পৃথিবীর সকল মানুষের মস্তিষ্ক একইভাবে কাজ করে না। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মস্তিস্কের কর্মক্ষতা আর একজন সাধারণ সরকারী চাকুরে কর্মজীবির মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা নিশ্চয় একই সমান নয়। তাহলে কাদের মানুষ বলতে হবে সেটা কীভাবে বুঝবো? কারো শরীরে রক্ত-মাংসের অঙ্গের বদলে যদি কৃত্রিম অঙ্গ থাকে, তাহলে কি তাকে মানুষ বলা যাবে? মস্তিষ্ককে উন্নত করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার করলে মানুষের লক্ষণ থাকবে না? যে হারে কম্পিউটার প্রযুক্তি ও বায়োমেডিসিনের উন্নতি হচ্ছে, তাতে একসময় এসব প্রশ্ন সামনে আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমন কি হতে পারে যে, এসব উন্নতির কবলে পড়ে মানুষ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং দীর্ঘস্থায়ী একটি জীবনের মালিক হওয়া সত্ত্বেও দিন দিন একাকী এবং নিরাশ জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়বে?
বিজ্ঞান জগতে অদূর ভবিষ্যতের এমন সব অবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ‘ট্রান্সহিউম্যানিজম’-এ।
ট্রান্সহিউম্যানিজম হলো সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক মুভমেন্ট, যা বিশ্বাস করে- মানুষ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থা উন্নত করতে পারবে। আরেকটু ভেঙে বললে, এই ট্রান্সহিউম্যানিজম হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ন্যানোটেক, ক্লোনিং এবং এই ধরনের প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষের শারীরিক এবং মানসিক সামর্থ্য উন্নত করা।
আর এই বিকাশ একজন মানুষের স্বাভাবিক সামর্থ্যের তুলনায় অনেক বেশি এবং উন্নত। তাই এই ধরনের উন্নত মানুষদের আলাদা করে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্রান্সহিউম্যান’। আর যারা এই মতবাদে বা মুভমেন্টে বিশ্বাসী বা এর লক্ষ্যে কাজ করছে তাদের বলা হয় ‘ট্রান্সহিউম্যানিস্ট’।
মানুষ বা হিউম্যানকে ট্রান্সহিউম্যান করার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুরু হয়ে গেছে। যেমন: ইউএস মিলিটারি ক্যাম্পে স্পাইনারদের ট্রেনিং দেওয়ার সময় তাদের ট্রান্সক্র্যানিয়াল ডাইরেক্ট কারেন্ট স্টিম্যুলেশন (টিডিসিএস) দেওয়া হয়, যা তাদের মস্তিষ্কে দুর্বল ইলেকট্রিক কারেন্টের মাধ্যমে শেখার গতি এবং প্রতিক্রিয়ার সময় দ্রুত করে। এটা ট্রান্সহিউম্যানিজমের ‘সুপার ইন্টেলিজেন্স’ নীতির অন্তর্ভুক্ত।
ট্রান্সহিউম্যানিজমের তিনটি মূল নীতি রয়েছে- সুপার লংজিভিটি, সুপার ওয়েল-বিঙ এবং সুপার ইন্টেলিজেন্স।
সুপার লংজিভিটি
ট্রান্সহিউম্যানিস্টদের মতে, সুপার লংজিভিটি বা অতিরিক্ত দীর্ঘায়ু সম্ভব, যদি শরীরের আগে থেকেই ঠিক করা আত্মহনন প্রক্রিয়া বন্ধ করা সম্ভব হয়। সাধারণত একজন ব্যক্তি ২০ বছর বয়সে পা রাখতেই তার দেহের আত্মহননের চক্র ঘোরা শুরু হয়ে যায়।
অর্থাৎ বয়স্ক হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, যা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য হলো এই আত্মহননের চক্র বন্ধ করে দিনে ২৪ ঘণ্টার বেশি আয়ুকাল বাড়ানো। বর্তমানে পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ১২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকা সম্ভব। ট্রান্সহিউম্যানিজমের মাধ্যমে ১,০০০ বছর পর্যন্ত পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব বলে তাদের ধারণা।
সুপার ওয়েলবিঙ
সুপার ওয়েলবিঙ বা অতিরিক্ত সুস্থ থাকা ট্রান্সহিউম্যানিজমের দ্বিতীয় নীতি। উল্লেখ্য, ‘সুস্থতা’ বলতে মূলত ‘শারীরিক সুস্থতা’র উপরই আলোকপাত করা হয়েছে। একটু আগেই বলা হলো যে, দুর্ঘটনা বা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা বাদে সাধারণত মানুষ দুটি কারণে মানুষ মারা যায়। বৃদ্ধ হওয়ার কারণে, আর অসুস্থতার কারণে।
বৃদ্ধ হওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যে সুপার লংজিভিটিতে বলা হয়েছে। এখন মানুষের আয়ু বাড়াতে হলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোও অতি প্রয়োজন। আমরা আসলে এই ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা সবসময়ই করি। যেমন- একসময় অল্প ঠাণ্ডা পড়লেই মানুষ তা সহ্য করতে পারতো না। অনেকে মারাও যেত।
কিন্তু এখন মোটা জামা-কাপড়, সোয়েটার, কম্বলের আগমনের পর শীত সহ্য করার ক্ষমতা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। ফলে ঠাণ্ডায় মারা যাওয়ার হারও কমেছে। দিনে দিনে পাতলা কিন্তু বেশি গরম কাপড় তৈরির চেষ্টা চলছে। এই সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য একটাই। মানুষকে সুস্থ থাকতে সহায়তা করা।
ঠিক একইভাবে চিকিৎসাক্ষেত্রেও একের পর এক নতুন ঔষধ আবিষ্কার এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দেহে কৃত্রিম কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মানুষের দৈহিক সুস্থতা বৃদ্ধি করা যায়। পঙ্গুত্বের হাত থেকে বাঁচাতে কৃত্রিম পা, অন্ধত্বের হাত বাঁচাতে কৃত্রিম রেটিনার ব্যবহার নতুন নয়।
তাছাড়া এসব কৃত্রিম অঙ্গ যেন প্রাকৃতিক অঙ্গের চেয়েও ভালো সার্ভিস দেয় সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। ফার্মাসিউটিক্যাল এবং বায়োটেকনোলজির উন্নতির ফলে এমন শিশুদের পৃথিবীতে আনা সম্ভব, যারা মা-বাবার শুধুমাত্র ভালো জেনেটিক বৈশিষ্ট্যগুলোই ধারণ করবে। এতে করে জন্মের পরপরই কোনো রোগ, স্থূলতা এবং হতাশার ফ্যাক্টরগুলো শিশুরা পাবে না। ট্রান্সহিউম্যানিস্টদের মতে, একসময় নেতিবাচক অনুভূতিও সরিয়ে দেওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধি পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
সুপার ইন্টেলিজেন্স
ট্রান্সহিউম্যানিজমের তৃতীয় নীতি হলো সুপার ইন্টেলিজেন্স। ট্রান্সহিউম্যানিস্টরা বিশ্বাস করেন, মানুষের মস্তিষ্ক উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাদের মতে, প্রযুক্তির মাধ্যমে মস্তিষ্কের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। তাই মস্তিষ্কের স্বাভাবিক সক্ষমতায় সন্তুষ্ট না থেকে একে উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পুরো মস্তিষ্ককে শক্তিশালী কম্পিউটারে পরিণত করার মতো ব্যাপার আর কী।
সুপার ইন্টেলিজেন্স বলতে এমন সব জ্ঞান এবং দক্ষতাকে বোঝানো হয় যা মানুষের জানাশোনা বা চিন্তার বাইরে। এর মাধ্যমে ‘টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি’ সৃষ্টি হতে পারে। প্রযুক্তিগত বৃদ্ধি অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিবর্তনীয় হয়ে পড়লে মানবসভ্যতায় বিপুল ও অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসা সম্ভব।
ভবিষ্যতের সেই অবস্থাই হলো টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি। এটি বিজ্ঞানকে দ্রুত এমন এক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে যা সম্পর্কে কখনো ভাবাই সম্ভব ছিল না। এত আবিষ্কার, এত জ্ঞান, এত উন্নতি; সবকিছুতেই কাজ করে মানুষের বুদ্ধি।
আর এসব বুদ্ধির উৎস তথা মস্তিষ্ককে উন্নত করা গেলে যে এসব আবিষ্কার ও উন্নতির সংখ্যাও বাড়বে তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। আর এর সহায়তায় মানুষেরা নিজেরাই ‘সুপার লংজিভিটি’ এবং ‘সুপার ওয়েলবিঙ’-এর নীতি পূরণ করতে পারবে। মানুষের মন বা অনুভূতিকে মস্তিষ্ক থেকে নিয়ে কম্পিউটারে ডাউনলোড করা সম্ভব হবে।
উন্নত মাইক্রোপ্রসেসর বা এ ধরনের প্রযুক্তি এই কাজে সহায়তা করতে পারবে। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশের চেষ্টায় আছেন। অবশ্য এর ফল কতটা লাভজনক হবে সেটাই এখন ভাবার বিষয়।
এসডব্লিউএসএস১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ