উত্তর ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল অর্থাৎ বর্তমান সময়ের নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক ছিল ভাইকিংদের আদি নিবাস। কালক্রমে তারা ছড়িয়ে পড়েন ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে। রাশিয়ানদের পূর্ব পুরুষ ছিলেন এই ভাইকিংরাই। সুইডেনের “রাস” নামক ভাইকিং গোত্ররের নাম থেকে উৎপত্তি হয়েছে রাশিয়া শব্দের। আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও গ্রীনল্যান্ডের বর্তমান অধিবাসীদের পূর্বপুরুষও ছিলেন ভাইকিং।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের শেষ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ভাইকিংরা জলপথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হামলা চালিয়ে কখনও লুটপাট করেছে। আবার কখনও বসতি গড়েছে নিজেদের জয় করা এলাকায়। সে অর্থে আসলে ভাইকিংদের জলদস্যু বললেও ভুল হবে না।
ভাইকিং হামলার প্রথম রেকর্ড পাওয়া যায় ৭৯৩ সালে উত্তর পূর্ব ইংল্যান্ডে। মূলত সেই সময় থেকেই শুরু হয় ইউরোপের ভাইকিং এইজ। এরপর ভাইকিংরা নৌপথে হামলা চালাতে থাকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে ইংল্যান্ড ছিল তাদের প্রধান টার্গেটগুলোর একটি। মোটামুটি একাদশ শতকের মধ্যে সমস্ত ইংল্যান্ড ভাইকিংদের হাতে চলে আসে।
এছাড়া আয়ারল্যান্ডেও ভাইকিংরা বসতি স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তবে শুধু যুদ্ধ বিগ্রহ ও লুটপাট করা ভাইকিংদের প্রধান কাজ ছিলনা। নিজের দেশে অধিকাংশ ভাইকিং কৃষি কাজ করত। তবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অনুর্বর ও শক্ত জমিতে কৃষিকাজ করে টিকে থাকা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছিল এক সময়।
তাই নিজেদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ভাইকিংদের সাগর পাড়ি দিয়ে লুটপাট ও অন্যদেশ দখল করা ছাড়া অন্য রাস্তা খোলা ছিলনা। ভাইকিংরা শারীরিকভাবে ছিলেন প্রচন্ড শক্তিশালী, দীর্ঘকায় ও কষ্ট সহিষ্ণু।
তাই ভাইকিং হামলার সামনে দাঁড়াবার মত শক্তি ইউরোপের অন্য কোন দেশের ছিলনা। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে যে ভাইকিংদের শত্রুতাই ছিল তা কিন্তু নয়। ইউরোপের অনেকদেশের সেনাবাহিনীতে ভাইকিংরা ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে চাকরি করতেন। যোদ্ধা হিসাবে ভাইকিংদের সুখ্যাতি ছিল চতুর্দিকে।
এছাড়া ভাইকিংরা ভূমধ্যসাগরের আসে পাশে অনেক জায়গায় ব্যবসাও করতেন। ভাইকিংদের উল এবং কাঠের বেশ কদর ছিল বিভিন্ন দেশে। তবে মজার ব্যাপার হল ভাইকিংরা কখনই একটি রাজ্য কিংবা রাজার অধীনে ছিলেন না। তাদের রাজনৈতিক কাঠামো ছিল গোত্র বা কবিলাতান্ত্রিক। গোত্রপতি গোত্রের ভালমন্দ ও নীতিনির্ধারণ করতেন। পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে প্রায়ই অনেকগুলো ভাইকিং গোত্র মিলে হামলা চালাত একসাথে।
শুরুর দিকের দুই শতাব্দী ভাইকিংরা ছিলেন প্যাগান অর্থাৎ বহু দেব দেবীর উপাসক। ভাইকিং মিথোলজি বেশ সমৃদ্ধ এবং ঘটনাবহুল। তারপর আস্তে আস্তে তারাও আসে পাশের খ্রিস্টান দেশগুলোর প্রভাবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পূর্বে চার্চ ও আশ্রমের উপর হামলা চালানো ছিল তাদের কাছে অতি সাধারণ ঘটনা। তাই খ্রিস্টান ইউরোপের কাছে তারা বর্বর ও অসভ্য হিসাবে পরিচিত ছিল।
তবে ভাইকিংদের ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে উন্নত ছিল। বলা বাহুল্য শীত প্রধান হওয়ায় ইউরোপের অনেক দেশেই মানুষ মাসের পর মাস গোসল না করেই কাটিয়ে দিত। ভাইকিংদের দেব দেবতাদের মধ্যে ওডীন, থর, টাইর, লোকি, ম্যানি, সাগা প্রমুখ উল্লেখ্যযোগ্য।
ভাইকিং সমাজে নারীদের অবস্থান ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক ভাল ছিল। মুসলিম দেশগুলোতে বহু আগে থেকেই নারীদের পৈত্রিক ও মাতৃক সম্পত্তিতে অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করা হলেও খ্রিস্টান ইউরোপে নারীদের কোন প্রকার সম্পদের মালিক বানানো হতনা। তবে ভাইকিংদের সমাজে নারীরা সম্পত্তিতে অধিকার পেত, স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা রাখত এবং প্রয়োজনে বিবাহ বিচ্ছেদের পর যৌতুকের টাকা ফেরত নিতে পারত।
সেদিক থেকে বলা যায় ভাইকিং সমাজ ও রীতিনীতি যথেষ্ট উন্নতই ছিল। ভাইকিংদের দুই শিংওয়ালা হেলমেট পড়া নিয়ে একটি মিথ বেশ জনপ্রিয়। যেকোন জায়গায় ভাইকিংদের চিত্রায়িত করার জন্য অভিনেতাদের শিংওয়ালা হেলমেট পড়ানো হয়। তবে বাস্তবতা হল ভাইকিংরা এই ধরণের শিওয়ালা হেলমেট ব্যবহার করতনা। ভাইকিংদের নিয়ে এই মিথের জন্ম সম্ভবত উনবিংশ শতকের চিত্র শিল্পীদের হাতে।
ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার দরুণ ভাইকিংরা ক্রমশ অন্যান্য সংস্কৃতিরা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিল। এছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দরুণ দস্যুবৃত্তি তথা সাগরের বুকে জীবন বাজি রেখে ছুটে বেড়ানোরও আর প্রয়োজন রইলনা। ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে ভাইকিংদের এইটি দল রাজ্য স্থাপন করেছিল। ভাইকিংরা নরম্যান বা উত্তরের মানুষ হিসাবেও পরিচিত ছিলেন তাই তাদের নামানুসারে জায়গার নাম রাখা হয়েছিল নরম্যান্ডি। নরম্যান্ডির ডিউক উইলিয়াম দ্যা কনক্যারর ১০৬৬ সালে ইংল্যান্ড জয় করে ইংল্যান্ডে নর্মান যুগের সূচনা করেন। ঐতিহাসিকভাবে তখন থেকে ইউরোপে ভাইকিং যুগের অবসান হয়।
এসডব্লিউএসএস/১০৩০
আপনার মতামত জানানঃ