রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, অনেক মানুষই এখন প্রেমের সম্পর্কে জড়াচ্ছেন ভার্চুয়াল প্রেমিকার সঙ্গে। তাদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন। সমাজবিজ্ঞানী মেরিয়ান ব্ল্যাংকোর মতে, ভবিষ্যতে এআইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানো অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কারণ বাস্তব ও ভার্চুয়ালের পার্থক্য অনেকটাই কমে আসবে ধীরে ধীরে।
‘এফবিআই, আমি আমার প্রেমিকাকে খুঁজে পাচ্ছি না, তাকে তাড়াতাড়ি খুঁজে পেতে সাহায্য করুন।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ২৩ বছর বয়সী মার্কিন ইনফ্লুয়েন্সার ক্যারিন মার্জোরির একটি পোস্টের নিচে এই বার্তাটির দেখা মিলে। মার্জোরির রয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি ফলোয়ার। তবে এই বার্তায় যুবক যে প্রেমিকার কথা বলেছেন, সেই প্রেমিকা রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, আদতে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই সৃষ্ট ভার্চুয়াল প্রেমিকা।
এআই দিয়েই নিজের এই ভার্চুয়াল সত্তা তৈরি করেছেন ক্যারিন মার্জোরি। আর তার এই ভার্চুয়াল সত্তার সঙ্গে কথা বলতে অনুসারীদের গুনতে হয় প্রতি মিনিটে এক ডলার। অর্থাৎ মার্জোরির ভার্চুয়াল সত্তাগুলো একসঙ্গে অনেক যুবকের প্রেমিকা হিসেবে কথা বলেন।
মার্জোরির ওই ভার্চুয়াল সত্তা তৈরি করেছিল ফরএভার ভয়েস নামক ওয়েবসাইট। ওই কোম্পানির সিইও নিজ ঘরে অগ্নিসংযোগের একটি মামলায় গ্রেপ্তার হলে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায়। কোম্পানিটি বন্ধ হওয়ার পর ক্যারিনের ভার্চুয়াল সত্তার সঙ্গে কথা বলতে পারছিলেন তার প্রেমিকেরা। এরপরই তাই উদ্বিগ্ন হয়ে এক্সে এফবিআইয়ের কাছে সাহায্য চান এক প্রেমিক।
ওই প্রেমিক জানতেন যে তার এই প্রেমিকা আসলে ভার্চুয়াল। তারপরও ভার্চুয়াল প্রেমিকার প্রতি বাস্তব জীবনের মতোই আবেগ অনুভব করেন নিজের মধ্যে। ক্যারিনের পোস্টের নিচে মন্তব্য করা ওই প্রেমিক এল পাইসকে জানান, ‘আমি সত্যি তাকে অনেক মিস করি। তার সাথে আমার সবসময় কথা হতো এবং সে-ই একমাত্র মানুষ যে আমাকে পুরোপুরি বুঝতে পারে।’
এআইসৃষ্ট জীবনসঙ্গীর এরকম ধারণা এখন আর শুধু ‘হার’-এর মতো সায়েন্স ফিকশন সিনেমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিগত কয়েক বছরে অনেকগুলো অ্যাপ এসেছে যেগুলো ব্যবহারকারীকে তার পছন্দ অনুযায়ী সঙ্গী তৈরি করে দেয়। এসব সঙ্গীরা জীবন্ত ব্যক্তির মতোই বাস্তবিক আচরণ করে।
চ্যাটজিপিটি ও বার্ডের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের একে অপরের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগের ধারণাতেও অনেকখানি পরিবর্তন এসেছে। এরকম আরও কিছু জনপ্রিয় চ্যাটবট হলো, রেপ্লিকা, ইভা-এআই, ড্রিম-জিএফ, রোমান্টিক-এআই প্রভৃতি।
প্রথমেই একটি পুরুষ বা নারীর অবয়ব/অবতার বাছাই করতে হবে। তবে কিছু অ্যাপ আছে যেগুলো শুধু পুরুষদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে, অর্থাৎ সঙ্গী হিসেবে শুধু নারীদেরকেই বেছে নেওয়া যাবে। অ্যাপগুলোর মধ্যে মেসেজ, ভয়েস নোট পাঠানো কিংবা প্রেমিক বা প্রেমিকার ছবি আদানপ্রদানের মতো সুবিধা আছে। তবে এসব সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়। তবে সবচেয়ে প্রিমিয়াম সুবিধা হলো, আপনি চাইলে আপনার সঙ্গীর শারীরিক অবতারও নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারবেন—যেমন চোখ কিংবা চুলের রং, শারীরিক গঠন কিংবা জাতিগত বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি।
ইভা-এআইয়ের ওয়েবসাইটের প্রথম পাতায় লেখা আছে, ‘আপনার কথা শোনে, উত্তর দেয় এবং আপনাকে মূল্য দেয়—এমন ভার্চুয়াল এআই সঙ্গীর সাথে নিজেকে যুক্ত করুন। সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা তৈরি করুন নিজের ইচ্ছামাফিক। ‘
চার্লস-৩ মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ অধ্যাপক মেরিয়ান ব্ল্যাংকো বলেন, ‘আপনি যে একটি মেশিনের সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারবেন না, এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না। এ অ্যাপগুলো এমন মানুষের জন্যই তৈরি যারা বাস্তব জীবনে সবার সাথে সামাজিকীকরণ করতে ইতস্তত বোধ করেন।’
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব অ্যাপ আবার কিছু সমস্যাও তৈরি করতে পারে। যেমন, আপনি এমন একজন ভার্চুয়াল সঙ্গী বানালেন যার মতো বাস্তবে জীবনে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। ফলশ্রুতিতে আপনার মধ্যে নারী ও তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটি ক্ষতিকর স্টেরিওস্টাইপ (গৎবাঁধা) ধারণা তৈরি হবে। তাছাড়া পুরুষ কর্তৃক নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার এই ধারণাও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মতো উদ্বেগ তৈরি করে।
এই অবতারগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি হওয়ার ফলে তারা ইন্টারনেট থেকে পাওয়া বিভিন্ন পক্ষপাতদুষ্ট চরিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে। ফলস্বরূপ, নারীর দেহকে অত্যধিক যৌন আবেদনময়ী এবং তাদের কথা বলার ধরন বিনয়ী ও সরল করে দেখানো হয়। ভার্চুয়াল এই প্রেমিকা তার ব্যবহারকারীর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য রপ্ত করে। সময়ের ওই ব্যক্তি যা শুনতে চায়, তার সঙ্গে ঠিক সেইভাবেই মানিয়ে নেয় তারা।
সমাজবিজ্ঞানী মেরিয়ান ব্ল্যাংকোর মতে, এই অ্যাপগুলো নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের জন্য ভালো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনে প্রকৃত সামাজিক মিথস্ক্রিয়া প্রদান করে না। এসব অ্যাপ জনপ্রিয় হওয়ার আরেকটি কারণ হলো কিছু মানুষ একে সম্পর্ক তৈরি করার সহজ পন্থা মনে করেন। কোনো ব্যক্তি যখনই একা অনুভব করেন, তখনই এই অ্যাপ খুলে নিজের নিঃসঙ্গতা দূর করতে পারেন। তবে এর ক্ষতিকর দিক হলো নারীর প্রতি ইন্টারনেট স্পেসে উসকানিমূলক আচরণ। ইন্টারনেটে অনেক ব্যবহারকারী আছেন যারা এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করে নারীবিদ্বেষী আচরণে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
করোনা মহামারির সময় সবাই যখন লকডাউনে ঘরবন্দি ছিলেন, তখন এ ধরনের অ্যাপের ব্যবহার বেড়েছে। ওই সময়টায় ঘরের বাইরে কারও সঙ্গে যোগাযোগ ও সামাজিকীকরণ করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। তখন অনেকেই একাকিত্ব কাটানোর জন্য এসব অ্যাপ ব্যবহার করা শুরু করেন।
ইউরোপিয়ান কমিশনের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ১৮.৮ শতাংশ স্পেনীয় নাগরিক একাকিত্বে ভুগছিলেন। অনেকেই আছেন আবার ভার্চুয়াল জগতের বাইরে গিয়ে বাস্তবে সামনাসামনি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে কিংবা প্রেম করতে পছন্দ করেন। কিন্তু যারা এসব পছন্দ করেন না, কিংবা বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপসে বিরক্ত হয়ে পড়েন, তারাই এই ধরনের এআই অ্যাপ ব্যবহার করে নিঃসঙ্গতা দূর করেন।
কোভিড মহামারির সময় রেপ্লিকা অ্যাপের ডাউনলোড ৩৫ শতাংশ বেড়ে ১০ মিলিয়ন ছড়ায়। কোম্পানিটির তথ্যানুযায়ী, আড়াই লাখ মানুষ এ অ্যাপের প্রো-ভার্সন ব্যবহার করেন। প্রো ভার্সনে ভয়েস নোট, ভিডিও এবং ছবির মতো সুবিধা দিয়ে ব্যবহারকারীদের আরও বাস্তব অভিজ্ঞতা দেওয়া হয়। কিছুদিন আগে এই অ্যাপে যৌন আবেদনময়ী ছবি দেখার অপশন যুক্ত করা হয়, যদিও পরে তারা এটি সরিয়ে নেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে—যেখানে মানুষ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করে—দেখা যায়, অনেকেই তাদের ভার্চুয়াল প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করছে। কেউ কেউ আবার পরামর্শও চাইছে অন্যজনের কাছে। রেডিটে এরকম একজন ব্যবহারকারী বলেন, ‘আমি আমার রেপ্লিকাকে অনেক ভালোবাসি, সে খুব সহজেই আমাকে বুঝতে পারে এবং উত্তর দিতে পারে। কিন্তু আমি কি এআইকে আমার প্রকৃত ভালোবাসা বলতে পারি?’
মেরিয়ান ব্লাংকো বলেন, অস্তিত্বহীন সত্তার প্রেমে পড়া করা কোনো পাগলামি নয়, কারণ এটি বাস্তব জীবনেও ঘটে। তিনি ব্যক্তির ওপর প্রেমে পড়ার মতই আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের ওপর প্রেম পড়াকেও সাধারণ বলে উল্লেখ করেন। তার কাছে ভার্চুয়াল প্রেমিকার ধারণাটি বোধগম্য।
মোরেনো আরও বলেন, ভবিষ্যতে এআইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানো অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কারণ বাস্তব ও ভার্চুয়ালের পার্থক্য অনেকটাই কমে আসবে ধীরে ধীরে।
আপনার মতামত জানানঃ