বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী নুরুজ্জামান হাওলাদার ওরফে সোহেল (৪০) কর্মস্থলের সামনে থেকে নিখোঁজ হন গত শুক্রবার সন্ধ্যায়। এরপর পরিবার ডিবি অফিস ও বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিলেও কোনো তথ্য পায়নি।
ছয় দিন পর আজ বৃহস্পতিবার পরিবার জানতে পারে, তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নুরুজ্জামান ৯/এ ধানমন্ডি ইবনে সিনা ডি ল্যাবে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিসেবে চাকরি করেন।
পরিবার জানায়, ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর নুরুজ্জামান আর বাড়ি ফেরেনি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে তাঁরা জানতে পেরেছেন, সেদিন কর্মস্থলের বাইরের ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাঁকে কয়েকজন তুলে নেয়।
তবে ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, উত্তরা পশ্চিম থানার ভাঙচুরের একটি মামলায় গতকাল বুধবার ধানমন্ডি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নুরুজ্জামানের স্ত্রী দিপা আক্তার আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ডিবি পরিচয়ে তাঁর স্বামীকে তুলে নেওয়ার পর ডিবি অফিস ও বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁকে আটক করার কথা অস্বীকার করেন।
এরপর উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার মধ্যে তাঁদের দিন কাটছিল। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে আদালত থেকে তাঁকে ফোন করে বলা হয়, নুরুজ্জামানকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। এরপর তিনি স্বামীর অবস্থান নিশ্চিত হন।
আজ রাতে যোগাযোগ করা হলে ডিবি উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মো. আকরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নুরুজ্জামান উত্তর খান জামায়াতে ইসলামীর সদস্য। গত ২৯ জুলাই ভাঙচুরের ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা হয়।
নুরুজ্জামান ওই ভাঙচুরে জড়িত থাকায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠান।
প্রসঙ্গত, দেশের বিশিষ্টজনরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা কমে গেছে মনে হলেও আত্মতৃপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। নিষেধাজ্ঞা কিছুটা কমে গেলে এবং আগামী নির্বাচনের আগে আরো ভয়াবহভাবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা বাড়তে পারে।
সংশ্লিষ্ট এক প্রবন্ধে ড. আলী রীয়াজ বলেন, পাঁচ সদস্যের গবেষকদল ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন বছরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ৭১টি গুমের ঘটনা নিয়ে গবেষণা করে। এসব ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তারা প্রকৃতপক্ষেই গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১১ জন রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ১১ জন ব্যবসায়ী, আটজন ছাত্র, পাঁচজন ইসলামিক বক্তা বা মসজিদের ইমাম এবং তিনজন সাংবাদিক রয়েছেন। ৭১ জনের মধ্যে পাঁচজনের লাশ পাওয়া গেছে। ১৬ জন এখনো নিখোঁজ। ২৩ জন ফিরে এসেছেন এবং ২২ জনকে পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বা জেলে রয়েছেন। তিনি বলেন, এসব গুমের ঘটনার মধ্যে ৫২টির সাথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ২১টি অর্থাৎ ৪০ দশমিক ৩৮ ভাগ ঘটনায় র্যাব, ১৬টি ঘটনায় অর্থাৎ ৩০ দশমিক ৭৬ ভাগ ঘটনায় ডিবি পুলিশ এবং ১১ দশমিক ৫৩ ভাগ ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ড. আলী রীয়াজ বলেন, গুম মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। আমরা সরকারকে বলব ’৯২ সালের কনভেনশনে স্বাক্ষর করে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনুন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে গুমগুলোর বেশির ভাগই হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। যারা গুমের শিকার হয়েছেন তাদের কয়েকজন ফিরে এলেও তারা ভয়ে কোনো কথা বলেন না। এভাবে দেশে একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এ কারণে গত নির্বাচনে যারা দায়িত্বে ছিলেন গুম হওয়ার ভয়ে অনিয়ম দেখেও তারা কোনো বাধা দিতে পারেননি। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কমে গেলে এবং আগামী নির্বাচনের আগে আবারো গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা বাড়তে পারে। শুধু রাজনৈতিক কারণেই নয়; ব্যবসায়িক কারণেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে অনেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
তারা নিজস্ব বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ভাড়া করে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বর্তমানে যারা গুম করছেন পরিস্থিতি বদলে গেলে তারাও একদিন এ ধরনের ঘটনার শিকার হতে পারেন। এ জন্য তাদের উচিত এখনই সংযত হওয়া। একই সাথে দেশের সুশীল সমাজ, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদেরকে গুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, গুমের ঘটনাগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশি ঘটেছে। এতেই বোঝা যায় রাজনৈতিক কারণেই গুমের ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর গুম কমেছে এ জন্য আত্মতৃপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, বিদেশে থাকা সন্তানদের সমস্যার কারণে সাময়িকভাবে তারা থেমে গেলেও আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে গুমের ঘটনা আরো ভয়াবহ আকারে বাড়তে পারে। তিনি বলেন, পুলিশ অনেক ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে জানায়; কিন্তু তারা গুমের পর যারা ফিরে আসেন তাদের সাথে কথা বলে কেন জাতিকে জানাচ্ছেন না তারা এতদিন কোথায় ছিলেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের কারা ধরে নিয়ে যায় তা এখন দেশের ১৮ কোটি মানুষই জানে। বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় দেখা গেছে, প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই একই রকম বিবৃতি। অস্ত্র উদ্ধারে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির লোকেরা হামলা করলে দুই পক্ষের গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে সে মারা গেছে। তারা যদি এতই আধুনিক হন তাহলে তারা আগে থেকেই কেন জানতে পারেন না কারা হামলা করতে আসছে? তিনি বলেন, মূলত রাজনৈতিক কারণে বিরোধীমত দমন করতে এবং একধরনের ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, যাতে মানুষ সরকারের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে না পারে। রিজওয়ানা হাসান বলেন, মানুষ সাধারণত ডাকাতের মুখে পড়লে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে যায়; কিন্তু এ ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটছে। মানুষ এখন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ভয়ে থাকছে, যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি অশনিসঙ্কেত।
নূর খান লিটন বলেন, গবেষণায় সরকারের তৃতীয় মেয়াদের ঘটনা উঠে এসেছে। যখন সরকার কোনো বাধার মুখে নেই। এ সময়ই ৭১ জন গুমের শিকার হয়েছেন। তাহলে এর আগে আরো কত বেশি গুম হয়েছে তা অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, যারা ফিরে এসেছেন তারা কোনো কথা বলেন না। দু-একজন যারা কথা বলেছেন তারা জানিয়েছেন, তাদের এমন একটি জায়গায় রাখা হয়েছিল সেখানে বিমান ও ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। তাদেরকে সেখানে একটি গোপন কারাগারে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, শুধু সাদা পোশাকেই নয়, র্যাবের পোশাক পরেও গুমের ঘটনা ঘটেছে। অথচ পরে অস্বীকার করা হয়েছে। তিনি বলেন, কারা গুম করে মানুষ ঠিকই বোঝে। কারণ গুম হওয়ার পর থানায় গেলে পুলিশও মামলা নিতে চায় না; বরং তারাও নানা রকম ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে গুম এখন কিছুটা কমে গেলেও তা শেষ হয়ে যায়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনের আগে দেশে জঙ্গি ধরা এবং গুমের ঘটনা বাড়তে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ