রাজা মাইডাসের গল্প আমরা অনেকেই জানি। যিনি কোনো কিছু স্পর্শ করলেই তা পরিণত হতো স্বর্ণে! গ্রীক পুরাণের সেই বিখ্যাত রাজা মাইডাসের নামেই নামকরণ করা হয়েছিল ৩,০০০ বছর পুরনো একটি শহরের। অনেকেরই ধারণা, এখানেই সমাধিস্থ আছেন রাজা মাইডাস। চলুন তবে জানা যাক, সেই মাইডাস শহর সম্পর্কে।
তুরস্কের এস্কেশেহির প্রদেশে অবস্থিত এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি স্থানীয়ভাবে ‘ইয়াজিলিকায়া’ নামেই পরিচিত, যার অর্থ ‘খোদাইকৃত পাথর’। তবে এই স্থানটি ‘সিটি অফ মাইডাস’ বা রাজা মাইডাসের শহর নামেই বেশি পরিচিত। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে ফ্রিজিয়ানরা এটি তৈরি করেছিল। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন, এটি আরো বেশি পুরনো। এখানে রয়েছে প্রায় ৩,০০০ বছর আগে খোদাই করা স্মৃতিস্তম্ভ, গুহা, ভূগর্ভস্থ সিঁড়ি, কূপ প্রভৃতি নিদর্শন।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এই স্থানটি শহর নামে পরিচিত হলেও কোনো কালেই এখানে কোনো জনবসতি ছিল না। বরং এটি ছিল তৎকালীন একটি ধর্মীয় তীর্থস্থান।
ফ্রিজিয়ানরা ছিল প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় একটি সম্প্রদায়। গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডটাসের মতে, ফ্রিজিয়ানদের বাস ছিল বলকান অঞ্চলের দক্ষিণে। তারা আনাতোলিয়ার স্থানীয় অধিবাসী নয়। অষ্টম শতাব্দীতে তারা প্রবাসী হিসেবে আনাতোলিয়ায় প্রবেশ করে এবং গর্ডিওতে তাদের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে।
ফ্রিজিয়ানদের সবচেয়ে প্রাচীন পৌরাণিক রাজা ছিলেন মাইডাস। রাজা মাইডাস ইতিহাসের এমন এক চরিত্র যার অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ গবেষকদের হাতে নেই। তবে গ্রীক পুরাণ ও বহু গল্পে এই রাজার কথা উল্লেখ রয়েছে। বহু ধন-সম্পদের মালিক এই রাজার কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। নিজের একমাত্র কন্যাকে নিয়ে বাস করতেন তিনি। একবার সাইলেনাস নামের এক বনদেবতার সেবা করায় খুশি হয়ে গ্রীক দেবতা ডায়োনিসাস তার একটি ইচ্ছা পূরণ করতে চান। মাইডাস ডায়োনিসাসের কাছে এমন ক্ষমতা প্রার্থনা করেন যাতে তিনি কোনো কিছু স্পর্শ করলেই তা সোনায় পরিণত হবে। ডায়োনিসাস মাইডাসের ইচ্ছা পূরণ করেন।
পরবর্তীতে মাইডাস তার নিজের কন্যাকে স্পর্শ করলে তার কন্যা স্বর্ণমূর্তিতে পরিণত হয়। মাইডাস তার ভুল বুঝতে পারেন এবং ডায়োনিসাসকে এই অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। পরে ডায়োনিসাসের নির্দেশে রাজা মাইডাস পেক্টোলাস নদীতে হাত ধুয়ে ফেলার পর স্বাভাবিক হয় সবকিছু।
পৌরাণিক এই গল্পের জন্যই রাজা মাইডাস বেশি জনপ্রিয়। সরাসরি তার অস্তিত্বের কথা ইতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে আসিরিয়ান কিছু লেখায় বর্ণিত অষ্টম শতাব্দীর এক রাজার সাথে মাইডাসের বর্ণনা মিলে যায়। মজার ব্যাপার হলো, তৎকালীন সময়ে ক্রমানুযায়ী ফ্রিজিয়ান রাজাদেরকে ‘মাইডাস’ বা ‘গর্ডিয়াস’ নামে ডাকা হতো। ফলে মাইডাস কারো নাম না হয়ে উপাধিও হতে পারে বলে ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা।
তৎকালীন সময়ে ফ্রিজিয়ানরা গর্ডিয়ায় তাদের রাজধানী স্থাপন করার পর ইয়াজিলিকায়ায় তাদের ধর্মীয় তীর্থস্থান স্থাপন করে। তবে তারা এখানে আসার আগে থেকেই এই স্থানের গুহা কিংবা পাতাল সিঁড়িগুলো এখানে ছিল কিনা তা সঠিক জানা যায়নি। তবে ফ্রিজিয়ানরা এখানে আসার পর তারা নানান নতুন স্থাপনা তৈরি করে ও আশেপাশের পাথর খুঁড়ে বিভিন্ন ধরনের নিদর্শনে পরিণত করে।
এই স্থানের বিভিন্ন নিদর্শনের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নিদর্শনটি হলো একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যেটি ‘রাজা মাইডাসের সমাধি’ নামেই বেশি পরিচিত। তবে সমাধি নামে পরিচিত হলেও এটির নিচে কোথাও কোনো সমাধির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটি মূলত পাথর খুঁড়ে বানানো ৩০ মিটার লম্বা ও ১৪ মিটার চওড়া একটি দেয়াল।
বাহির থেকে দেখে মনে হবে, এটি কোনো একটি অট্টালিকার প্রবেশদ্বার। এখানে একটি নকল দরজাও রয়েছে। যুগে যুগে বহু চোর ও লুটেরাদের আক্রমণে দরজাটি এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। চোরেরা মনে করতো, এই দরজার ওপারে হয়তো অজস্র ধন-সম্পদ লুকানো রয়েছে। দরজার উপরের অংশে কাউকে উৎসর্গ করে পরিষ্কারভাবে একটি লেখা খোদাই করা রয়েছে।
প্রাচীন ফ্রিজিয়ান ভাষায় এখানে লেখা রয়েছে,“মাইডাসের প্রতি, আর্কিয়াসের পুত্র- আত্রেস।” নিচের কুলুঙ্গির দেয়ালে লেখা রয়েছে “Matar” (mother) অর্থাৎ মা, যা দ্বারা ফ্রিজিয়ান দেবী ‘সাইবেলে’কে বোঝানো হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যার মূর্তি একসময় এই দেয়ালের সামনে রাখা হতো।
রাজা মাইডাসের সমাধি নামে পরিচিত এই স্থানের অন্যতম আকর্ষণীয় নিদর্শন হলো এখানকার পাথরে খোদাইকৃত সমাধিস্থান বা নেক্রোপলিস। মাইডাসের স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক দক্ষিণ দিকেই এটির অবস্থান। কিছু ফ্রিজিয়ান রাজসমাধি রয়েছে এখানে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখানে নানা ছড়ানো ছিটানো বেদী ও সিংহাসন খুঁজে পেয়েছেন, যা প্রমাণ করে একসময় এটি একটি ধর্মীয় স্থান ছিল। এছাড়াও এখানকার সবচেয়ে উঁচু জায়গায় একটি দূর্গ রয়েছে।
এই স্থানের সবচেয়ে অদ্ভুত ও রহস্যময় ব্যাপার হলো, আপনি যদি পাথরে খোদাইকৃত এই শহরের সবচেয়ে উঁচু স্থান, এই দুর্গে ওঠেন তবে আপনি আশেপাশের পাথরে খোদাইকৃত শত শত সিঁড়ি দেখতে পাবেন, যেগুলোর শেষপ্রান্ত কোনো পাথরের দেয়ালে গিয়ে শেষ হয়েছে কিংবা মাটির নিচে গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।
ধারণা করা হয়, যে সিঁড়িগুলো সরাসরি মাটির নিচে চলে গিয়েছে সেগুলো আসলে মাটির নিচের নানা সুড়ঙ্গ ও পাতাল পথের সাথে যুক্ত। বর্তমানে এসব সিঁড়ি ও সুড়ঙ্গপথের বেশিরভাগই মাটি ও পাথরের স্তুপে চাপা পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গবেষকরা মনে করেন, এগুলো মাটির নিচের কূপে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো। তবে কোনো কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদ মনে করেন, শুধু এ কাজেই নয়, বরং আরো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে এসব সিড়ি ব্যবহার করা হতো।
তারা মনে করেন এসব সিঁড়ি মাটির নিচের বহু গোপন শহরের সাথে যুক্ত ছিল। সম্প্রতি তুরস্কে এমন বহু মাটির নিচের শহরের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। ধারণা করা হয়, এসব সুড়ঙ্গ ও সিঁড়ি দিয়ে এসব শহরে প্রবেশ করা যেত। এছাড়াও ফ্রিজিয়ান ধর্মানুসারে, তাদের দেবতাদের বাস হলো মাটির নিচে পৃথিবীর অভ্যন্তরে। তাই ধারণা করা হয়, এসব সিঁড়ি হয়তো সেই দেবতাদের কাছে পৌঁছানোর জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। এসব সিঁড়িই হয়তো তাদের পৌঁছে দিতো রহস্যময় পাতালপুরীতে!
আপনার মতামত জানানঃ