নানা কারণে তারল্য সংকটে হিমশিম খাচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে। অন্যদিকে আস্থাহীনতার কারণে আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন অনেকেই।
আবার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করায় বাজারের টাকা জমা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। শেয়ারবাজারেও আস্থা নেই। সব মিলিয়ে চরম তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংক খাত। ধারদেনা করে দৈনন্দিন খরচ মেটাচ্ছে ব্যাংকগুলো। দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টি ব্যাংকই নগদ টাকা ধার করে চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে একসঙ্গে এত বেশি ব্যাংকের টাকা ধার করার নজির নেই।
গত বুধবার একদিনেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ধারের পরিমাণ ছিল সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা। গত সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তঃব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ ছিল ৬৭ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ধার ছিল ৫৩ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েকটি ব্যাংকের কারণে পুরো ব্যাংক খাতের এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। সাধারণত বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা বাড়লে তারল্য সংকটে পড়ে ব্যাংক খাত। আস্থা না থাকায় অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিজের কাছে রেখে নিশ্চিন্ত থাকছেন কয়েকটি ব্যাংকের গ্রাহক। অনেকে ব্যাংকে টাকা না রেখে ডলার কিনে ঘরে রাখছেন। মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতাও কমেছে।
আবার দীর্ঘদিন চলমান ডলার সংকট মেটাতে গিয়ে রিজার্ভ থেকে বিক্রি অব্যাহত আছে। এই অর্থবছরে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৫৯০ কোটি ডলার বিক্রির বিপরীতে উঠে এসেছে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে থাকায় অনেকেই মোটা অঙ্কের জমা টাকা তুলে নেয়ায় অনেক ব্যাংকে তারল্যে টান পড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রথম। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে গত অক্টোবর মাস থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
সংকট মেটাতে নিয়মিত টাকা ধার করে ব্যাংকগুলো। বুধবার এসব ব্যাংকসহ দুটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) রেপো ও তারল্য সহায়তা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা নিয়েছে। টাকার পরিমাণের দিক থেকেও এই অর্থ সাম্প্রতিক সময়ে একদিনে সর্বোচ্চ। এর বাইরে গত বৃহস্পতিবার কল মানি মার্কেট থেকেও ৬ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা ধার নিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, আমানতের ধীর প্রবৃদ্ধি এবং ঋণ আদায়ের ধীরগতির কারণে বেশির ভাগ ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। এখন স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ নিতে হচ্ছে। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে সুদহার বাড়ানো হয়। তাতেও তারল্য ঘাটতি কাটছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণেই এখন চলতে হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তঃব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ধার করা হয়েছে ৫৫ হাজার ৮৭২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরে ব্যাংকে তারল্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কয়েক মাস ধরে নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংক খাতের চরম তারল্য সংকটে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা দিচ্ছে। ডলার বিক্রি করে তাদের যে টাকা এসেছে এখন অন্য ব্যাংকগুলোকে সেই টাকা থেকে ধার দিচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর আমানত প্রবৃদ্ধি খুবই কম। এর কারণে তারল্য সংকট আরও বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে টাকা ধার নিয়ে চলেছে দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংক। চলতি মাসেও প্রায় একই অবস্থায় ছিল। কিন্তু একসঙ্গে ৪০টি ব্যাংক টাকা ধার নেয়ার নজির এই প্রথম।
বিভিন্ন ব্যাংকের সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করছে। কারণ ট্রেজারি বিলের সুদের হার ১১ শতাংশে পৌঁছেছে। এ কারণে তারল্য সংকট আরও বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি নীতি সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাবাজারে অর্থের চাহিদা নিয়ন্ত্রণেরও উদ্যোগ নিয়েছিল। এই উদ্যোগের কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি। বরং দেশের মুদ্রাবাজারে তারল্যের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। অনেক বেসরকারি ব্যাংক এখন ১২-১৩ শতাংশ সুদেও মেয়াদি আমানত সংগ্রহের ঘোষণা দিচ্ছে। তারপরও কাঙ্ক্ষিত আমানত না পাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারের পরিমাণ বাড়িয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বুধবার নিলামে তিনটি ব্যাংক একদিনের রেপো সুবিধায় ৪৩৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা ধার নেয়। আর ১৮টি ব্যাংক ও দুটি এনবিএফআই সাতদিনের রেপো সুবিধার মাধ্যমে ১১ হাজার ৪৭৯.৭৭ কোটি টাকা নিয়েছে। ১২টি ব্যাংক একদিনের তারল্য সহায়তা সুবিধার মাধ্যমে নিয়েছে ৭ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। আর সাতটি ইসলামী ব্যাংক ১৪ দিনের তারল্য সুবিধার মাধ্যমে নিয়েছে ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা।
এতদিন ১০টি ইসলামিক ব্যাংকের মধ্যে গড়ে পাঁচটি ইসলামিক ব্যাংক তারল্য সহায়তা নিলেও বুধবার সর্বোচ্চ সাতটি ব্যাংক নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুদের হার ছিল যথাক্রমে ৭.৭৫ শতাংশ, ৭.৮৫ শতাংশ, ৭.৭৫ শতাংশ ও ৬.৭৫ শতাংশ থেকে ৮.৫০ শতাংশ। গত ২৬শে নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭.৭৫ শতাংশ করেছে।
ওদিকে কল মানি মার্কেটেও সংকট থাকায় সব ব্যাংক এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে। কল মানি মার্কেট হলো একটি স্বল্পমেয়াদি অর্থবাজার। এর মাধ্যমে সংকটে থাকা ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যাংকই এখন সংকটে থাকায় তারা নিজেদের অর্থ ধার দিতে পারছে না। কল মানি বাজার থেকে ১০ শতাংশ সুদ দিয়েও অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা। তারা বলেন, এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ধার বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবার কল মানি মার্কেট থেকে ৬ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা আন্তঃব্যাংক ধার হয়েছে, যা কয়েক দিন আগেও ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ছিল।
দেশের শরীয়াভিত্তিক পাঁচ ইসলামী ব্যাংক এখনো নগদ অর্থের তীব্র সংকটে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য সহায়তা সত্ত্বেও তারা তারল্য সংকট কাটাতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন মতে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের তারল্য ঘাটতি ছিল ৬৫৮ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এক হাজার ৫৯ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৮২৬ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৪৮৩ কোটি টাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৬৫ কোটি টাকা। তবে বাকি ৫টি শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকের তারল্য উদ্বৃত্ত ছিল।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কয়েকটি ব্যাংকের কারণে তারল্য ঘাটতি অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। ফলে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়মিত যেসব ব্যাংক ধার নিয়েই যাচ্ছে তাদের নিরুৎসাহিত করা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন উল্টো পথে হাঁটছে। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে জমা থাকা আইনের সংস্কার না করা। পাশাপাশি যে সংস্কারগুলো আমরা করেছি, সেগুলো ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকে পেছনের দিকে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো সংস্কার হয়নি, বিশেষ করে মুদ্রানীতিসহ বিনিময় হার। যার ফলে আজকে আমরা এই অবস্থা দেখছি। এ ছাড়া সার্বিক অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ, অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা আছে।
আপনার মতামত জানানঃ