চ্যানেল আইতে প্রচারিত পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সর্বাধিক জনপ্রিয় আয়োজন ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানের উনিশ বছরে পদার্পণে বিশেষ মুহূর্তে স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। উপস্থাপনায় ছিলেন মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী।
শুক্রবার রাতে সরাসরি প্রচারিত এই বিশেষ অনুষ্ঠানে উঠে আসে রাজনীতির চালচিত্র ও সংকট নিরসনে নাগরিক সমাজের ভূমিকা। আলোচনার চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী চিন্তা করলে এর কোনো কূল পাই না। এর কারণটা হলো যে, বাংলাদেশে যতগুলো দল আছে তারা দুইটা মেরুতে আছে। যারা একে অপরকে কাউন্টার করতে পারে এবং সরকার গঠনের ক্ষমতা রাখে।
বাকি যারা আছেন রাজনীতিতে আছেন, অনেকে পুরনো আছেন, অনেকে আবার নতুন আসছেন। তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে বলতে পারছি না। আমাদের দেশে এখন যে অবস্থা এই অবস্থাতে এতে দেশি-বিদেশি, বিদেশি বলতে পাশের বাড়ির কথাও আছে। অনেক কিছু ঘটছে।
ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি বড় আর্টিকেল দেখলাম। সেটাও আমার কাছে আশ্চর্য লেগেছে। কারণ একটি দেশের বিষয় নিয়ে এরকম খোলাখুলি বলাটা এ পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে কতোটা সহায়ক হবে সেটা আমার বোধগম্য নয়। আমি যেটা দেখতে পাচ্ছি, এটা খুবই জটিল ইস্যু। কারণ দেশে যারা শীর্ষ রাজনীতিবিদ আছেন তাদের মাঝে কেউ কাউকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা নেই।
মনে হচ্ছে যেই ছাড় দিতে যাবেন, সেই মনে করেন আমার দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। নির্বাচন যদি সঠিকভাবে হয় তাহলে ভালো দিক আর নির্বাচন যদি সঠিকভাবে না হয় দেশে আরও খারাপ অবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কাজেই আমি এই রাজনীতিটা সামনে আরও ঘোলাটে হতে দেখছি এবং সেখানে ভেতরে তো আছেই, বাইরের তৎপরতাও বাড়বে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বর্তমানে আর অভ্যন্তরীণ নেই।
আমি যদি এক কথায় বলি এটা এখন আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমি রাজনীতিবিদদের দায়ী করবো। কিছুদিন আগে ব্রিকস নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তখন শুনলাম বাংলাদেশ ব্রিকসে যোগদান করছে। এখন আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, আমরা ব্রিকসে যাচ্ছি না। আমি যেটা জানি ভারত-চীনের টানাটানি শুরু হয়েছে।
এখন আপনি কোন পাল্লায় গিয়ে পড়বেন। চাইনিজ পাল্লায় পড়বেন নাকি ইন্ডিয়ান পাল্লায় পড়বেন। ভারতের স্পষ্ট কথা- বাংলাদেশকে চীনের মাধ্যমে ব্রিকসে যোগদান করতে দিবো না। মানে চাইনিজ পাল্লা ভারী হতে দিবো না।
আমাদের দেশে এখন সিভিল সোসাইটি বলে কিছু নেই। এখন সবাই বিভক্ত। যেখানে যে সুযোগ পায় সেইদিকে ঝুঁকে পড়ে। সেই জায়গা থেকে নাগরিক সমাজ এখন কতোটা সোচ্চার হবে সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এখানে যারা একটু অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করছেন সেখানে কিছু না কিছু বাধা আসছে।
আমাদের দেশের সিভিল সোসাইটি এত দুর্বল তারা কোনো চাপ তৈরি করতে পারছে না। আমি আশাবাদী নই যে, নির্বাচন কমিশনের বর্তমান যে পরিস্থিতি সেই প্রেসার মোকাবিলা করতে পারবে এবং এই অবস্থায় একটি নির্বাচন করাতে পারবে।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মানুষের সাফল্যের কিছু দায় থাকে, প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়। সেই প্রত্যাশাকে পূরণ করাটা খুবই কষ্টকর। বাংলাদেশের মানুষের বিশেষ করে যে পরিস্থিতি বর্তমানে জাতীয়ভাবে, আঞ্চলিকভাবে ও বৈশ্বিকভাবে যা চলছে। তাই মানুষ অনেক কিছু আকাক্সক্ষা নিয়ে টিভির পর্দার সামনে বসে। কিন্তু সব সময় আমরা সবাই তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারি কিনা- এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেই জায়গাটাতে আমরা কী করতে পারি?
আগামী দিনের ভূমিকাটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হলো আমরা বলি যে, রাজনীতিবিদদের আগামীর ভূমিকার কথা। কিন্তু এটাও ঠিক যে, সেই সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের ভূমিকাটাও আগামীতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আসবে। তাদের চাহিদাটা আরও বাড়বে। রাজনীতির যে বিষয়টি বাংলাদেশে চলছে এটা প্রথম নয়। এরকম ঘটনা আমরা ১৯৯০, ’৯৬ ও ২০০৬ সালেও মোকাবিলা করেছি। আমাদের এমন একটি পরিস্থিতি মোকাবিলার কোনো অভিজ্ঞতা নেই- এমন কিন্তু না।
এবং এই তিনটি ঘটনার মধ্যে দুইবার আমরা সফলভাবে এর সমাধানও করেছি। এরশাদের পদত্যাগ ও পরবর্তীতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সফল নির্বাচনের মাধ্যমে এর সমাধান হয়েছিল। ২০০৬ সালে যে ধরনের বাজে নির্বাচন হয়েছিল তার মধ্য দিয়েও একটি কেয়ারটেকার সরকারের বিল আমরা পাস করেছিলাম।
কিন্তু এরপরে এই প্রক্রিয়াকে যখন আমরা এগুতে দেইনি উপরন্তু কেয়ারটেকার সরকারকে আমরা বিতর্কিত করেছি। তখন আমাদের আলোচনার প্রক্রিয়া ভেঙে গেছে। আপনি যদি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে সহজ না করেন, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে প্রক্রিয়াটা ভেঙে পড়ে। এখন বিষয়টি হলো আমরা কি এই ব্যবস্থা ভাঙার দিকে যাচ্ছি? নাকি আমরা একটা সুরাহার ভেতরে থাকবো?
যখন এরকম রাজনৈতিক সমস্যা বা সংকট আসে তখন রাজনীতিবিদরা একা একা সমাধান করতে পারে না। তখন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শক্তি এটার সঙ্গে কাজ করে। নাগরিক সমাজ থাকে, পেশাজীবীরা থাকে, ব্যবসায়ীরা থাকে, অনেক সময় প্রশাসনের ভেতরে উর্দি পরা লোকেরাও থাকে।
তখন দেখা যায় একটা সমাধান আসে। একটি বিষয় হলো বিদেশিরা সবসময়ই এসেছে। এখনো বিদেশিরা আসবে কিন্তু তারা কখনো কোনো সমাধান দিতে পারবে না। আবার অনেকে সংলাপের কথা বলে।
এখানে সংলাপ যদি শুধুমাত্র সংলাপ বা আলাপ করার জন্য হয় তাহলে এতে কোনো ফল দেয় না। কারণ অতীতে আমরা দেখেছি মান্নান ভুঁইয়া আর জলিল ভাই দিনের পর দিন বসেছে। তাতে কোনো ফল আসেনি। প্রথমত, রাজনীতির বাইরে যেসব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীরা আছে।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যারা সংলাপের ভেতরে ঢুকতে চান। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যে বন্ধুরা আছেন তারাও লোকদৃষ্টির আড়ালে একটি আলোচনা করতে পারেন। তাই আমি বলবো লোক দেখানো সংলাপের নামে সংলাপ করে কোনো লাভ নেই। এখন ওই জায়গাটিতে আমরা এখনই পৌঁছেছি কিনা সেটা নির্ভর করবে দৃশ্যমানভাবে রাজপথে জনমানুষের মতামত প্রকাশিত হলে।
যদি জনমানুষের মতামত প্রকাশিত হয় তাহলে সেটার বাতাবরণে লোকচক্ষুর অন্তরালে আলোচনা হয়। আমি তো সেরকম একটি পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছি। আমি দেখছি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে, জটিল হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে যদি জনমানুষের মনোভাব প্রকাশের জায়গা না থাকে তাহলে সাংঘর্ষিক অবস্থার দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সহিংসতা যদি সৃষ্টি হয় তাহলে রাষ্ট্রের এবং নাগরিকের বিরাট ক্ষতি হয়।
রাষ্ট্রের ভেতর যদি নাগরিক সমাজ দুর্বল থাকে তাহলে রাষ্ট্রকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। যেটুকু নাগরিক সমাজ আছে সেটুকুও তো আমরা সহ্য করতে পারছি না। অনেক সময় যারা নিজেকে নাগরিক সমাজ বলে আসলে তারা রাজনৈতিক সমাজ। কারণ তারা এমন বেশি দলীয় রাজনীতির ভেতর ঢুকে গেছেন সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নাগরিক প্রতিনিধি পরিচয় দেয়া সম্ভব না।
নাগরিক সমাজের সংজ্ঞা হলো, রাষ্ট্রের ভেতরে রাজনীতির সঙ্গে দলীয় মতের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। আপনি যদি স্বাধীন না থাকেন মনের দিক থেকে দলীয়ভাবে তাহলে কোনোভাবেই আপনি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হতে পারবেন না। তার অর্থ এই না যে, আপনার মূল্যবোধ থাকবে না। আপনি মানবতার পক্ষে থাকবেন, আপনি গরিব মানুষের পক্ষে থাকবেন, স্বাধীনতার পক্ষে থাকবেন কিন্তু তার অর্থ এই না যে, আপনি নির্দিষ্ট দলের পক্ষে থাকবেন।
আমরা অনেক সময় দেখি কেউ একজন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদলে নিজেকে পরিচয় দেন আসলে তিনি একজন রাজনৈতিক দলেরই উপ-দল হিসেবে সেখানে উপস্থিত হন। এটাও নাগরিকদের সচেতন থাকার দরকার আছে স্বাধীনভাবে এই মানুষটি আছে কি নেই? নাগরিক সমাজ যখন ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অংশ হয়ে যায় তখন আর সে নাগরিকদের পক্ষে থাকে না, তখন দলের পক্ষ হয়ে যায়। নাগরিক সমাজ যেন কোনো দলের না হয়ে প্রকৃত নাগরিকের কণ্ঠস্বরটা ধরে রাখতে পারে। তবেই দেশের কল্যাণ হবে।
এসডব্লিউএসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ