বড় পরিবর্তন আসছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দৃশ্যপটে। কারণ ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স পেতে উদ্যোগ নিয়েছে প্রথাগত ফিজিক্যাল ব্যাংক, মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রদানকারী ও টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলো। গত ২১ জুন ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন নেওয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত প্রায় এক মাসে ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) প্রায় ৬০টি নামের ছাড়পত্র আবেদন জমা পড়েছে। এসব আবেদনের মধ্যে এক ডজনেরও বেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, অন্তত দুটি এমএফএস প্রদানকারী ও দুটি মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর রয়েছে।
অনলাইন আবেদনের সময়সীমা ১ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক আবেদন পায়নি। তবে বাণিজ্য সংস্থাগুলোর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনের সময় আরও এক মাস বাড়ানো হতে পারে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ব্যাংকাররা বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রতি ক্রমেই আগ্রহ বাড়তে থাকায় ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ কীভাবে বদলে যাবে—যেমন: কতগুলো লাইসেন্স দেওয়া হবে, এসব ব্যাংকের অপারেশনাল ফ্রেমওয়ার্ক, প্রথাগত ব্যাংকিংয়ের কর্মসংস্থানের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব, এসব ব্যাংক যেসব পণ্য দেবে—তা নিয়ে ব্যাংকাররা ভাবছেন।
ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের কাজকর্ম মূলত ওয়েবসাইট বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে করা হয়। অনেক প্রথাগত ব্যাংক ক্রমেই এ প্রযুক্তি গ্রহণ করছে। এটি ব্যাংকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা উভয়ের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে: প্রথাগত ফিজিক্যাল ব্যাংকের সঙ্গে ডিজিটাল ব্যাংকের পার্থক্য গড়ে দেয় কোন জিনিসটি?
একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘ডিজিটাল ব্যাংক ও প্রচলিত ব্যাংকের মধ্যে অপারেশনাল পার্থক্য ন্যূনতম। তারপরও প্রায় সব ব্যাংকই যৌথ উদ্যোগে ডিজিটাল ব্যাংকিং জগতে প্রবেশ করার কথা ভাবছে।’
এছাড়া দুটি প্রধান টেলিকম অপারেটরও ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলালিংকের চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তৈমুর রহমান বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ দিকে এগিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ।
তিনি বলেন, ‘বাংলালিংক সবসময় গ্রাহকদের উন্নততর সেবা দিতে চায় এবং অন্যদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।’ তবে আবেদনের জন্য সময় একেবারেই কম দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর জন্য আগ্রহী পক্ষগুলো চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে।
গ্রামীণফোনের মুখপাত্র হোসেন সাদাত বলেন, আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের আওতায় আনতে এবং দেশের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ভিশন অর্জনে অবদান রাখতে তাদের কোম্পানি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, ‘সেজন্য (ডিজিটাল ব্যাংকের) গাইডলাইনটি মূল্যায়ন করার সময় আমরা ভবিষ্যতের উপযোগী ডেটা নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার ওপর ফোকাস রেখে আমাদের নেটওয়ার্কের আধুনিকীকরণ চালিয়ে যাব। এটি গ্রাহক ভ্যালু বাড়ানোর পাশাপাশি দেশের এক নম্বর নেটওয়ার্ক হিসেবে আমাদের অবস্থানকে মজবুত করবে।’
যৌথ উদ্যোগে ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের কথা ভাবছে ব্যাংকগুলো শিল্পসংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে, নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক স্পন্সর যেহেতু সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিক হতে পারবে, তাই অনেক ব্যাংক যৌথ উদ্যোগে ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের জন্য অন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে।
যেমন, ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য একটি বিশেষ কনসোর্টিয়াম গঠনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি সাতটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা একটি সভা করেছেন। বৈঠকে উপস্থিত সূত্র থেকে জানা গেছে, আলোচনায় বসা ব্যাংকগুলো হলো: ইস্টার্ন ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও ডাচ-বাংলা ব্যাংক।
তবে এ ব্যাপারে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানায় সূত্র। এই সাত ব্যাংকের প্রত্যেকটিই অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গেও যৌথ উদ্যোগে ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের সুযোগ খতিয়ে দেখছে।
আরও কয়েকটি ব্যাংকের বোর্ডও ডিজিটাল ব্যাংকে অংশীদারত্বের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। এদিকে ব্যাংক এশিয়ার বোর্ড ইতিমধ্যেই একটি ডিজিটাল ব্যাংকে অংশীদারত্ব পেতে ১২.৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।
এছাড়া দেশের বৃহত্তম মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা বিকাশও ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগিতায় একটি ডিজিটাল ব্যাংকের নাম ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতাও ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পর্যন্ত কয়টি ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেবে, তা ঘোষণা করেনি।
তিনি বলেন, বুধবার পর্যন্ত কোনো আবেদন জমা পড়েনি। তবে আটটি আবেদনকারী ৫ লাখ টাকা ফি দিয়ে অনলাইনে আবেদনের জন্য লগ ইন করেছে। সংশ্লিষ্ট সমস্ত কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর তাদের সম্পূর্ণ আবেদন বিবেচনা করা হবে বলে জানান তিনি।
একজন শীর্ষ ব্যাংকার বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে সময় দেওয়া হয়েছে ৪১ দিন। কোম্পানি গঠনের জটিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য এই সময় পর্যাপ্ত নয়। এর ফলে এ সময়ে কোনো আবেদন জমা পড়েনি।
এদিকে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) ও ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) আবেদনের সময় বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করেছে।
ওই ব্যাংকার বলেন, প্রথাগত ব্যাংকগুলোই এখন নানা ধরনের ডিজিটাল সেবা দেয়—ফলে গ্রাহকদের সশরীরে ব্যাংকের শাখাগুলোতে যাওয়ার প্রয়োজন কমে গেছে। তবে ব্যাংকগুলোর বিস্তৃত ব্রাঞ্চ নেটওয়ার্কের আকার কমানো ও এর সঙ্গে যুক্ত জনবলকে পরিচালনার জন্য সতর্ক পরিকল্পনা ও সময় প্রয়োজন।
স্মার্ট সেবার চাহিদা ক্রমেই বাড়তে থাকায় প্রথাগত ব্যাংকগুলো সম্পূর্ণ ডিজিটাল মডেলে স্থানান্তরিত হতে ধীরে ধীরে তাদের ব্রাঞ্চ নেটওয়ার্কের আকার কমিয়ে আনছে।
গ্রাহকরা মনে করেন, ডিজিটাল ব্যাংক উন্নত সেবা দেবে। এ কারণে প্রথাগত ব্যাংকগুলো ডিজিটাল ব্যাংকে অংশীদারত্ব নেওয়ার কথা ভাবছে বলে জানান ওই ব্যাংকার। গ্রাহক ভিত্তি ধরে রাখতে প্রথাগত ব্যাংকগুলো একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছে বলেও জানান তিনি।
তবে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে স্থানান্তরের ফলে ব্যাংকিং খাতে কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন ওই ব্যাংক কর্মকর্তা।
বর্তমানে দেশে ৬১টি প্রথাগত ব্যাংক রয়েছে। এর সঙ্গে নতুন ডিজিটাল ব্যাংক এলে একই ধরনের ঋণ ও আমানত পণ্য নিয়ে দুই ধারার ব্যাংকের মধ্যে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে।
প্রতিটি ব্যাংক তাদের সেবা নিয়ে আরও বেশিসংখ্যক গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে প্রতি বছর নতুন শাখা খোলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৬১টি ব্যাংকের ১১ হাজার ১৩৯টি শাখা ছিল। এসব শাখায় মোট কর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ৯৬ হাজার ১০২ জন। প্রতি শাখায় গড়ে কর্মীসংখ্যা ১৭.৬০ জন। কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংকের কোনো ফিজিক্যাল শাখা থাকবে না। এ কারণে এ ব্যাংক কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকের জন্য ব্যাংকের চেয়ে ভালো চাকরি নেই, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বেশি।
ব্যাংকগুলো প্রতি বছর যে পরিমাণ শাখা খোলার অনুমোদন পায়, এ বছর সেই সংখ্যা গত বছরের তুলনায় অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিচালন খরচ কমাতে ব্যাংকগুলোকে ডিজিটাল সম্প্রসারণে উৎসাহিত করার অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ব্যাংকগুলোকে ২০০-র বেশি শাখা খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর ব্যাংকগুলো ১০০-র মতো শাখা খোলার অনুমোদন পেয়েছে।
কী সুবিধা দেবে ডিজিটাল ব্যাংক?
ডিজিটাল ব্যাংক যেহেতু শুধু ভার্চুয়াল জগতে কাজ করে, তাই এ ব্যাংক আরও বেশিসংখ্যক গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পারে। কারণ গ্রাহকরা ইন্টারনেট সংযোগ থাকা ডিভাইস ব্যবহার করে যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায় থেকে লেনদেন করার পাশাপাশি ব্যাংকিং সেবা নিতে পারেন।
ফিজিক্যাল শাখা ও কর্মীদের রক্ষণাবেক্ষণের কারণে প্রথাগত ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেশি। অন্যদিকে ডিজিটাল ব্যাংকের পরিচালন খরচ বেশিরভাগ সময়ই অনেক কম। এর ফলে ডিজিটাল ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতামূলক ফি ও ভালো সুদহার দিতে পারে।
এছাড়া ডিজিটাল ব্যাংকের গ্রাহকরা অনলাইন লেনদেনের জন্য ভার্চুয়াল ডেবিট কার্ড নিতে পারেন। এ কার্ড দিয়ে ই-কমার্স কেনাকাটা করা নিরাপদ ও সুবিধাজনক। ডিজিটাল ব্যাংক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে পারে। ফলে তাৎক্ষণিক ব্যক্তিগত ঋণ সুবিধা দিতে পারে এ ব্যাংক।
ডিজিটাল ব্যাংক প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের অগ্রভাগে রয়েছে। আধুনিক টুল ও বিশ্লেষণ কাজে লাগিয়ে দ্রুত ও সহজ ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা দেয় এ ব্যাংক।
এসডব্লিউএসএস/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ