পাঞ্জাবকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টি করা।
কানাডা এখনো নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও, নিখিলকে গত জুনে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কে দাখিল করা একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, নিখিল পান্নুনকে হত্যার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চালচক্রে ভাড়াটে খুনি খুঁজতে গিয়ে মার্কিন পুলিশেরই এক সোর্সকে ১ লাখ ডলার দিয়েছিলেন তিনি।
এই অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে ভারত এমন একটি ক্লাবের সদস্য হয়ে উঠবে যারা আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে গুপ্তহত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে ফের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরুর ইঙ্গিত মিলছে, যে চর্চাটি দীর্ঘকাল ধরে শুধু বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যেই ছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে বিরোধীদের গুপ্তহত্যার অভিযোগ রয়েছে। বিদেশের মাটিতে ভারত সরকারের গুপ্তহত্যার লক্ষ্য পাকিস্তান অনেক আগে থেকেই ছিল। সম্প্রতি শিখ নেতা নিজ্জার হত্যার ঘটনার পর ভারতের বিরুদ্ধে সেই সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যার রেকর্ড সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলের। হামাসের সিনিয়র নেতাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে দেশটি গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা নতুন করে সাজাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যেই হামাসের অন্তত তিনজন সিনিয়র নেতাকে গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকলে, কোনো নিন্দা না হলে, বিচার না হলে এটি বাড়বে। এগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ও স্থায়ীকরণের উপাদান।’
সৌদি আরবের গুপ্তহত্যার তদন্তকারী কমিটির নেতৃত্বদানকারী ক্যালামার্ড বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে লক্ষ্যবস্তু করা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো আমাদের আরও খারাপ দুনিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
আন্তর্জাতিক আইনে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা নিঃসন্দেহে বেআইনি। আর কূটনৈতিক কনভেনশন অনুযায়ী এটি আরও বড় অপরাধ, যা যুদ্ধের সমতুল্য।
এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পরিণতি নিয়ে ভয় এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ–সুবিধা সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে বিংশ শতকের বেশির ভাগ সময় বেশির ভাগ দেশ গুপ্তহত্যা থেকে বিরত ছিল। এরপরও যেসব দেশ জড়িয়েছে, তারা অভ্যন্তরীণ আইন মেনে কাকে, কখন, কোথায় এবং কীভাবে হত্যা করতে হবে তা নির্ধারণ করেছে।
গুপ্তহত্যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র
স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বের দুটি পরাশক্তি গুপ্তহত্যায় জড়িয়েছিল, যদিও খুবই ভিন্ন উদ্দেশ্যে। ১৯৬৪ সালের সিআইএ মেমো রিপোর্ট বলছে, সোভিয়েতরা গুপ্তহত্যার টার্গেট করত কেবল সেই ব্যক্তিদের যারা কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক এবং যাদের কোনোভাবেই অপহরণ করা যায় না।
সাধারণভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তহত্যা নিজ দেশের সেসব নাগরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যারা বিদেশ থেকে সোভিয়েত শাসনের সমালোচনা করছিল। ১৯৪০ সালে মেক্সিকো সিটির একটি বাড়িতে লিওন ট্রটস্কিকে বরফ ভাঙার সুচ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবে ক্রেমলিনের শত্রুদের দেশে এবং বিদেশের মাটিতে অপহরণ বা হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতিক্রমও করেছে: জার্মান আইনজীবী ওয়াল্টার লিন্সকে মার্কিন–অধিকৃত বার্লিন থেকে অপহরণ এবং ১৯৫৩ সালে হত্যা করা হয়েছিল।
আমেরিকার বিশ্ব নেতাদের খুনের তালিকায় রাখার প্রবণতা রয়েছে। ২০০৭ সালে সিআইএর কুখ্যাত গুপ্তহত্যার তথ্য ফাঁস হয়, এই নথি ‘ফ্যামিলি জুয়েলস’ নামে বিখ্যাত। সেখানে দেখা যায়, বিদেশি কমিউনিস্ট নেতাদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু করেছে সিআইএ। এর মধ্যে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার অসংখ্য পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে।
এ ছাড়া সিআইএর হত্যার তালিকায় ছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এনগো দিন দিম এবং কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা। তবে সিআইএ তাঁদের হত্যা করার আগেই মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থানে তাঁরা নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ডের গোপন নথি প্রকাশ পেলে মার্কিন সিনেটে ‘চার্চ কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।
তদন্ত শেষে কমিটি জানায়, যুদ্ধের অংশ হিসেবে হলেও ‘গুপ্তহত্যা’ আমেরিকান নীতি, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বৈদেশিক নীতির হাতিয়ার এটি হতে পারে না, একে প্রত্যাখ্যান করা উচিত।
এরপর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৬ সালে একটি নির্বাহী আদেশে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হন এবং আইন পাস করেন।
গুপ্তহত্যায় ইরান ও উত্তর কোরিয়া
গুপ্তহত্যার বেশির ভাগই করেছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। ব্যতিক্রম হিসেবে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে বিদেশের মাটিতে প্রায় দুই ডজন গুপ্তহত্যার পেছনে ইরানকে দায়ী করা হয়। এসবের কিছু ফলও ভোগ করতে হয়েছে তেহরানকে।
১৯৮০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ারকে হত্যাচেষ্টার জন্য গ্রেপ্তার হওয়া ইরানের একটি হিট স্কোয়াডকে ক্ষমা করে দেয় ফ্রান্স। ইরান এক দশক পরে প্যারিসে বখতিয়ারকে শেষমেশ হত্যা করেই ছাড়ে।
নিউইয়র্ক সিটিতে নির্বাসিত ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী মাসিহ আলিনেজাদ অন্তত দুটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষের মতে, ইরানের ভাড়াটে বন্দুকধারীরা ২০২১ সালে তাঁকে আটক করে ইরানে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তা ব্যর্থ করে দেয়। ২০২২ সালে এই লেখককে হত্যার উদ্দেশ্যে আরেকটি দল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এবারও তারা পুলিশের হাতে আটক হয়।
গত বছরের হ্যালিফ্যাক্স আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ফোরামে আলিনেজাদ বলেন, যে লোকটিকে আসলে ব্রুকলিনে আমার বাড়ির সামনে থেকে একে–৪৭ বন্দুকসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি আগে ইউরোপের একটি অপরাধী চক্রের অংশ ছিলেন। সুতরাং বাস্তবতা হলো—স্বৈরাচারীরা কেবল নিজ দেশের লোকদেরই নয়, সীমানার বাইরের লোকদেরও নিপীড়ন করতে তারা একে অপরকে সাহায্য এবং সমর্থন করছে।
উত্তর কোরিয়া গুপ্তহত্যায় উচ্চাভিলাষী হলেও ততটা চতুর নয়। ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং–হিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ব্লু হাউসে’ ব্যর্থ হামলা চালায়। ১৯৯৭ সালে কিম জং ইলের ভাতিজা ই হান–ইয়ংকে হত্যার পেছনেও পিয়ংইয়ংকে দায়ী করা হয়।
২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সৎ ভাই কিম জং নাম কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মারাত্মক স্নায়ুগ্যাসে আক্রান্ত হন। ধারণা করা হয়, পিয়ংইয়ং এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে।
৯/১১ ও যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তহত্যার নতুন যুগ
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একবিংশ শতাব্দীতে সিআইএ এখন আর গুপ্তহত্যার অভিযানকে অগ্রাধিকার দেয় না। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আরও বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এখন গুপ্তহত্যার সংস্কৃতি আর নেই বলেই মনে হচ্ছে।
এখন স্নায়ুযুদ্ধ না থাকলেও অনেক কিছুই বদলেছে। ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং ৯/১১ হামলা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা করেছে।
নাইন–ইলেভেনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘সমস্ত প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত শক্তি’ ব্যবহারের জন্য মার্কিন কংগ্রেস ২০০১ সালে একটি তালিকা অনুমোদন করে। এরপর ২০১১ সালের অপারেশনে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা এবং ২০২০ সালে ড্রোন হামলায় ইরাকে ইরানের সামরিক কমান্ডার কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।
গুপ্তহত্যা এখন চলছে আকাশপথে, ফলে খুনিদের ঝুঁকি কমেছে। আইনে এখনো এসব হত্যাকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মার্কিন ড্রোন কর্মসূচির ফাঁস হওয়া নথিতে অনেক কিছু বেরিয়ে এসেছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার বিশ্লেষক ড্যানিয়েল হেল স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টকে এসব নথি দেন। নথিতে দেখা যায়, মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে কমপক্ষে নয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টার্গেট করেছে।
সামরিক অভিযানের আওতায় একই ধরনের ড্রোন কর্মসূচি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়ায় সবচেয়ে বেশি মার্কিন ড্রোন হামলা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দাবি করে, এসব আক্রমণ হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, এগুলো সামরিক শক্তির বৈধ ব্যবহার, যা ২০০১ সালের কংগ্রেসে অনুমোদিত।
সবাইকে ছাড়িয়ে ইসরায়েল
তবে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির অজুহাতে সবচেয়ে বেশি গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনি নেতা এবং নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যা করেছে। কিন্তু ইসরায়েল সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মাটিতে এসব করে না। তবে ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ মিউনিখ গেমসের সময় ইসরায়েলি অলিম্পিক দলের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
এরপরে একটি ইসরায়েলি গোষ্ঠী মিউনিখ হামলার সঙ্গে জড়িত প্রায় দুই ডজন ফিলিস্তিনি নেতাকে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা করে বলে মনে করা হয়। ইউরোপের মাটিতে খুন না করার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ইসরায়েল ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস এবং অন্যান্য দেশে এসব হত্যাকাণ্ড চালায়।
ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন গোয়েন্দা ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট: দ্য সিক্রেট হিস্টরি অব ইসরায়েলস টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশন’—এর লেখক রনেন বার্গম্যানকে বলেন, এসব খুনের ঘটনাগুলো ধোঁয়াশাপূর্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুপ্তহত্যা চালানো আসলেই ভয় উদ্রেককারী। ইসরায়েল এসবের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও, এটি সত্য যে, একজন ইসরায়েলিই সেই বন্দুকের ট্রিগার চেপেছে।
ইসরায়েলের নতুন গুপ্তহত্যা অভিযানের লক্ষ্য হয়েছে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের নেতারা। ২০০৪ সালে দেশটি হামাস নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যার জন্য একটি হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠায় ইসরায়েল। এই অভিযানে নয়জন পথচারী নিহত হয়। এই হত্যাকাণ্ড জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়।
অতি সম্প্রতি, দখলদার দেশটি ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের নির্মূল করার জন্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনাকে প্রসারিত করেছে, এমনকি যারা তেহরানের অস্ত্র কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না তাঁদেরও হত্যা করেছে।
তবে ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট’ বইটিতে বার্গম্যান ইসরায়েলের টার্গেটেড কিলিং প্রোগ্রাম এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্যে একটি ফারাক দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এখন যেসব কমান্ড–অ্যান্ড–কন্ট্রোল সিস্টেম, যুদ্ধকক্ষ, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি এবং পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন আমেরিকা এবং মিত্রদের সেবা দেয়; সবই ইসরায়েলে বিকশিত হয়েছে।’
বার্গম্যান অনুমান করেন, ২০০০–এর আগের দশকগুলোতে ইসরায়েল প্রায় ৫০০টি গুপ্তহত্যা করেছে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় নিয়ে বার্গম্যান লিখেছেন, এই সময় সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ পর্যন্ত কমপক্ষে আরও ৮০০টি অপারেশন হয়েছিল। সেই হাজার হাজার গুপ্তহত্যার অভিযানে টার্গেট ও অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যুদ্ধোত্তর সময়ে ইসরায়েল আবারও এসব গুপ্তহত্যা কর্মসূচি বাড়াতে চায়। গাজার বাইরে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে—সম্ভবত কাতার বা অন্য কোথাও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমরা তথাকথিত সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা প্রায় স্বাভাবিক করে ফেলেছি। এটিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে আংশিক ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনোভাবেই বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করা যায় না।’
গত ২ জানুয়ারি লেবাননের বৈরুত শহরতলিতে একটি হামাসের অফিসে ড্রোন হামলায় গোষ্ঠীটির সিনিয়র নেতা সালেহ আল–আরৌরি নিহত হন। ওই হামলায় হামাসের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
গুপ্তহত্যার বিশ্বমঞ্চে পুতিন
বিশ্ব রাজনীতিতে আরেক যুগের সূচনা হয় ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতায় আরোহণের মধ্যে দিয়ে। তাঁর নেতৃত্বে মস্কো বিদেশে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যার সোভিয়েত রীতি বজায় রেখেছে। তবে মস্কো যেসব অঞ্চলকে জাতিগত এবং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ বলে মনে করে, এমন প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিকদেরও টার্গেট করছে।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পুতিনের কৌশলগুলো ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। ২০০৬ সালে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে দলত্যাগী আলেক্সান্ডার লিৎভিনেঙ্কো এবং সাবেক ডবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালের বিষক্রিয়া এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
কিন্তু রাশিয়া এটাও প্রমাণ করেছে যে, খুনের কালিমা থেকে রেহাই পাওয়া কতটা সহজ! স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টার ঘটনায় বেশ কিছু নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লেও ২০১৭ সালে বাজফিড নিউজের তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গোপনে বিশ্বাস করেছিল, রাশিয়া অগণিত গুপ্তহত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু যেসবের জন্য মস্কোকে সরাসরি অভিযুক্ত ও তিরস্কার করা হয়নি।
উন্নত গোয়েন্দা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকলেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের জন্য গ্রেপ্তার তেমন নেই। সন্দেহ রয়েছে, এই দেশগুলো পশ্চিমা তদন্তকারীদের এড়াতে কৌশল এবং তথ্য বিনিময় করছে।
গুপ্তহত্যায় সৌদি আরব ও পাকিস্তান
এমনকি যে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতি রক্ষা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক ব্লগার জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পেছনে রিয়াদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সিআইএ ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে খাশোগি হত্যার জন্য সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে ১৫ জনের হিট স্কোয়াডকে দায়ী করেছে। এরপরেও এখনো ট্রাম্প নির্বিকার স্বরে বলেন, ‘হয়তো তিনি করেছেন, হয়তো করেননি।’
বিচারবহির্ভূত বা নির্বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে জাতিসংঘের তৎকালীন বিশেষ র্যাপোর্টার ক্যালামার্ড সৌদি আরবকে জবাবদিহি করতে বিশ্বের ব্যর্থতার নিন্দা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর ও রিপোর্টের চার বছর পর ক্যালামার্ড বলেন, সামান্য পরিবর্তন হয়েছে এবং তবে বিচারের পথ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধই রয়েছে।
পাকিস্তানও এই কাণ্ডে সমানভাবে দায়ী হতে পারে। দরিদ্র পাকিস্তানি প্রদেশ বেলুচিস্তানের একজন মানবাধিকার আইনজীবী কারিমা বালুচকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টরন্টোতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কানাডার পুলিশ বলেছে, পাকিস্তানের যোগসাজশের কোনো প্রমাণ নেই, তবে তাঁর পরিবার আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি করেছে। এ ছাড়া আইনজীবীরা কয়েক মাস আগে সুইডেনে নির্বাসিত পাকিস্তানি সাজিদ হোসেনের মৃত্যুর সঙ্গে আগের ঘটনার মিল আছে বলে দাবি করেছেন।
গুপ্তহত্যা ক্লাবের নতুন মুখ ভারত
বিচার প্রক্রিয়ার অভাবে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষার হর্তাকর্তারা বৈদেশিক নীতিকে এগিয়ে নিতে গুপ্তহত্যা অব্যাহত রেখেছে। হত্যাকারী দেশগুলোর ক্লাবে নতুন সদস্য যোগ হচ্ছে। সেই ক্লাবে ভারতকে নতুন সদস্য বলে মনে হচ্ছে। কানাডায় নিজ্জার হত্যা এবং নিউইয়র্কে পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা ছাড়াও পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, ইন্টারসেপ্টের প্রাপ্ত নথি অনুসারে, ভারত অন্তত দুই পাকিস্তানি বাসিন্দাকে টার্গেট করেছে। একটি পৃথক ভারতীয় মেমো বলছে, কথিত রয়েছে, পশ্চিমে ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো এই ‘অত্যাধুনিক ক্র্যাকডাউন স্কিম’ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে।
এদিকে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে এমন প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশে দেশটির সমালোচকদের ওপর নজরদারি ও চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বাড়িয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ