ভারতে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় আগামী সোমবার (২২ জানুয়ারি) নবনির্মিত সুবিশাল রামমন্দিরে মহাসমারোহে যে বিগ্রহের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ হতে যাচ্ছে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সেরকম জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন খুব কমই হয়েছে।
পাশাপাশি এটাও বলার, ওই প্রাচীন নগরীতে ওই মাত্র কয়েক একর জমি এবং তার ওপর এক সময় বহুকাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ধর্মীয় কাঠামো যেভাবে ‘বিতর্কিত কাঠামো’ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গোটা দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে সুদীর্ঘ উথালপাথাল ফেলেছে ভারতে তার কোনও দ্বিতীয় তুলনা নেই।
এ দেশে পর্যবেক্ষকরা সবাই প্রায় একবাক্যে বলে থাকেন বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনা যেমন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ভিতেই সমূলে আঘাত করেছে, তেমনি রামমন্দির আন্দোলনের সূত্রেই দেশের শাসনক্ষমতায় হিন্দুত্ববাদী শক্তির আসার পথ প্রশস্ত হয়েছে।
অথচ সাতচল্লিশে দেশের স্বাধীনতার কিছুদিন পর থেকেই পরবর্তী প্রায় চার দশক ধরে ‘বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি’ নামে পরিচিত এই উপাসনালয়ে কোনও ধর্মের মানুষেরই প্রবেশাধিকার ছিল না– কারণ অযোধ্যায় মূল ভবনটি সরকার তালাবন্ধ করে রেখেছিল।
যেখানে মুসলিমরা এক সময় নিয়মিত নামাজ পড়তেন সেই মসজিদে হঠাৎ কেন তালা ঝোলাতে হলো এবং তার প্রায় ৩৭ বছর পর কেন হঠাৎ সেই তালা খুলে দিয়ে মন্দিরের ‘শিলান্যাস’ করতে দেওয়া হলো– সেই কাহিনি কোনও সাসপেন্স থ্রিলারের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়!
কাকতালীয়ভাবে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর নির্দেশেই অযোধ্যার ওই বিতর্কিত কাঠামো সিলগালা করা হয়েছিল। আর সেই তালা যখন খোলা হয়, তখন দেশের ক্ষমতায় তারই দৌহিত্র বা নাতি রাজীব গান্ধীর সরকার।
আর অযোধ্যায় এই পটপরিবর্তনকে রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে সবচেয়ে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছে দেশের যে দলটি, তারা নিঃসন্দেহে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। সেই কাজে তাদের সাহায্য করেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরং দলের মতো সহযোগী সংগঠন।
১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যে বিজেপি-র মাত্র দু’জন এমপি ছিলেন, সেখান থেকে মাত্র পাঁচ বছর পরেই গোটা দেশে তাদের আসনসংখ্যা বেড়ে হয় ৮৬। আর ২০১৪ সালের মধ্যেই তারা ২৮২টি আসনে জিতে একার শক্তিতে সরকার গড়ার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে।
এই চমকপ্রদ রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে রামমন্দির আন্দোলনের এবং সেই সঙ্গে দলের প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডভানির নেতৃত্বে ‘রথযাত্রা’র যে একটা বিরাট ভূমিকা আছে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সবাই তা মানেন।
পাশাপাশি এই হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনে কংগ্রেসের দ্বিধান্বিত ভূমিকার জন্যই যে তারা ভারতে তাদের মুসলিম জনসমর্থন অনেকটা হারিয়েছে তা নিয়েও বিশেষ সংশয় নেই। ভারতের মুসলিম সমাজ ক্রমশ ভরসা হারিয়েছেন তাদের এক সময়ের প্রিয় দলের ওপর।
ভারতের হিন্দি বলয়ে, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে কংগ্রেসের প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পেছনেও এটা একটা বড় কারণ বলে মনে করা হয়। আর পরিসংখ্যান বলে, দেশের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে জিততে না পারলে ভারতে কোনও দলের পক্ষেই দেশের ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়।
অথচ ভারতের বর্তমান লোকসভায় উত্তরপ্রদেশের মোট ৮০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেসের ঝুলিতে আছে মাত্র একটি, যেটি সোনিয়া গান্ধীর আসন রায়বেরিলি।
এই যে ভারতের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ গত তিরিশ-চল্লিশ বছরের মধ্যে আমূল বদলে গেছে তার পেছনে অবশ্যই আরও নানা ফ্যাক্টর আছে – কিন্তু বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি ইস্যুটাই সম্ভবত এই পরিবর্তনের পেছনে এককভাবে সবচেয়ে বড় কারণ।
ঠিক কীভাবে ধাপে ধাপে ভারতের রাজনীতিতে এই মোড়-ঘোরানো মুহূর্তটা এল এবং তাতে অযোধ্যার ঠিক কী ভূমিকা ছিল, এই প্রতিবেদন ফিরে তাকিয়েছে সে দিকেই!
রামলালার ‘আবির্ভাব’ ও তালাচাবি
হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণে ভগবান রামচন্দ্রের জন্মস্থান হিসেবে যে অযোধ্যা নগরীর উল্লেখ আছে, সরযূ নদীর তীরে সেই শহরেই শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে ছিল এই বিতর্কিত ধর্মীয় স্থান। ছিল বলতে হচ্ছে, কারণ ১৯৯২ সালে সেই কাঠামোটি ভেঙে ফেলে উন্মত্ত করসেবকরা।
ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের একজন সেনাপতি মীর বাকি ১৫২৯ সালে রাম জন্মভূমি ভেঙে ফেলে সেই জায়গায় ‘বাবরি মসজিদ’ তৈরি করেন, এমনটাই প্রচলিত ধারণা। যদিও এটা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।
এমন কী বাবর নিজে কখনো আদৌ অযোধ্যাতে এসেছিলেন কি না, সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তার অত্যন্ত সুলিখিত আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’তে জীবনের বহু ছোটখাটো ঘটনার বিবরণ থাকলেও অযোধ্যার কোনও উল্লেখ নেই।
তবে তিনটে গম্বুজওলা ওই মসজিদ যে শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান ভেঙেই তৈরি হয়েছে, সে কথা হিন্দুদের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করতেন বহুকাল ধরেই। তারা বলতেন, মসজিদের ভেতরে থাকা একটা উঁচু বেদীর মতো অংশেই রাম ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন।
১৮৮৫ সালে হিন্দু সন্তদের নেতা মহন্ত রঘুবীর দাস ওই মসজিদ লাগোয়া উঠোনে (‘চবুতরা’) রামমন্দির নির্মাণের অনুমতি চেয়ে ফৈজাবাদ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে মামলা করেন।
তিনি একই দাবি জানান ব্রিটিশ শাসিত ভারতের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ফর ইন্ডিয়ার কাছেও। আদালত তার আবেদন নাকচ করে দিলেও ওই জমির ওপর হিন্দুদের অধিকারের দাবি কিন্তু থিতিয়ে যায়নি। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাও ছিল পুরো মাত্রায়।
ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার ঠিক বছরদুয়েকের মাথায় ওই মসজিদের ভেতরে হঠাৎ একদিন সকালে রহস্যময়ভাবে ‘রামলালা’র (শিশু রামচন্দ্র) মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। তারিখটা ছিল ২২শে ডিসেম্বর, ১৯৪৯ মধ্যরাতের পর।
স্থানীয় মুসলিমরা অবশ্য অভিযোগ করেন রাতের অন্ধকারে গোপনে মসজিদের ভেতরে ওই মূর্তিটি রেখে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু রামলালার ‘আবির্ভাবে’র খবর ততক্ষণে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ ওই মসজিদে এসে শ্রীরামের ভজন-পূজন শুরু করে দিয়েছেন – শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষকে সেখানে নামাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে।
গবেষক ও লেখক অরিন্দম সেন অবশ্য জানাচ্ছেন, রহস্য-ফহস্য কিছু নয় – খুব কৌশলে পরিকল্পনা এঁটেই মসজিদের ভেতরে ওই মূর্তি নিয়ে আসা হয়েছিল।
‘মন্দির বিতর্কের পাঁচ দশক’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “কথিত আবির্ভাবের ঠিক আটদিন আগে থেকে অযোধ্যায় শুরু হয়েছিল রামনাম সংকীর্তন। বলা হয়েছিল, আটদিন সংকীর্তনের শেষে নাকি শ্রীরামচন্দ্র অবির্ভূত হবেন।”
“বাস্তবেও ঠিক সেটাই হলো– আর কোথায় তিনি আবির্ভূত হলেন? একেবারে সোজা মসজিদের ভেতরে!”
‘উদ্ধারক বাবা’
‘অযোধ্যা – দ্য ডার্ক নাইট’ নামের গ্রন্থেও ১৯৪৯ সালের ২২/২৩ ডিসেম্বর রাতের সেই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের পূর্বাপর বর্ণনা করেছেন অনুসন্ধানী দুই লেখক, কৃষ্ণা ঝা ও ধীরেন্দ্র কুমার ঝা।
তাদের গবেষণা বলছে, রামলালার আবির্ভাবের পরদিন স্থানীয় থানায় যে এফআইআর দায়ের হয়, তাতে মসজিদের ভেতরে ঢুকে মূর্তি রেখে আসার জন্য মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল অভিরাম দাস নামে এক তরুণ হিন্দু সন্ন্যাসীকে।
প্রমাণের অভাবে তার কোনও সাজা হয়নি, কিন্তু লোকের মুখে মুখে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘রামজন্মভূমি উদ্ধারক’ বা ‘উদ্ধারক বাবা’। অযোধ্যার ‘হৃত গৌরব’ যে তিনিই উদ্ধার করেছেন, তা নিয়ে সন্ত সমাজ ও স্থানীয় হিন্দুদের কোনও সংশয় ছিল না।
মূর্তি আবির্ভূত হওয়ার সেই ঘটনার ঠিক বত্রিশ বছর বাদে অভিরাম দাস যখন প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে প্রয়াত হন, তখন অযোধ্যায় সরযূ নদীতে জলসমাধির সময়ও মুর্হুর্মুহু আওয়াজ উঠেছিল, ‘রামজন্মভূমি উদ্ধারক অমর রহে’!
তবে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় মসজিদের ভেতর থেকে রামলালার বিগ্রহ কিন্তু সরানো যায়নি। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৪৫ ধারা অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ গোটা কাঠামোটি ‘বিতর্কিত স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করে প্রবেশপথে তালা ঝুলিয়ে দেয়।
সেই ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৯২ সালে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা পর্যন্ত বাবরি মসজিদে আর কখনও নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
সমকালীন ঐতিহাসিকরা অনেকেই বলেন, সদ্যস্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল – দুজনেরই কিন্তু ইচ্ছে ছিল মসজিদের ভেতর থেকে রামলালার মূর্তিটি সরিয়ে ফেলা হোক।
কিন্তু উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী ও প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ নেতা গোবিন্দবল্লভ পন্থের জন্য তা সম্ভব হয়নি।
তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, রামলালার মূর্তি সরালে রাজ্যের হিন্দুরা ক্ষুব্ধ হবেন এবং দু’বছর পরের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসকে তার ফল ভুগতে হবে।
তালার ক্ষমতা আর ‘ঐশ্বরিক’ হনুমান
বিতর্কিত ওই স্থানে রামলালার পূজা করার অনুমতি চেয়ে বা ওই জমির দখল চেয়ে হিন্দু গোষ্ঠীগুলি ইতিমধ্যে একের পর এক মামলা করেছে, তবে তালা ঝোলানোর পরবর্তী সাড়ে তিন দশক অযোধ্যা ও লাগোয়া ফৈজাবাদে মোটামুটি শান্তি বজায় ছিল।
১৯৫৯ সালে তৃতীয় হিন্দু গোষ্ঠী হিসেবে নির্মোহী আখড়া জমির দখল চেয়ে ফৈজাবাদ আদালতে মামলা করে।
তার ঠিক দু’বছরের মাথায় মসজিদের অধিকার ফিরে পেতে পাল্টা মামলা ঠোকে উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। বাবরি মসজিদের ভেতর থেকে রামলালার মূর্তি সরানোরও আর্জি জানান তারা।
মসজিদ বা মন্দিরের দখল নিয়ে বিরোধ থাকলেও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু তখনও পর্যন্ত সরাসরি এই বিতর্কে পক্ষ নেয়নি।
কিন্তু সেই ধারার অবসান ঘটে ১৯৮৪তে, যখন অযোধ্যাতে রামমন্দির গড়ার লক্ষ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একটি প্রভাবশালী কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
স্থির হয়, সেই রামমন্দির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডভানি – যিনি এর আগে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের সরকারে দেশের তথ্যমন্ত্রী ছিলেন।
এরই মধ্যে ১৯৮৬ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি ফৈজাবাদ ডিস্ট্রিক্ট সেসন জজ কে এম পান্ডে এক ‘ঐতিহাসিক’ রায় ঘোষণা করেন। ইউ সি পান্ডে নামে এক আইনজীবী মামলা করেছিলেন, তালা ঝোলানোর নির্দেশ কোনও আদালত দেয়নি – সেটা দিয়েছিল ফৈজাবাদ জেলা প্রশাসন – তাই তা বেআইনি এবং বাতিল করা হোক।
সেই মামলার শুনানিতে জেলা শাসক ও পুলিশ সুপারকে তলব করে বিচারক জানতে চান, “একটা তালা খুলে দিলে আপনারা অযোধ্যার শান্তি-শৃঙ্খলা রাখতে পারবেন না – সামান্য একটা তালায় কেন আপনাদের এত ভয়?”
অপ্রস্তুত ডিএম ঢোঁক গিলে মেনে নেন, শান্তি বজায় রাখার জন্য ওই তালাটা ‘অপরিহার্য নয়’। পুলিশ-প্রধানও জানান, ‘তালা থাকুক বা না-থাকুক’, রামজন্মভূমির শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা অবশ্যই সম্ভব। এর পরই বিচারক নির্দেশ দেন, বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানের তালা খুলে দিয়ে হিন্দুদের ‘পূজা ও দর্শনে’র অনুমতি দিতে হবে।
তিনি আরও বলেছিলেন, “ওই একটা তালা খুলে দিলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না। মুসলিমদেরও এতে অসুবিধা হওয়ার কোনও কারণ নেই।”
রায় ঘোষণার মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে তা কার্যকর করা হয় – সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার হিন্দু ভক্তর ঢল নামে ওই বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানে। বিচারক পান্ডে পরে তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, রায় ঘোষণার দিন আদালত ভবনের ছাদে একটি কালো রঙের হনুমান নাকি সারা দিন ঠায় বসেছিল।
“ভক্তরা তাকে নানা ফলমূল-প্রসাদ দিলেও সে তা ছুঁয়েও দেখেনি। বিকেল ৪টে ৪০ মিনিটে রায় ঘোষণার পরই সে চলে যায়। আমি যখন বাংলোয় ফিরলাম, গিয়ে দেখি আমার বারান্দায় সেই হনুমান বসে।”
“আমি তাকে প্রণাম করি, কারণ আমার মনে হয়েছিল সে কোনও ঐশ্বরিক শক্তির প্রতিভূ!”, ওই বইতে লিখেছেন বিচারক পান্ডে। এই চরম বিতর্কিত রায়ের প্রতিবাদেই মুসলিমরা গড়ে তোলেন ‘বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি’।
কমিটির আহ্বায়ক করা হয় লখনৌর তরুণ আইনজীবী জাফরইয়াব জিলানিকে, যিনি ততদিনে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আর টাউনহলের বক্তৃতার মাধ্যমে প্রতিবাদ আন্দোলনের পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন।
সিদ্ধান্ত রাজীব গান্ধীর নয়?
মসজিদের তালা খুলে দিয়ে হিন্দুদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার প্রতিবাদে ওই রায় ঘোষণার ঠিক দু’সপ্তাহ পর ১৯৮৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের মুসলিমরা সারা দেশ জুড়ে ‘কালা দিবস’ পালন করেন।
দেশের বহু জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নেয় রাজধানী দিল্লি, উত্তরপ্রদেশের মীরাট এবং জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগে।
অযোধ্যায় গত ৩৭ বছরের স্থিতাবস্থার অবসান ঘটিয়ে এই অশান্তির সূত্রপাত ঘটানোর জন্য যথারীতি আঙুল তোলা হতে থাকে দিল্লির রাজীব গান্ধী সরকার আর উত্তরপ্রদেশের বীর বাহাদুর সিং সরকারের দিকে।
আসলে সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া একজন সামান্য সেসন জজ এত বড় সিদ্ধান্ত নেবেন এবং তা সঙ্গে সঙ্গে বলবৎ করা হবে, এটা মোটেই বিশ্বাস্য ছিল না। আর ঘটনাচক্রে কংগ্রেসই তখন কেন্দ্রে ও রাজ্যের ক্ষমতায়।
রাজীব গান্ধী নিজে অবশ্য পরে একাধিকবার ঘনিষ্ঠ বলয়ে জানিয়েছেন, অযোধ্যাতে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে। তার সে সময়ের সহযোগীরা বিভিন্ন জায়গায় সে কথা লিখেওছেন।
ভারতের সাবেক তথ্য কমিশনার ও অবসরপ্রাপ্ত আমলা ওয়াজাহাত হাবিবুল্লাহ তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একজন তরুণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত।
‘মাই ইয়ার্স উইথ রাজীব’ বইতে মি হাবিবুল্লাহ লিখেছেন, অযোধ্যার ওই ঘটনার মাসকয়েক পর তিনি যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিমানে খরাকবলিত গুজরাট সফরে যাচ্ছিলেন তখন তিনি কথাপ্রসঙ্গে অযোধ্যা নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন।
তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন করেন, অযোধ্যার তালা খুলে দিয়ে কী লাভ হল? তার চেয়ে কংগ্রেস নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখলেই তো ভালো করতো, এবং দক্ষিণপন্থীরাও এটাকে নিজেদের জয় হিসেবে জাহির করার সুযোগ পেত না!
জবাবে রাজীব গান্ধী না কি বলেছিলেন, “আসলে আমি এই ঘটনার কথা কিছুই জানতাম না। রায় ঘোষণা হয়ে গিয়ে তালা খুলে দেওয়া পর্যন্ত আমাকে এ বিষয়ে কেউ বিন্দুবিসর্গ কিছু জানায়ইনি!”
তিনি আরও জানান, তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অরুণ নেহরু ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব মাখনলাল ফোতেদারই এ ব্যাপারে ‘কলকাঠি’ নেড়েছেন বলে তার সন্দেহ – দিল্লি ফিরেই তিনি বিষয়টা নিয়ে ভালো করে খোঁজখবর নেবেন।
রাজীব গান্ধীর সম্পর্কিত ভাই অরুণ নেহরু তখন দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে খুব প্রভাবশালী। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই রাজীব গান্ধী তাকে মন্ত্রিসভা থেকে ছেঁটে ফেলেন।
প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও সে সময় রাজীব গান্ধীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মণিশঙ্কর আইয়ারও লিখেছেন, অরুণ নেহরু সে সময় এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে প্রধানমন্ত্রীকে ঘুণাক্ষরেও কিছু না-জানিয়ে অযোধ্যার মতো বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ এখতিয়ার তার ছিল – এবং তিনি সেটারই সদ্ব্যবহার করেছিলেন।
বিকল্প প্ল্যান, শাহবানো এফেক্ট?
মি আইয়ার আরও জানিয়েছেন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মতো ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের নিয়ে রাজীব গান্ধী এরপর একটি কমিটিও তৈরি করেছিলেন – যার লক্ষ্য ছিল মন্দির-মসজিদ বিতর্কের সমাধানে একটি বিকল্প পরিকল্পনা পেশ করা।
সেই কমিটির মত ছিল, এই বিতর্কে মূল প্রশ্নটা হলো বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বিদ্যমান রামমন্দিরকে ধ্বংস করে সেই জায়গায় বাবরি মসজিদ তৈরি করেছিলেন?
না কি তিনি অযোধ্যায় একটি অব্যবহৃত জমিতে মসজিদ বানান, যেটিকে এখন রামচন্দ্রের জন্মভূমি বলে দাবি করা হচ্ছে?
সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পরামর্শ দিয়েছিলেন, এই অমীমাংসিত মূল প্রশ্নটা সুপ্রিম কোর্টের কাছে পেশ করা হোক – এবং ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেশের শীর্ষ আদালতকে এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানাতে বলা হোক।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের কাছে তা পেশ করারও দুটো পথ ছিল। আর্টিকল ১৪৩ অনুসারে তা পেশ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য ‘মতামতে’র আকারে দেশের প্রেসিডেন্টকে জানানোর কথা – যা মানাটা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।
কিন্তু আর্টিকল ১৪২ অনুসারে প্রশ্নটা রাখা হলে সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ‘নির্দেশ’ মানাটা অবশ্যই বাধ্যতামূলক হতো। আর তাতে এই বিতর্কের একটা স্থায়ী নিষ্পত্তিও হয়তো সম্ভব ছিল – তা সে বিবদমান দুই পক্ষের যার অনুকূলেই যাক না কেন।
কিন্তু দেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর (যিনি আবার রাজীব গান্ধীর সমর্থনেই ক্ষমতায় এসেছিলেন) আর্টিকল ১৪৩-র পথটাই শেষ পর্যন্ত বেছে নেন এবং রাজীব গান্ধী তাতে যারপরনাই বিরক্ত হন বলে দাবি করেছেন মণিশঙ্কর আইয়ার।
চন্দ্রশেখর সরকারের ওপর থেকে কংগ্রেসের সমর্থন প্রত্যাহারের এটাও একটা বড় কারণ ছিল বলে জানাচ্ছেন তিনি। এর কয়েক মাস পরেই চেন্নাইয়ের কাছে নির্বাচনী জনসভায় তামিল ইলম বিদ্রোহীদের হামলায় রাজীব গান্ধী প্রাণ হারান।
রাজীব গান্ধীর এককালের সহযোগীরা অযোধ্যা বিপর্যয়ের দায় থেকে তাকে অব্যাহতি দিতে নানা তথ্য ও যুক্তি পেশ করলেও সেখানে স্থিতাবস্থা বিনষ্ট হওয়ার জন্য অনেক বিশ্লেষকই সরাসরি তখনকার প্রধানমন্ত্রীকেই অভিযুক্ত করেছেন।
ইতিহাস এটাই বলে, অযোধ্যায় বিতর্কিত ধর্মস্থানের তালা খুলে দেওয়া ও তারপর সেখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) উদ্যোগে রামমন্দিরের ‘শিলান্যাসে’র ঘটনা যখন ঘটে, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম ছিল রাজীব গান্ধী।
বিতর্কিত কাঠামোর খুব কাছেই ভিএইচপি-কে সেই শিলান্যাসের অনুমতিও দিয়েছিল রাজীব গান্ধীর সরকার। রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভার সদস্য আরিফ মহম্মদ খান পরে দাবি করেছেন, তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম নারীর খোরপোষ নিয়ে ঐতিহাসিক শাহবানো মামলায় সরকারের বিতর্কিত ভূমিকার পর একটা ‘ব্যালান্সিং অ্যাক্ট’ হিসেবেই রাজীব গান্ধী সরকার ওই তালা খোলার অনুমতি দিয়েছিল।
তিনি একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেন, “১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্টে শাহবানো মামলার রায়ের পর সরকার যখন অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের দাবির কাছে নতি স্বীকার করল, তখন সেটা ব্যালান্স করার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়কেও দেখানোর দরকার ছিল যে সরকার তাদের দাবিদাওয়ার প্রতিও সহানুভূতিশীল।”
“ঠিক এই কারণেই শাহবানো মামলার মাত্র কয়েক মাস পরেই বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়া হয়েছিল বলে আমার বিশ্বাস”, আইএএনএস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন আরিফ মহম্মদ খান।
রামমন্দির যখন রাজনীতির হাতিয়ার
১৯৮৬তেই বিজেপির আদর্শিক অভিভাবক হিসেবে পরিচিত আরএসএস সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল, অযোধ্যায় রামজন্মভূমিস্থল ও তার সন্নিহিত এলাকার পুরোটাই হিন্দুদের রাম জন্মভূমি ট্রাস্টের হাতে তুলে দেওয়া হোক।
তাদের প্রতিনিধিদের যুক্তি ছিল, গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরকে ভগ্নপ্রায় দশা থেকে পুনরুদ্ধার করে যেভাবে স্বাধীন ভারতে নতুন গরিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, ঠিক একই ধরনের মর্যাদা প্রাপ্য অযোধ্যায় রামমন্দিরেরও।
সোমনাথ মন্দির যেমন গজনীর সুলতান মাহমুদ বা পরে আলাউদ্দিন খিলজির বাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়েছিল, তেমনি রামমন্দিরও বাবর বা তার সেনাবাহিনীর হাতে ধূলিসাৎ হয়েছিল – ফলে আরএসএসের যুক্তি ছিল আদালতের রাস্তায় গিয়ে এই বিতর্কের মীমাংসা করা সম্ভব নয়।
এমন কী ১৯৮৯ সালে পালামপুরে গৃহীত প্রস্তাবে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বও বলেছিল, “অযোধ্যা বিতর্কের মীমাংসা করতে হবে (হিন্দু ও মুসলিম) দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতেই। আর সেটা সম্ভব না-হলে, কার্যকরী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে।”
পালামপুর রিজলিউশনে পরিষ্কার বলা হয়, “মামলা-মোকদ্দমা করে এই সমস্যার কোনও সমাধান বেরোবে না।”
সেই পর্যায়ে আরএসএস-বিজেপির যুক্তি ছিল, ‘অযোধ্যায় ভগবান শ্রীরামচন্দ্র জন্মেছেন এটা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের ‘আস্থা’ ও বিশ্বাসের প্রশ্ন, তাই তাদের সেই অনুভূতিকে মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রের উচিত ওই জন্মস্থান হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়া’।
১৯৮৪র নির্বাচনে সারা দেশে মাত্র দু’টি আসন পাওয়া বিজেপি ততদিনে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ৮৬ জন এমপি-র শক্তিশালী দল হয়ে উঠেছে, যার পেছনে অযোধ্যা আন্দোলনের বড় ভূমিকা ছিল।
কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে তারা সেই নির্বাচনের পর বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর সরকারকেও বাইরে থেকে সমর্থন জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু এরপরই জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে পরপর কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটে, ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ যার খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন।
আকরগ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’-তে রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন, “কিন্তু ১৯৯০ সালের আগস্টে ঘোষণা করা মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট (যাতে পিছিয়ে থাকা বা তুলনায় নিচু জাতের হিন্দুদের জন্য বেশি সংরক্ষণের সুপারিশ করা হয়েছিল) বাস্তবায়ন করতে ভিপি সিং সরকারের সিদ্ধান্ত বিজেপিকে এক বিরাট সঙ্কটে ফেলে দেয়।”
“দলের কোনও কোনও নেতার মত ছিল, হিন্দু সমাজের ঐক্য ভাঙার জন্য এটা আসলে একটা দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা।”
“বিজেপির অন্দরে ও আরএসএসের শাখায় শাখায় তখন তুমুল বিতর্ক – মন্ডল কমিশনের সুপারিশে দলের সমর্থন জানানো উচিত কি উচিত নয়!”
“কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনও অবস্থান নেওয়ার বদলে বিজেপি কিন্তু রাজনৈতিক বিতর্কের অভিমুখটাই পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করল। তারা চাইল যাতে মন্ডল ও জাতপাতের বদলে ধর্ম ও মন্দির/মসজিদ ন্যারেটিভে বিতর্কটা ফিরে আসে”, লিখেছেন রামচন্দ্র গুহ।
আপনার মতামত জানানঃ