দীর্ঘদিন ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ নেই এসব ঋণ গ্রহীতার। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে নেই তেমন জামানতও। এমনকি, যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এসব ঋণ, তার অস্তিত্বই খুঁজে পাচ্ছে না ব্যাংক। ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন, ঘন ঘন বিদেশ সফর, উচ্চশ্রেণির লোকজনদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসার পর শেষ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না করেই গায়েব হয়ে গেছেন চট্টগ্রামের দুই দম্পতি।
সুলতানা শিরীন আক্তার-মোস্তাফিজুর রহমান এবং মোয়াজ্জেম হোসেন-সাদিকা আফরিন দীপ্তি দম্পতি ৭ ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। তবে ঋণ পরিশোধের সময় এখন আর হদিস মিলছে না তাদের। এতে করে ঋণের অর্থ আদায়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে দাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
ব্যাংক ও আদালত সূত্রে জানা যায়, শিরিন ও মোস্তাফিজুর দম্পতি আলভি এন্টারপ্রাইজ, সিজদা মোটরস এবং শিরীন করপোরেশনের নামে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) থেকে প্রায় ১১০ কোটি টাকা ঋণ নেন।
এদিকে, পৃথক ঘটনায় ন্যাশনাল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১৭৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে উধাও হয়েছেন আরেক দম্পতি। শিপ ব্রেকিং ব্যবসা গ্রান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের নামে ঋণ নেওয়া দম্পতি মোয়াজ্জেম ও দীপ্তিকে চেনেন না এ খাতের কোনো ব্যবসায়ী। এমনকি এই কোম্পানির নামও তারা শোনেননি।
দীর্ঘদিন ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ নেই এসব ঋণ গ্রহীতার। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে নেই তেমন জামানতও। এমনকি, যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এসব ঋণ, তার অস্তিত্বই খুঁজে পাচ্ছে না ব্যাংক।
ঋণ খেলাপি নারী উদ্যোক্তা
সুলতানা শিরিন আক্তারের বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার; মা ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা। মায়ের হাত ধরেই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এক সময় বুটিক ব্যবসা করলেও ২০১০ সালের পর যুক্ত হন হেভি ইক্যুইপমেন্ট ব্যবসায়। যেখানে ড্রাম্প ট্রাক, ক্রেন, লরি, বুলডোজার মতো ভারী যন্ত্রপাতি ভাড়া দেওয়া হতো। দেশের নামকরা ইস্পাত শিল্পগ্রুপ বিএসআরএম, একেএস স্টিলসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সাথে ভালো ব্যবসা ছিল প্রতিষ্ঠানটির।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার তার সক্ষমতার বাইরে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। কারণ তখন ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা সম্প্রাসারণ করলেও সেই পরিমাণ আয় বাড়েনি। ওয়ান ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ওয়ান ব্যাংক স্টেশন রোড শাখায় ব্যবসা শুরু করেন শিরিন সুলতানা। হেভি ইক্যুপমেন্ট আমদানিতে ওই সময় ৪৬ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা নেয় শিরিনের তিন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী, ব্যাংকে ঋণের কিস্তি শোধ করেননি তিনি।
এমনকি, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঋণটি পুনঃতফসিলের প্রস্তাব দিয়েও শর্ত অনুযায়ী ডাউন পেমেন্ট দেননি। এরপর ঋণের বিপরীতে দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির চেকগুলো ডিজনার হলে শিরিনের বিরুদ্ধে এনআই অ্যাক্ট (চেক প্রত্যাখান) মামলা দায়ের করে ব্যাংক।
এরমধ্যে একটি মামলায় ২০২০ সালের ২ সেপ্টম্বর প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন সিএমএম আদালত। পরবর্তীতে ঋণ গ্রহীতার আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে সেই আদেশ বাতিল করে দেন মহানগর দায়রা জজ আদালত।
ওয়ান ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও স্টেশন রোড শাখার ইনচার্জ রুপন কান্তি পাল বলেন, “গত চার বছরে ঋণের এক টাকাও শোধ করেননি এই ব্যবসায়ী। এক বছর ধরে ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগই বন্ধ করে দেন। এমনকি ব্যবসায়িক কার্যালয় এবং বাসায় গিয়েও প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের খোঁজ মিলছে না। তাই ঋণের টাকা আদায়ে অর্থঋণ মামলা দায়ের করা হয়েছে।”
বর্তমানে শিরিন সুলতানার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে একটি ঋণ খেলাপি মামলা ও ৩৫টি চেকের মামলা এবং ঢাকায় ২১টি চেকের মামলাসহ ওয়ান ব্যাংকের ৫৭টি মামলা চলছে। একটি ভবনসহ কিছু জমি ব্যাংকের কাছে কোলেটারেল হিসেবে থাকলেও তার মূল্য ঋণের তুলনায় খুবই কম বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
পাওনাদার ব্যাংক ও আদালতের তথ্যমতে, শিরিনের তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১১০ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এরমধ্যে ওয়ান ব্যাংকের ৬১ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংকের ৩০ কোটি, ইউসিবিএল সাড়ে ৮ কোটি, লঙ্কাবাংলার ৬ কোটি ও আইপিডিসি ৩ কোটি ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের ২ টাকা পাওনা আটকে রয়েছে।
ইউসিবিএল কদমতলী শাখার ব্যবস্থাপক বোরহান উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “এই শাখায় দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখতে পাই, সিজদা মোটরসের নামে নেওয়া শিরিনের ঋণের পেমেন্টের অবস্থা ভালো নয়। তখন আমরা কৌশলে তার কাছ থেকে ঋণের কিছু টাকা আদায় করে নেই। এখনো আমাদের প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। হেড অফিসের নির্দেশে আমরা দ্রুত আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।”
ব্যাংকগুলোর তথ্যমতে, আইপিডিসি ছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ ইতোমধ্যে শ্রেণিকৃত হয়ে পড়েছে। শিরিনের ব্যবসায়িক কার্যালয় নগরীর একে খান মোড়ের হোটেল হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনাল ভবনের দোতলায়। গত শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়টি বন্ধ। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার পশ্চিম বৈলতলী গ্রামে শিরিনের শ্বশুর বাড়ি। তবে শিরিনের গ্রামের বাড়ির কোনো তথ্য নেই ব্যাংকের কাছে।
ঋণদাতা ব্যাংকের কর্মকর্তা ভাষ্যমতে— ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ বৃদ্ধির সাথে খরচ ও বেড়ে যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে খুব বেশি সময় দিতেন না এই উদ্যোক্তা। বিদেশে যাতায়াত কিংবা সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষের সঙ্গে ওঠাবসায় কাটাতেন তিনি। তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের সুবাধে এবং নারী উদ্যোক্তা হিসেবে খুব সহজে ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পান তিনি।
জামানতবিহীন ১৭৫ কোটি টাকা ঋণ
এদিকে, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ১৭৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে উধাও আরেক দম্পতি। শিপ ব্রেকিং ব্যবসার নামে ঋণ নেওয়া এই দম্পতিকে চেনেন না এ খাতের কোনো ব্যবসায়ী। এমনকি ঋণ গ্রহীতার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকের কাছেও। ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে শিপ ব্রেকিং ব্যবসার নামে ঋণ নেয় গ্রান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে মোয়াজ্জেম হোসেন ও পরিচালক তার স্ত্রী সাদিকা আফরিনের (দীপ্তি) নাম উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তু ঋণ নেওয়ার পর গত পাঁচ বছরে ব্যাংকে এক টাকাও শোধ করেননি তারা। এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে কোনো কোলেটারেল সিকিউরিটিও নেই। দীর্ঘদিনেও ঋণ ফেরত না পাওয়ায় গত বছরের ডিসেম্বরে এই দম্পতির বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা দায়ের করে ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট শাখা। উক্ত মামলায় ঋণ গ্রহীতাদের ঋণের টাকা ফেরতসহ ঋণ প্রদানে অনিয়ম তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গত ১৮ মে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান এই আদেশ দেন।
এই মামলায় গত ৫ মার্চ ঋণ গ্রহীতাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় একই আদালত। এই ঋণের কিস্তি পরিশোধে একটি চেক দিয়েছিলেন শিপ ব্রেকিং খাতের আরেক ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান লস্কর (মাহিন)। তাই মামলায় মাহিনকেও বিবাদি করেছে ব্যাংক। কিন্তু ১০ ব্যাংকের আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ না করে ইতোমধ্যেই দেশত্যাগ করেছেন মাহিন।
ব্যাংকের কাছে সংরক্ষিত তথ্যে— গ্রান্ড ট্রেডিংয়ের ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ি গ্রামে। কিন্তু গত শনিবার সরেজমিনে গিয়ে এই ঠিকানায় কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ব্যাংকের নথিতে দেওয়া ফোন নম্বরে এই দম্পতির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি।
ঋণ প্রদানের সময় ন্যাশনাল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা শাহাদাৎ হোসেন (বর্তমান- ইসলামী ব্যাংক জুবলি রোড শাখার ব্যবস্থপক) বলেন, “ঋণ গ্রহীতা গ্রান্ড ট্রেডিংয়ের এমডি ও পরিচালক কাউকে চিনি না। আমি কেন, ঋণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের কেউ এই দম্পতিকে দেখেননি। কিন্তু ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় এই ফাইলে সই করতে হয়েছে আমাদের।”
ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মাহমুদ হোসেন নিশ্চিত করেছেন, গ্র্যান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজকে বেশ কয়েক বছর আগে ঋণ দেওয়া হয়েছিল এবং ইতোমধ্যেই সেটি শ্রেণিকৃত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “বিষয়টি এখন মামলাধীন এবং আদালত ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে কাজ করার জন্য দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা ঋণ আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে ঋণ মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা আমি জানি না।“
আপনার মতামত জানানঃ