চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে ১১ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ২৯৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের হিসাবে সর্বোচ্চ। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে ব্যয় কমিয়ে জনগণের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিতের কথা বললেও কর্ণপাত করছে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা নিয়ে যৌক্তিকভাবে ব্যয় নির্ধারণে মতামত দিয়েছে কমিশন।
চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে একটি নির্ভরযোগ্য যাত্রী ও মালামাল পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সাসেক চট্টগ্রাম পোর্ট অ্যাকসেস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারি অর্থায়ন দুই হাজার ৩১ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ এক হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভার জন্য পরিকল্পনা কমিশন তৈরি করা কার্যপত্রে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যুগ্ম প্রধান (সড়ক পরিবহন উইং) নিখিল কুমার দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি নিয়ে আমরা পিইসি সভা করেছি। প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ২৯৬ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। এ বিষয়ে সওজ-এর কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। সমসাময়িক প্রকল্পের সঙ্গে মিল রেখে ব্যয় প্রস্তাব করতে বলেছি। এখনো এটা ফাইনাল হয়নি।’
পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় একটি টোল প্লাজা ও ফ্যাসিলিটি এরিয়া নির্মাণের জন্য ২৮ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। টোল প্লাজায় কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে তা উল্লেখ নেই। সওজ-এর এমন ব্যয় প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।
সড়ক ও জনপথের সম্প্রতি প্রস্তাবিত আরও একটি প্রকল্পে এমন অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ একই অধিদপ্তরের চলমান চার লেনের প্রকল্পগুলোতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় একশ কোটির মধ্যেই রয়েছে।
মাওয়া একপ্রেসওয়ে এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে সুন্দর সড়ক হিসেবে পরিচিত। সেখানেও এত ব্যয় হয়নি, কিলোমিটারে খরচ হয়েছিল ১৮৩ কোটি টাকা। এছাড়া চার লেন করার জন্য ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ৮৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, ঢাকা-সিলেট প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ৮২ কোটি টাকা ও এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। তাই এ সংস্থার অধীনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রকল্পে ব্যয় এত বেশি হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।
প্রকল্পের নানা খাতের ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রস্তাবনায় ৫২ ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় স্ট্রাকচার কালভার্ট ২৬টি ৪৮৯.৩৫ মিটার, সেতু একটি ১৫৮.৩২ মিটার, ওভারপাস ৯টি ১৪২.১৮ মিটার, আরওবি একটি ৩৯১.১৬ মিটার, (চারটি স্লুইস গেট) নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে ৩৬৪.৫৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
২৮ হাজার ৬৫২ মিটার রোড মিডিয়ান ও লেন ডিভাইডার নির্মাণের জন্য ৬৭ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। সড়কের কন্সট্রাকশন সাইট ম্যানেজমেন্ট/মেনটেন্যান্স ও ইঞ্জিনিয়ারস সুপারভিশন অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল ফ্যাসিলিটিজ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা।
প্রকল্পে ইনস্টলেশন অব আইটিএস অ্যান্ড ওএফসি সিস্টেম খাতে এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা ও ১১ দশমিক ২২৫ লাখ ঘনমিটার মাটির কাজের জন্য ৬৮ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। ইউটিলিটি স্থানান্তরে প্রস্তাব করা হয়েছে ৭১ কোটি টাকা। এসব ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।
জানা যায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অর্থবিভাগের জনবল কমিটির সভায়ও প্রকল্পটির মোট ব্যয় ছিল দুই হাজার ২৮০ কোটি টাকা। কিন্তু হঠাৎ করেই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর আগেই এক হাজার ২০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রতি কিলোমিটারে ২৯৬ কোটি টাকা ব্যয় প্রসঙ্গে সওজ-এর প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) মূল্যায়ন চলছে। এখনো ডিপিপি চূড়ান্ত হয়নি, এটা একটা ইন্টারনাল বিষয়। এখনই কিছু ডিসক্লোজ করা ঠিক হবে না। নানা কারণে ব্যয় ধরা হয়। এটা বেশি হলে সরকার মূল্যায়ন করবে। সড়ক কোথাও উঁচু-নিচু কোথাও ব্রিজ দুই থেকে ছয় লেন হয়। কোথাও আবার ব্রিজ বেশি থাকে। এসব কারণেই মূলত ব্যয় বাড়ে। তবে সরকার যে মূল্যায়ন দেবে তাই আমরা মেনে নেবো।’
প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রাম পোর্ট অ্যাকসেস সড়কে অধিকতর সহজগম্যতা, নিরাপদ এবং কার্যকরী যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্জনের জন্য বিদ্যমান দুই লেনের ১১ দশমিক ৪৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চট্টগ্রাম পোর্ট অ্যাকসেস রোডের একপাশে সার্ভিস লেনসহ ৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার প্রথমাংশ ৬ লেনে এবং উভয়পাশে সার্ভিস লেনসহ ৩ দশমিক ৯৫০ কিলোমিটার পরের অংশ চার লেনে উন্নীত করা হবে।
সড়ক বিভাজক নির্মাণ, বাঁক সরলীকরণ এবং প্রধান সড়কে নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ প্রবেশ/প্রস্থান ব্যবস্থা নিশ্চিতের মাধ্যমে ৮০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে নিরাপদ যান চলাচল নিশ্চিত হবে। চট্টগ্রাম জেলার সালিমপুর ইউনিয়ন থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত ভ্রমণের সময় প্রায় ৫০ শতাংশ বা প্রায় ১৫ মিনিট কমবে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে ১ এপ্রিল ২০২৩ থেকে ৩০ জুন ২০২৮ মেয়াদে বাস্তবায়ন করবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর।
চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে একটি নির্ভরযোগ্য, দ্রুত ও নিরাপদ মালামাল পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে আন্তর্জাতিক করিডোরের মাধ্যমে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপন, মহাসড়কের উভয়পাশে আলাদা সার্ভিস লেন নির্মাণের মাধ্যমে স্থানীয় ধীরগতির যানবাহন চলাচলের (SMVT) জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সংকটাপন্ন সড়ক ব্যবহারকারীদের বয়স্ক, নারী, শিশু এবং অন্য অক্ষম ব্যক্তির জন্য নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করা, সেক করিডোর, বিমসটেক করিডোর ও সার্ক করিডোরের সঙ্গে আঞ্চলিক সংযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের কার্যক্রম বাড়ানো এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা।
আপনার মতামত জানানঃ