কাক মানুষের অতিপরিচিত এক পাখি। প্রকৃতিতে কাক ও মানুষের সহাবস্থান। তাই কাক নিয়ে মানুষের মাঝে প্রচলিত আছে নানা গল্প, বিশ্বাস। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে যার কিছু কিছু লোক মুখ থেকে উঠে আসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে প্রায় সময়েই কাক নিয়ে একটি তথ্য প্রচার হতে দেখা যায়, যেখানে দাবি করা হয়, ‘কাক দ্বিতীয়বার জোড়া বাঁধে না। কারণ, এটি একমাত্র প্রাণী যে কিনা সঙ্গী হারানোর শোক কখনো কাটিয়ে উঠতে পারে না!’
জাতীয় শিক্ষক বাতায়নের ওয়েবসাইটেও কাকের দ্বিতীয়বার জোড়া বাঁধা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত এ তথ্য প্রকাশ হয়েছে। ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল হবিগঞ্জের দিনারপুর দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক জুয়েল আহমদ শিক্ষক বাতায়নের ওয়েবসাইটে তথ্যটি প্রচার করেন। ওয়েবসাইটে তথ্যটি এখন পর্যন্ত ৭৬ বার দেখা হয়েছে।
কিন্তু আসলেই কি তাই? কাক কি তার জীবদ্দশায় দ্বিতীয়বার জোড়া বাঁধে না? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে পাখিদের সাংসারিক জীবন সম্পর্কে জানা আলোচনা প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন প্রাণী জগতে মনোগ্যামি তথা একগামিতার বিভিন্ন ধরন নিয়ে ২০১৩ সালে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে পাখিদের একগামিতা সম্পর্কে সম্পর্কে বলা হয় ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টিং উদ্ভাবনের পূর্বে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন, প্রায় ৯০ শতাংশ পাখির প্রজাতি প্রকৃত অর্থে একগামী। কিন্তু পরবর্তীতে পিতৃত্ব পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, প্রায় ৯০ শতাংশ পাখিই সামাজিকভাবে একগামী।
সামাজিক মনোগামী বা একগামিতা বলতে বোঝায়, যখন এক জোড়া নারী ও পুরুষ একটি নির্দিষ্ট সময় (এক প্রজনন মৌসুম থেকে শুরু করে বহু বছর) এক সঙ্গে বসবাস করে। সামাজিক একগামিতা যৌন একগামিতাকে বোঝায় না। যৌন একগামিতা হচ্ছে, এক জোড়া নারী ও পুরুষ নিয়ে গঠিত, যারা নিজেদের বাইরে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে না। যৌন একগামিতা সব সময় সামাজিক একগামী সম্পর্কে পাওয়া যায় না।
ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ওই প্রতিবেদন মতে, যেহেতু ৯০ শতাংশ পাখিই সামাজিকভাবে একগামী। তাই তাদের পক্ষে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া সম্ভব। যা কাকের মধ্যেও দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটের কাক সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর অংশে কাকের জীবদ্দশায় সঙ্গী নির্বাচন বিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে পক্ষীবিদ্যা ল্যাবের ড. কেভিন জে ম্যাকগোয়ান বলেন, কাক সাধারণত এক সঙ্গীর সঙ্গেই দীর্ঘদিন থেকে যায়। তবে কোনো কারণে সঙ্গী যদি মারা যায় অথবা প্রজননে অক্ষম হয়, সে ক্ষেত্রে তারা সম্পর্ক ভেঙে নতুন কারও সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে।
প্রাণী ও প্রকৃতি বিষয়ক ওয়েবসাইট আর্থ লাইফ কাকের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানায়, কাক সামাজিক একগামিতার চর্চা করে। তাই এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক সঙ্গীর সঙ্গেই কাটিয়ে দেয়। তবে এরা কখনো কখনো এ চর্চার বিঘ্ন ঘটায়-যখন তার সঙ্গী মারা যায় বা আহত হয়। আবার জোড়ায় থাকা কাকও একই বাসায় বসবাস করার সময় অন্যান্য কাকের সঙ্গে প্রজনন করতে পারে। সাধারণ আমেরিকান কাক এবং ক্যালেডোনিয়ান কাকের মধ্যে এমন দেখা যায়।
পাখিবিষয়ক ওয়েবসাইট বার্ড ওয়াচিং বাজ কাকের সঙ্গী প্রসঙ্গে জানায়, কাককে একগামী মনে করা হলেও একটি কাক তার জীবদ্দশায় তিন থেকে পাঁচটি সঙ্গীর সঙ্গে জীবন কাটায়। সাধারণত যখন তার সঙ্গী মারা যায় অথবা দীর্ঘসময় আলাদা থাকে তখন তারা নতুন সঙ্গী বেছে নেয়। আবার কাক তার বংশরক্ষার প্রয়োজনেও সঙ্গী বদলায়। কখনো কখনো স্ত্রী কাক বাসায় ডিম থাকা অবস্থাতে বা বাচ্চারা উড়তে শুরু করলে অন্য কোনো পুরুষ কাকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। ওয়েবসাইটটি থেকে আরও জানা যায়, সঙ্গীর প্রতি অবিশ্বাসের কারণেও কাক তার সঙ্গী বদলাতে পারে। আবার কাকের কিছু প্রজাতি আছে, যারা জোড়বদ্ধ থাকা অবস্থাতেই জোড়ার বাইরে গিয়ে অন্য কাকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে।
পাখি বিষয়ক আরেকটি ওয়েবসাইট বার্ড ফ্যাক্ট থেকে জানা যায়, অধিকাংশ কাকই সারা জীবনের জন্য সঙ্গী বেছে নেয়। একসঙ্গে বাচ্চাদের বড় করে। তবে কোনো কোনো অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে তারা অন্য কাকের সঙ্গেও সম্পর্ক করতে পারে। যেমন, কোনো পুরুষ কাক যদি কোনো কারণে তার প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন স্ত্রী কাকটি নতুন সঙ্গী বেছে নেয়। প্রায় ১৮ শতাংশ কাকের বাচ্চার জন্ম হয় সঙ্গীর বাইরে অন্য কাকের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে।
এছাড়া ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, কেবল কাকই নয়, করভিড গোত্রের অন্যান্য পাখিরাও সাধারণত সামাজিকভাবে একগামী।
আপনার মতামত জানানঃ