গলায় দড়ির ফাঁস। কুঁকড়ে গেছে দেহের চামড়া। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ঘোর কৃষ্ণবর্ণ তার রং। গোটা ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু অঞ্চলেই খুঁজে পাওয়া গেছে এধরনের অসংখ্য মৃতদেহ। কারোর বয়স পাঁচশো বছর, কেউ আবার পেরিয়েছেন হাজার বা দু’হাজারের গণ্ডি।
তা সত্ত্বেও এতটুকু পচন ধরেনি এইসব মৃতদেহে। অথচ, এইসব দেহ যে মমির মতো সংরক্ষণ করেছিল প্রাচীন মানুষ— তেমনটাও নয়। বরং, প্রাকৃতিকভাবেই সংরক্ষিত হয়েছে এসব দেহ।
বগ বডি। এই নামেই পরিচিত এইসব রহস্যময় (Mysterious) মৃতদেহরা। হ্যাঁ, ‘বগ’ বলতে জলাভূমির কথাই হচ্ছে। আসলে, ‘পিট’ নামের এক বিশেষ উদ্ভিদ পাওয়া যায় ইউরোপের জলাভূমিতে। আর তেমনই একটি জলাজমিতে প্রথম আবিষ্কৃত হওয়ায় ‘বগ বডি’ (Bog Bodies) নামে পরিচিত পায় এইধরনের রহস্যময় মৃতদেহরা।
তবে সেটা অবশ্য আজকের কথা নয়। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে সর্বপ্রথম বগ বডি আবিষ্কৃত হয়েছিল জার্মানিতে। তারপর ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র— সর্বত্রই পায় পাওয়া গেছে বগ বডি।
কিন্তু কারা সমাধিস্থ করেছিল এইসব মৃতদেহ? হাজার হাজার বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও অক্ষত অবস্থায় সেসব আজও কীভাবে সংরক্ষিত রয়েছে প্রকৃতিতে? গবেষকদের মতে, যেসব জলাভূমিতে ‘পিট’ পাওয়া যায়, সেখানকার জলের অম্লতা সাধারণ জলের থেকে অনেকটাই বেশি। ফলে, সেই মানবদেহ পচনের জন্য দায়ী জীবাণু-ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সেখানে নেই বললেই চলে।
এই অম্লতার কারণেই কুঁকড়ে কালো হয়ে যায় দেহের চামড়া। কখনও আবার ভেতর থেকে ক্ষয়ে যায় দেহের হাড়। তবে সম্পূর্ণ দেহ পচে যায় না। অবশ্য শুধু অম্লতাই নয়, পিট বগে আরও একাধিক জৈব যৌগের উপস্থিতিও দায়ী এই প্রাকৃতিক সংরক্ষণের পিছনে।
এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন বগ বডির বয়স প্রায় ১০ হাজার বছরেরও বেশি। অর্থাৎ, সহজ কথায় বলতে গেলে মধ্যপ্রস্তর যুগের মৃতদেহ অক্ষত রয়েছে এখনও। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেনানিদের দেহ বগ বডিতে পরিণত হয়েছে। রয়েছে এমন উদাহরণও।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, একদম প্রাচীন যুগের কথা বাদ দিলে, অধিকাংশ বগ বডির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে হিংসাত্মক অতীত। তার কারণ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ— এই সময়ের যে-সকল বগ বডি উদ্ধার হয়েছে তাদের অধিকাংশেরই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
গলায় ফাঁস পরানো অবস্থাতেই উদ্ধার হয়েছে বহু বগ বডি। গবেষকদের অনুমান হয়তো, এ-সব মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল একসময়। তাছাড়া এমনও বহু শিশু বা কিশোর-কিশোরীর বগ বডি আবিষ্কৃত হয়েছে, যাদের শরীরে রয়েছে ধারালো অস্ত্রের দাগ, গভীর ক্ষত। এক্ষেত্রে শাস্তিপ্রদানের সম্ভাবনা বাতিল করে দেওয়া যায় সহজেই।
বরং, জেগে থাকে কোনো প্রাচীন রীতি, ধর্মানুষ্ঠান, কালোজাদু বা উইচক্রাফটের সম্ভাবনা। খুন করে জলাজমিতে দেহ লুকিয়ে রাখার কথাই বা বাদ দেওয়া যায় কীভাবে? এমনকি ভালোভাবে সংরক্ষিত কিছু বগ বডির শরীরে বিষের অস্তিত্বও নজর কেড়েছে গবেষকদের।
ওয়াজেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষক ডক্টর রয় ভ্যান বেকের কথায়, বগ বডির রহস্য অমীমাংসিত এখানেই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পাওয়া বগ বডিদের কোনো নির্দিষ্ট সূত্রে বাঁধা কার্যত অসম্ভব।
অ্যান্টিকুইটি জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ইউরোপ মহাদেশেরই ২৬৬টি অঞ্চল থেকে পাওয়া গেছে সহস্রাধিক বগ বডি। তাও এই তথ্য আজ থেকে বছর দশেক আগের। বর্তমানে এই পরিসংখ্যান আরও বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে এর মধ্যে খুব কম সংখ্যক দেহকেই বিশ্লেষণ করে দেখার সুযোগ পেয়েছেন গবেষকরা।
কারণ অন্যগুলির ক্ষেত্রে শরীরের রাসায়নিক গঠন অম্লতার কারণে আমূলভাবে বদলে যাওয়ায় ডিএনএ কিংবা অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে। আর সেই কারণেই বোধ হয় সাধারণ মানুষের আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে বগ বডিদের প্রতি।
বর্তমানে মমির মতোই ‘বগ বডি’ সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হয় একাধিক ইউরোপীয় মিউজিয়ামে। টিকিট কেটে তা দেখতে হাজিরও হন হাজার হাজার মানুষ। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, মৃত্যুর পর যেন জীবদ্দশায় না-পাওয়া কদর ফিরে পাচ্ছে রহস্যময় এইসব মৃতদেহরা
আপনার মতামত জানানঃ