প্রতিদিন কাঁচের তৈরি নানা রকম জিনিস আমরা ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু কাঁচ কিভাবে তৈরি হলো কিংবা ‘গ্লাস’ শব্দটিই বা আমাদের অভিধানে কোথা থেকে এলো, তা আমরা কয়জন ভেবে দেখেছি?
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় ‘ঘেল’ নামে একটি শব্দ ছিল, যার অর্থ ছিল ‘চকমকে বস্তু’। সেই শব্দ থেকেই পশ্চিম জার্মানিতে ‘গ্লাসাম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই শব্দটিই পরবর্তীতে ইংরেজিতে ‘গ্লেইস’ হয়ে যায়, যা থেকেই মূলত ‘গ্লাস’ শব্দটির উৎপত্তি।
২০০০ বছর আগে রোমান ভাষায় কাঁচের তৈরি কোনো কিছু বোঝাতে ‘ভিট্রিয়াম’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো, যা মূলত ল্যাটিন ভাষার ‘ভিট্রম’ শব্দটি থেকে উদ্ভূত।
গ্লাস তৈরির ক্ষেত্রে উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। আর সে কারণেই হয়তো মেটালোলজি বা ধাতুবিদ্যার সাথে কাঁচ তৈরির একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োগে যেখানে ধাতু তৈরি হতো, সেখানে কাঁচও তৈরি হতো।
মিশরের ‘কান্তির’ নামের এক জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ব্রোঞ্জের বড় বড় টুকরো বা ইনগটস পেয়েছিলেন। সেখানে কতোগুলো লাল ওপেক গ্লাসের ইনগটসও পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, ওই স্থানে মেটাল বা ধাতু এবং গ্লাস তৈরির কারখানা ছিল।
প্রাচীন রোমের প্লিনি দ্য এল্ডারের নাম তো সবারই জানা। তার কাজই ছিল কোনো কিছু নিয়ে গবেষণা করে নিজের পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করা। তার বই ‘ন্যাচারাল হিস্টোরি’-তে তিনি গ্লাস উৎপাদন সম্পর্কেও কিছু নোট লিখে রেখেছিলেন।
সেই নোট থেকে গ্লাস তৈরিতে ফিনিশিয়ার অবদানের কথা জানা যায়। ফিনিশিয়া ছিল বর্তমান ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যবর্তী একটি জায়গা। ফিনিশিয়ানরা ছিলেন জাত ব্যবসায়ী। তারা জাহাজভর্তি পণ্য নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। বাণিজ্য পথ দিয়ে চলার সময় তারা মাঝে মাঝে নদীর তীরে খাবার তৈরির জন্য আগুন জ্বালাতেন।
একবার খাবার তৈরি শেষে তারা দেখতে পেলেন যে, আগুনের নিচের বালুগুলো গলে গিয়ে গ্লাসের মতো কিছু বস্তুর আকৃতি তৈরি হয়েছে। এটিই ছিল গ্লাসের উৎপত্তি সংক্রান্ত সর্বপ্রথম দলিল, যা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে ১৭ শতাব্দীতে অ্যান্টনিও নিরিও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্লিনির লেখনীর সত্যতা প্রমাণ করেন। এছাড়াও ফ্লেভিয়াস জোসেফাসও একটি গল্প লিখে রেখে গিয়েছেন। ইসরাইলিরা একবার একটি জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।
ভয়ংকর সেই আগুনে মাটি, বালুকণা ও নাইটার গলে গিয়ে ঢালু অঞ্চল বেয়ে গ্লাসের মতো কিছু জিনিস সামনে এসেছিল। ওই বিধ্বংসী ঘটনার মাধ্যমেও গ্লাস তৈরির আরও একটি ইতিহাস আমরা খুঁজে পেয়েছি।
এখন জানা যাক পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম অর্গানাইজড লাইব্রেরী গড়ে তোলা অ্যাসিরীয় সম্রাট আশুরবানীপালের গল্পটি। আজ থেকে প্রায় ২৭০০ বছর আগে আশুরবানীপাল কতোগুলো কাদামাটির ট্যাবলেটে সে সময়ে ব্যবহৃত গ্লাস তৈরির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি লিপিবদ্ধ করেছিলেন, যা পরবর্তীতে প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছিলেন।
সেই ট্যাবলেটগুলো আজও ব্রিটিশ লাইব্রেরি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। আশুরবানীপালের লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৬০ ভাগ বালুর সাথে ১৮০ ভাগ উদ্ভিজ্জ ছাই এবং ৫ ভাগ চক উত্তপ্ত করলে যে বস্তুটি তৈরি হয়, তা হলো কাঁচ।
আশুরবানীপালের রাজত্বকালে এভাবেই কাঁচ তৈরি করা হতো। সামুদ্রিক শৈবালের ছাইয়ে সোডা অনেক বেশি মাত্রায় থাকে। আবার উদ্ভিজ্জ কাঠের ছাইয়ে অধিক মাত্রায় থাকে পটাশিয়াম এবং লাইম। তাই বিভিন্ন ধরনের গ্লাস তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদানের ছাই ব্যবহার করে হরেক রকম বৈচিত্র্যময় গ্লাস তৈরি করা হতো।
কপার যুক্ত করে নীল রং, ম্যাঙ্গানিজ যুক্ত করে গোলাপি রং, সালফার যুক্ত করে হলুদ রং এবং আয়রন যোগ করে হালকা সবুজ রঙের কাঁচ তৈরি করা হতো। যোগ্য শাসক আশুরবানীপাল এই সমস্ত কিছুই লিপিবদ্ধ করে তার লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করেছিলেন।
পরবর্তীতে অবশ্য কাঁচ তৈরিতে এই ছাইয়ের পরিবর্তে ন্যাট্রামের ব্যবহার শুরু হয়। মিশরের ওয়াদি-এল-ন্যাট্রান নামের একটি জায়গার হ্রদ এলাকায় সংঘটিত বন্যার পানি সূর্যের তাপে বাষ্পীভূত হওয়ার পর কিছু খনিজ বস্তু পাওয়া যায়। এদের নামই দেয়া হয় ‘ন্যাট্রাম’।
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ সালের দিকে মেসোপটেমিয়ার কয়েকজন কুমার মাটির পাত্র তৈরির সময় পাত্রের উপর একটি পাতলা চকমকে আবরণ লক্ষ করেন। এটিই ছিলো গ্লাসের প্রথম পর্যবেক্ষণ। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালের দিকে মিশরে এক ধরনের কাঁচ তৈরি করা হয়, যাকে বলা হয় ‘ফায়েন্স’। ছোট ছোট বস্তুগুলোকে এই ফায়েন্সের প্রলেপ দিয়ে তৈরি করা হতো।
গলায় পরার মালা তৈরির বিডস বা পুঁতি, বোতল ও মূর্তিসহ নানা রকম বস্তু তৈরিতে তারা ফায়েন্স ব্যবহার করতেন। খুবই জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল ফায়েন্সের তৈরি পুঁতিগুলো। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সালে মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন জায়গায়ও এই পুঁতিগুলো পাওয়া গিয়েছে। ধীরে ধীরে এই বিডস বা পুঁতিগুলো সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে। ডেনমার্ক এবং সাইবেরিয়াতেও পাওয়া গিয়েছে এগুলো।
সমাধি তৈরি ও তাতে বৈচিত্র্যময় প্রত্নবস্তু সংরক্ষণের সংস্কৃতির কারণে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মিশর এবং মেসোপটেমিয়াতেই কাঁচের তৈরি বস্তুগুলো সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া গিয়েছে এবং এর ফলেই আজ এতো বছর পরও আমরা খুব সহজেই এসব বস্তুর ধরন সম্পর্কে বিস্তরভাবে জানতে পারছি। হাজার বছর ধরে এই সমাধিগুলো বহুবার লুটের শিকার হলেও যতোটুকু রয়ে গিয়েছে, সেটাই আমাদের অতীত ইতিহাস উন্মোচনের জন্য যথেষ্ট।
খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ সালের দিকে তৈরি প্রথম কাঁচের তৈরি বস্তুটি কিন্তু মিশরেই পাওয়া গিয়েছিল। প্রচুর কাঁচের তৈরি ফুলদানি ও ছোট বোতল মিলেছে মিশরের সমাধিগুলোতে। মাটি ও আরো কিছু উপাদান দিয়ে তারা একটি ছাঁচ বানাতেন এবং ঐ ছাঁচটিকে ক্রমাগত গলিত গ্লাসের ভেতরে ঢোকানো ও বের করা হতো, যতোক্ষণ পর্যন্ত না ছাঁচের বাইরে একটি আস্তরণ তৈরি হয়। আস্তরণ তৈরি হয়ে গেলে ভেতরের ছাঁচটিকে ভেঙে বের করা হতো কাঁচের বোতল বা ফুলদানি।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালে সিরিয়ায় আবার নতুনভাবে কাঁচের ফুলদানি তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার হয়। একটি লম্বা নলের শেষ প্রান্তে নরম কাঁচ লাগিয়ে নলের অপর প্রান্ত থেকে ফুঁ দিয়ে কাঁচকে প্রসারিত করে নানা আকৃতির কাঁচের বস্তু তৈরি শুরু করেন সিরিয়ানরা। ফাঁপা কাঁচের পাত্র তৈরির এই প্রক্রিয়া এক পর্যায়ে সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়তা পেলো। আজও এই পদ্ধতিতে হ্যান্ডমেইড গ্লাস অবজেক্টস তৈরি হচ্ছে।
মিশরের আমার্না চিঠির কথা তো আমরা সবাই জানি। আমার্না যুগে মিশরীয় ফারাওরা বৈদেশিক বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার্থে বহিঃর্বিশ্বের সাথে যে সব চিঠি আদান-প্রদান করতেন, সেগুলো সব আলাদা আলাদা কাদামাটির ট্যাবলেটে লিপিবদ্ধ করে আমার্না শহরে সংরক্ষণ করা হতো। এমনই কতোগুলো আমার্না চিঠি একজন গ্রাম্য নারী খুঁজে পেয়েছিলেন সেই স্থানে, যেগুলো থেকে জানা যায়, মিশরীয় ফারাওরা বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে মিশরে কাঁচের টুকরো পাঠানোর জন্য অনুরোধ করতেন। আসলে সে সময় কাঁচ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। সোনা কিংবা রূপার মতোই কাঁচও বহুমূল্যবান বস্তু ছিল।
এবার একটি মজার গল্প শুনুন। রোমান সম্রাট টাইবেরিয়াস সিজারকে খুশি করার উদ্দেশ্যে একজন ব্যক্তি এক বার বিশেষ কাঁচের তৈরি একটি পানপাত্র নিয়ে আসেন তার সামনে, যেটি পড়ে গেলে ভেঙে যায় না এবং সংকোচন-প্রসারণযোগ্য।
এমন অদ্ভূত কাঁচের পাত্র এর আগে কেউ কখনো দেখেন নি, যা বাঁকানোও সম্ভব। টাইবেরিয়াস সিজার নিজেও খুব অবাক হলেন এবং জানতে চাইলেন যে, এই আবিষ্কারের কথা আর কেউ জানেন কি না। তখন সেই ব্যক্তি জানান যে, এটি নিতান্তই তার নিজের আবিষ্কার এবং এটি সম্পর্কে এখনও কেউ কিছুই জানেন না। এ কথা শুনে সম্রাট তৎক্ষণাৎ সেই আবিষ্কারক ব্যক্তিটিকে গলা কেটে হত্যার নির্দেশ দিলেন।
এতে সম্রাটের সভাসদেরা অবাক হয়ে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন যে, যে কাঁচ তিনি সোনা-রূপার দামে বিক্রি করছেন, সেই কাঁচ যদি কোনো দিন না ভাঙ্গে, তাহলে বাজার অর্থনীতিতে ধ্বস নেমে আসবে। এই অর্থনৈতিক ক্ষতি সম্রাটের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না।
সংকোচন-প্রসারণশীল বিশেষ কাঁচ তৈরির এই পদ্ধতি সে সময় রোমান সম্রাট বন্ধ করে দিলেও ১৯০০ সালের পর সেটি আবারও আমাদের কাছে ফিরে আসে। ১৯৪৩ সালে ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণকারী স্কটিশ আর্টিস্ট হেলেন মনরো ও ‘টার্নার মিউজিয়াম অফ গ্লাস’ এর প্রফেসর ই. এস. টার্নারের বিয়েতে হেলেন যে ব্যতিক্রমী পোশাকটি পরেছিলেন, তা মূলত সেই বিশেষ কাঁচেরই তৈরি ছিল।
আসলে এটি হলো ফাইবার গ্লাস, যা ধীরে ধীরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ অপটিক্যাল ফাইবারে রূপ নিয়েছে। এই যুগের যুগান্তকারী ইন্টারনেট সেবা আমাদের ঘরে এসে প্রবেশ করেছে এই অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমেই। নমনীয় গ্লাসের অগ্রযাত্রাকে এক সময় হেলায় বন্ধ করে দেয়া হলেও আজ এই বস্তুই আমাদের জীবনকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
আপনার মতামত জানানঃ