এই বিশ্ব সংসারে যা যা আমরা চোখে দেখি বা দেখতে পাই না, অথচ যা পুরোদস্তুর বিদ্যমান— তা কী দিয়ে তৈরি? প্রশ্নটা বোধহয় মানব সভ্যতার শুরু থেকেই রয়েছে। তবে তার রহস্য আজও অনেকটাই অজানা।
গত শতাব্দীর শেষ সিকিভাগ ধরে বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করে এসেছেন, এই মহাবিশ্বে যা যা রয়েছে, সেই সব কিছুর মৌলিক উপাদান অণু আর পরমাণু। তবে বিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশ এই অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি। ২৫ শতাংশ তৈরি ‘ডার্ক ম্যাটার’ দিয়ে। এটি হল এক ধরনের অজানা বস্তু, যা আমরা দেখতে পাই না। তবে অভিকর্ষের মাধ্যমে এর অস্তিত্ব জানা যায়। বাকি ৭০ শতাংশই তৈরি ‘ডার্ক এনার্জি’ দিয়ে। আর এখানেই রয়েছে যত রহস্য। যা ধারণার থেকেও বেশি জটিল বলে মানছেন বিজ্ঞানীরা।
‘ডার্ক এনার্জি’ কী, তা কী ভাবে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এ নিয়ে ১৯৯৮-এর আজকের দিনে, অর্থাৎ ৯ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক জ্যোর্তিবিজ্ঞানীদের দু’টি দল প্রথম জোরালো ভাবে আলোকপাত করেন। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ও গবেষক তাঁদের গবেষণায় এ বিষয়ে সর্বাধিক আলোকপাত করেছেন বলে
দাবি উঠেছে।
প্রসঙ্গত, এক শতাব্দীরও আগে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের অবতারণার সময় প্রথম ‘ডার্ক এনার্জি’র ধারণা দিয়েছিলেন। নানা সমীকরণে তিনি বুঝেছিলেন, এই ব্রহ্মাণ্ড হয় ক্রমাগত সংকুচিত অথবা প্রসারিত হয়ে চলেছে। অভিকর্ষের তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সমীকরণে একটি ধ্রুবকের আশ্রয় নেন। ধ্রুবকটি নাম ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’। গ্রিক অক্ষর ল্যামডা দিয়ে একে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি।
পরে অবশ্য দুই বিজ্ঞানী হেনরিটা সোয়ান লেভিট এবং এডউইন হাবল গবেষণায় প্রমাণ করেন, মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে চলেছে। তখন এই সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণ থেকে ল্যামডাকে সরিয়ে দেন। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’।
১৯৯৮ সালে বিজ্ঞানীদের দুই দল প্রমাণ করেন, এই বিশ্ব ক্রমাগত প্রসারণশীল। তার ফলে আজকের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ফিল্ড সমীকরণ থেকে বাদ পড়া সেই ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’-এর মাধ্যমেই ডার্ক এনার্জির সবচেয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। নক্ষত্রপুঞ্জের ক্রমাগত বিস্ফোরণ ও তা থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মির পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই ‘ডার্ক এনার্জি’র পরিমাপের চেষ্টা করছেন বর্তমানের বিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন মহাদেশের অন্তত ৪০০ বিজ্ঞানী এই গবেষণায় যুক্ত।
তবে ‘ডার্ক এনার্জি’র উৎস নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি। এ ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। অনেকের মতে, মহাশূন্যের অসীম শূন্যতার মাঝে সব সময় যে ‘কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন’ বা কোয়ান্টাম শক্তির রূপান্তর ঘটে চলেছে, তার ফলে ‘ডার্ক এনার্জি’র সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও এর স্বপক্ষে এখনও তেমন কোনও জোরদার প্রমাণ নেই। ফলে ‘ডার্ক এনার্জি’র রহস্য এখনও পর্যন্ত অধরাই রয়ে গিয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ