ইতিহাসে এমন ঘটনা বহুবারই ঘটেছে, যখন ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ মানুষকে খুন করে খেয়ে নিয়েছে তার শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এমনকি কখনো কখনো আপন বাবা-মায়ের হাতেই নিহত হয়েছে স্নেহের সন্তান। পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে খুন করেছে, কবর থেকে লাশ পর্যন্ত তুলে খেয়েছে! ইতিহাসের যে তিনটি দুর্ভিক্ষ মানুষকে নরখাদক বানিয়ে ছেড়েছিলো, সেটা আজ আমরা জানব।
মধ্যযুগের দুর্ভিক্ষ
মধ্যযুগে ইউরোপে দুর্ভিক্ষ ছিলো বেশ সাধারণ একটি ঘটনা। খারাপ ফলন, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, ব্ল্যাক প্লেগের মতো অসুখ এর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতো। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে শুধুমাত্র ব্রিটেনই পঁচানব্বইবার দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছে। ১৩৪৮-১৩৭৫ সালের মধ্যবর্তী সময়টুকুতে ব্রিটেনের মানুষের গড় আয়ু ছিলো মাত্র সতের বছরের কাছাকাছি।
১৩১০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী দু’দশকে উত্তর ইউরোপে আবহাওয়ার মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে। ফলে ১৩১৫ সালের দিকে খাবারদাবারের দাম হয়ে যায় আকাশছোঁয়া। এত দাম দিয়ে খাবার কিনতে না পারার ফলে ছড়াতে শুরু করে দুর্ভিক্ষ।
দুর্ভিক্ষের সময়ে সামাজিক কাঠামো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে। অনেক বাবা-মায়েরাই তাদের সন্তানদের পরিত্যাগ করেছিলো। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে বাবা-মায়েরা কখনো তাদের সন্তানদের হত্যা করেছে, কখনো কখনো জেলের বন্দীরা তাদের সঙ্গীদের খেয়েছে, কখনো আবার কবর থেকে লাশ চুরি করতে গিয়েও ধরা পড়েছে লোকজন।
রাশিয়ার দুর্ভিক্ষ
১৯১৭ সালে বলশেভিক রেড আর্মি ও হোয়াইট আর্মির মাঝে যুদ্ধের মাঝ দিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় রাশিয়ায়। রাজনৈতিক সহিংসতা, নৃশংসতা, অর্থনৈতিক দৈন্যের প্রভাবে ধীরে ধীরে দেশের অনেক জায়গায় অসুখের প্রকোপ বাড়তে থাকে, দেখা দিতে থাকে চরম খাদ্য সঙ্কট।
১৯২২ সালের শেষের দিকে যখন এ দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটে, ততদিনে ভলগা ও উরাল নদীর কাছাকাছি অঞ্চলগুলোয় খাদ্যের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলো প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ।
শুধুমাত্র দু’মুঠো খাবারের জন্য তখন মানুষ যা করেছিলো তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। ঘাস, ময়লা-আবর্জনা, পোকামাকড়, কাদামাটি, কুকুর, বিড়াল, মৃত প্রাণীর শবদেহ, এমনকি মানুষের মাংসও খেয়েছে অনেকে। বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের খেয়েছে, শিকার করেছে মানুষের মাংস!
পুলিশের কাছে যখন এগুলোর রিপোর্ট যেত, তখন তারাও কোনো ব্যবস্থা নিত না। কারণ তখন মানুষের মাংস খাওয়াকে দেখা হচ্ছিলো বেঁচে থাকার একটি উপায় হিসেবেই। একবার এক মহিলাকে মানুষের সিদ্ধ মাংস সহ পাকড়াও করা হয়। পরবর্তীতে তিনি স্বীকার করেন যে এটি তার মেয়ের মাংস!
মানুষজন কবর খুঁড়ে লাশ খাওয়া পর্যন্ত শুরু করতে চেয়েছিলো। তাদেরকে ঠেকাতে কবরস্থানের চারদিকে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কালো বাজারে গোপনে বিক্রি হতো মানবদেহের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। জেলের বন্দীদের মাঝেও নরমাংস ভোজের বাতিক দেখা দিয়েছিলো।
লেনিনগ্রাদ অবরোধ
১৯৪১ সালের জুন মাসের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের মধ্য দিয়ে নাৎসি বাহিনী অপারেশন বারবারোসার সূচনা ঘটায়। এ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিলো একে একে লেনিনগ্রাদ, দোনেৎস্ক বেসিন ও মস্কোর দখল নেয়া। ফিনিশ আর্মির সহযোগিতায় তারা লেনিনগ্রাদকে ঘিরে ফেলে।
৮৭২ দিন ধরে চলে সেই অবরোধ। লেনিনগ্রাদে যেন কোনোপ্রকার খাবারের সরবরাহ পৌঁছতে না পারে, সেজন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয় নাৎসি বাহিনী।
খাদ্য, পানীয়, কোনো রকম শক্তির উৎস ছাড়া খুব মানবেতর জীবনযাপন করতে শুরু করে লেনিনগ্রাদের জনগণ। অবরোধের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে কমপক্ষে পনের লক্ষ মানুষ মারা যায়। যুদ্ধের আগে লেনিনগ্রাদে প্রায় ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ লক্ষ মানুষ বসবাস করতো। যুদ্ধ শেষে সেখানকার মাত্র সাত লক্ষ মানুষই বেঁচে ছিলো।
অবরোধ শুরু হবার কিছুদিন পরই লেনিনগ্রাদের খাবারের হোটেলগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হতে শুরু করে। বিভিন্ন অপরাধী সংগঠন গড়ে উঠতে শুরু করে যাদের মূল কাজই ছিলো খাবার চুরি করা। পেস্ট, চামড়া, পশম, লিপস্টিক, মশলা, ওষুধ- কী খায় নি তারা!
বিভিন্ন জায়গায় মানুষ মানুষকে খাওয়ার মতো ঘটনা শোনা যেতে থাকে। পুলিশকে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হয়েছিলো শুধুমাত্র মানুষ মানুষকে খাওয়া ঠেকাতে। নাৎসি বাহিনীর বোমা হামলার ভয় যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো স্বদেশী জনগণের পেটে চালান হবার ভয়ও।
এসডব্লিউএসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ