আজ থেকে প্রায় ২২০০ বছর আগের কথা। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে তক্ষশীলাকে কেন্দ্র করে উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল প্রকাণ্ড এক সাম্রাজ্য। পূর্বে বারাণসী থেকে শুরু করে তার পরিধি বিস্তৃত ছিল বর্তমানপাকিস্তান, আফগানিস্থান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান পর্যন্ত প্রায় ২৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল-জুড়ে।
ঠিকই ধরেছেন, কথা হচ্ছে কুষাণ সাম্রাজ্যকে নিয়ে। যে-রাজবংশের অন্যতম সম্রাট ছিলেন কনিষ্ক। মূলত প্রাচীন গ্রিক, ব্যাকট্রিয়ান, ভারতীয় গান্ধারী প্রাকৃত এবং মিশ্রিত সংস্কৃত ভাষাকেই কথ্য ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত করত কুষাণরা।
তবে এই পরিচিত ভাষাগুলি ছাড়াও মধ্য-এশিয়ার এই সাম্রাজ্যে ব্যবহৃত হত এক অজানা স্থানীয় ভাষা। যা পরিচিত ‘দ্য আননোন কুষাণ স্ক্রিপ্ট’ নামে।
‘আননোন’-ই বটে। কারণ, কুষাণ আমলে এই ভাষায় লিখিত শিলালিপির অর্থ এতদিন পর্যন্ত বুঝতে পারেননি আধুনিক গবেষকরা। সবমিলিয়ে একপ্রকার রহস্যের মোড়কেই আবদ্ধ ছিল এই দুর্বোধ্য ভাষা।
এবার প্রকাশ্যে আসতে চলেছে প্রাচীন এই লিপির রহস্য। আবিষ্কারের দীর্ঘ ৭০ বছর পর খানিকটা হলেও প্রাচীন এই ভাষার জট ছাড়ালেন গবেষকরা। নেপথ্যে জার্মানির কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সভেনজা বনম্যান, জ্যাকব হাফম্যান এবং নাতালি কোরোবজো।
চলতি বছরের ১ মার্চ, তাজিকিস্তানে আয়োজিত ‘অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’-এর অনলাইন সম্মেলনে সর্বপ্রথম এই লিপির আংশিক পাঠোদ্ধারের কথা ঘোষণা করেছিলেন তাঁরা। অবশ্য কীভাবে এতটা পথ এগোলেন তাঁরা— সে-বিষয়ে বিস্তারে কোনো তথ্যই তাঁরা প্রকাশ্যে আনেননি সে-সময়।
সম্প্রতি ‘ট্রানজ্যাকশনস অফ দ্য ফিলোলজিক্যাল সোসাইটি’ জার্নালে প্রকাশিত হয় ‘আ পার্সিয়াল ডিসাইফারমেন্ট অফ দ্য আননোন কুষাণ স্ক্রিপ্ট’-খ্যাত তাঁদের এই গবেষণাপত্র। সেখানেই দাবি করা হয়, বর্তমানে এই ভাষার ৬০ শতাংশ হরফ বা অক্ষরকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন গবেষকরা। কিন্তু কীভাবে?
মূলত পঞ্চাশের দশকে আফগানিস্তান থেকে উদ্ধার হয়েছিল কুষাণ ভাষার শিলালিপি। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরেও তার পাঠোদ্ধার করতে পারেননি একদল ফরাসি গবেষক। তারপর ধীরে ধীরে আফগানিস্তান হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র।
পরবর্তীতে তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানেও পাওয়া যায় এই লিপির নমুনা। তবে আঞ্চলিক অন্য কোনো প্রাচীন ভাষার সঙ্গে কুষাণ ভাষার মিল না-থাকার জন্য তা ধাঁধাঁ হয়েই থেকে যায় গবেষকদের কাছে।
২০২২ সালে তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে থেকে আনুমানিক ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে একটি পাথরের গুহার মুখে পাওয়া যায় আরও বেশ কিছু শিলালিপি। কুষাণ ভাষা ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিল ব্যাকট্রিয়ান লিপির শিলালেখ। দ্বিভাষিক এই শিলালিপিই প্রাচীন ভাষাটির জট ছাড়াতে সাহায্য করছে গবেষকদের।
গবেষকদের মতে, একই বার্তা দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় লেখা হয়েছিল এই শিলালিপিগুলিতে। ব্যাকট্রিয়ান ভাষার শিলিলিপি পূর্বপরিচিত হওয়ায়, তার সূত্র ধরেই অজানা কুষাণ ভাষার সমাধান করে চলেছেন গবেষকরা। অজানা ভাষাটির পাঠোদ্ধারের ক্ষেত্রে তাঁরা ব্যবহার করছেন ‘রোসেটা স্টোন’ পদ্ধতিকে।
প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ থেকে ফার্সি কিউনিফর্ম হরফ— দুর্বোধ্য একাধিক লিপির পাঠোদ্ধারের নেপথ্যে রয়েছে এই পদ্ধতিই। এবারও তা হতাশ করল না গবেষকদের।
অবশ্য কুষাণ ভাষার সম্পূর্ণ বর্ণমালা, হরফ এবং শব্দবন্ধের ব্যাপারে পরিচিত হতে এখনও বেশ কয়েকবছর সময় লাগবে গবেষকদের। তারপর ধীরে ধীরে পাঠোদ্ধার করা হবে গোটা মধ্য এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কুষাণ শিলালিপিদের। অবশ্য ইতিমধ্যেই নতুন নাম পেয়েছে এই প্রাচীন ভাষা— ‘ইটিও টোক্যারিয়ান’ স্ক্রিপ্ট।
আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে ৭০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্য-এশিয়ায় ব্যবহৃত হত এই ভাষা। অর্থাৎ, কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পরেও মধ্য-এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে চল ছিল এই ভাষাটির।
ফলে, এই ভাষার পাঠোদ্ধার তৎকালীন সময়ে বহু অজানা তথ্য প্রকাশ্যে আনবে, সে-ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশাবাদী প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাবিদরা।
এসডব্লিউএসএস/১২৪০
আপনার মতামত জানানঃ