১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আগে সারা বিশ্বেই মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৩৫ বছরের ঘর কখনো অতিক্রম করতে পারেনি। আর এত কম গড় আয়ুর পেছনে একটা বড় কারণ ছিল শিশুমৃত্যু ও বালক বয়সে মৃত্যুর উচ্চ হার। প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে দুটিই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে মারা যেত।
তবে ১৭৫০ সালের দিকে অভিজাত ব্রিটিশদের গড় আয়ু হঠাৎ করে বেড়ে যেতে শুরু করে। বছরের পর বছর ধরে ব্রিটিশ সমাজের বনেদি ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশিত গড় আয়ুর মধ্যে ফারাক তৈরি হয়। রানি ভিক্টোরিয়ার সময়ে অভিজাত ব্রিটিশদের জন্মকালীন গড় আয়ু বেড়ে ৬০ বছরে দাঁড়ায়।
১৭৫০-এর আগে গড় আয়ুর ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। ওই বছরের আগে ব্রিটেন এবং ইউরোপের অনেক অভিজাত ও রাজন্যবর্গই গুটিবসন্তের মতো রোগের মুখে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু আঠার শতকের মধ্যভাগের পর থেকে হুট করে অভিজাতদের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?
এর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন এডওয়ার্ড জেনার। ভদ্রলোক গুটিবসন্তের টিকা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তখন। তিনি লক্ষ্য করলেন, কেউ একবার গো-বসন্তে আক্রান্ত হওয়ার পর আর গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন না।
জেনার তখন গো-বসন্তের গুঁটি থেকে কিছু পুঁজ নিয়ে তা আট বছর বয়সী এক ছেলের হাতে প্রবেশ করালেন। ছেলেটার প্রথমে হালকা জ্বর এল, কিন্তু পরে দেখা গেল গুটিবসন্তের ভাইরাস প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে তার শরীর। এভাবেই জেনারের হাত ধরেই প্রথমবারের মতো মানবদেহে টিকা প্রদানের ঘটনা ঘটে।
তবে ব্রিটিশ অভিজাতদের আয়ুবৃদ্ধির পেছনে আরেকটি প্রাথমিক উদ্ভাবনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আর সেটি ছিল ভেরিওলেশন তথা খোদ আক্রমণকারী ভাইরাসের সংস্পর্শের মাধ্যমে চিকিৎসা নেওয়া। আর এ পদ্ধতি পশ্চিমের কেউ তৈরি করেননি।
কিছু তথ্য অনুযায়ী, ভেরিওলেশন খুব সম্ভবত ভারতবর্ষে প্রথম চর্চা করা হয়েছিল। ১৬০০ শতকের মধ্যেই চীন, ভারত ও পারসিয়ায় (অধুনা ইরান) ছড়িয়ে পড়ে সংক্রামক রোগের চিকিৎসার এ পদ্ধতি। এরপর আফ্রিকান দাসেরা বিভিন্ন আফ্রিকান কলোনিতে এ পদ্ধতিটি পরিচিত করান।
ব্রিটেনের এক ডিউকের কন্যা ছিলেন লেডি ম্যারি উর্টলি মন্ট্যাগ। ভদ্রমহিলা বেশ বিদ্বান ছিলেন। ১৭১৮ সালের মার্চে তিনি তার ছোট ছেলেকে ভেরিওলেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করান। নিজেও এ পদ্ধতির বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। তার ছেলে প্রথম কদিন জ্বরে ভুগলেও পরে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে।
এই ছেলে শেষে ৬০ বছরের বেশি বেঁচে ছিল। তাকেই টিকা গ্রহণকারী প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার বোনকেও সফলভাবে টিকা দেওয়া হয় ১৭২১ সালে। এ পরিবারের সাফল্য দেখেই প্রিন্সেস অব ওয়েলস তার তিন সন্তানকে টিকা দেন।
লেডি ম্যারির প্রচার-প্রসারেই ভেরিওলেশন ব্রিটেনের ওপরতলার মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। খোদ এডওয়ার্ড জেনারই ১৭৫৭ সালে এ টিকা নিয়েছিলেন। পরে নিজের চিকিৎসকজীবনেও নিয়মিত অনেক রোগীর ওপর ভেরিওলেশনের প্রয়োগ করেছিলেন।
তাই বলা যায়, ভেরিওলেশন নিয়ে আজীবন ধারণা না থাকলে জেনার সম্ভবত কখনোই এক ধাঁচের বসন্তের পুঁজ নিয়ে অন্য ধরনের বসন্তের চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করতেন না।
বনেদি ব্রিটিশদের আয়ুষ্কাল বাড়ার পর আরও এক শ বছর লেগেছিল সাধারণ মানুষদের একই সৌভাগ্য পেতে। ওই সময় ভেরিওলেশন ও টিকাদান ধীরে ধীরে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং শহরের শ্রমিকশ্রেণির মাঝে ছড়িয়ে পড়েতে শুরু করেছিল।
কিন্তু তখন নতুন এক বিপদ টের পেলে মানুষ- সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচার পর নতুন ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিলো শিল্পায়ন। ব্রিটেনের শিল্পনগরী লিভারপুলে তখন মানুষের আয়ুষ্কাল ছিল গড়ে কেবল ২৫ বছর। ১৯ শতকের প্রথমভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মৃত্যুহার অবিশ্বাস্য রকম বেশি ছিল।
দেশটিতে তত দিনে টিকার প্রসার অনেক ঘটেছে, কিন্তু মানুষের গড় আয়ুতে সে ছাপ নেই। আর এসবের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল দুধ! নষ্ট হয়ে গিয়ে শরীর খারাপ করানো থেকে শুরু করে দুধের মাধ্যমে সরাসরি প্রাণী থেকে সংক্রামক রোগ তৈরি হওয়া- দুধপান সব সময়ই স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ ছিল।
তখন রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করার কোনো উপায় ছিল না, ফলে একটু গরম পড়লে সহজেই নষ্ট হয়ে যেত দুধ। নারীরা শিল্পকারখানায় কাজ করতেন বলে তাদের সন্তানেরা গরুর দুধের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ ছাড়া ডিপথেরিয়া, টাইফয়েড, স্কারলেট জ্বরের মতো অন্যান্য রোগের কারণও ছিল গোদুগ্ধ।
এবার দৃশ্যপটে লুই পাস্তুর। ১৮৫৪ সালে তরুণ লুই পাস্তুর ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অব লাইল-এ চাকরি শুরু করেন। বিভিন্ন খাবার ও পানীয় কেন নষ্ট হয়ে যায়, তা নিয়ে চিন্তা শুরু করেন তিনি। গবেষণার একপর্যায়ে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে তিনি অ্যাসিটোব্যাকটর অ্যাসিটি খুঁজে পান এ ব্যাকটেরিয়া ইথানলকে অ্যাসিটিক অ্যাসিডে পরিণত করে।
তার এ আবিষ্কারই জীবাণু তত্ত্বের ভিত্তি তৈরি করে। ১৮৬৫ সালে পাস্তুর পাস্তুরায়ন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এ পদ্ধতিতে তিনি ওয়াইনের স্বাদ নষ্ট না করেও অনেক জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম হন।
এরপর সারা বিশ্বে দুধের জন্য এ পাস্তুরায়ন পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়, আর প্রাণ বাঁচে অসংখ্য মানুষের। তবে এক রসায়নবিদ এ প্রাণ বাঁচানো টোটকা উদ্ভাবন করলেও তা সবার মধ্যে পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল সাংবাদিকতা, অ্যাক্টিভিজম ও রাজনীতি।
২০ শতকের প্রথম দশকে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু গণহারে সবার জন্য বৃদ্ধি পায়। ওই সময়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের গড় আয়ু ৫০ বছর পার করে। শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোতে লাখো মানুষের জীবনে সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ দেখা যায় প্রথমবারের মতো। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অ্যাঙ্গাস ডিটন এ ঘটনাকে বলেছেন ‘দ্য গ্রেট এস্কেপ’। আর এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল বিশ্বব্যাপী অবকাঠামোর উন্নয়ন।
১৯০০-এর দশকের শুরু থেকেই বিশ্বের শহরগুলোতে মানুষেরা তাদের পানীয় জলে আণুবীক্ষণিক পরিমাণে ক্লোরিন খেতে শুরু করলেন। ক্লোরিন বেশি করে পেটে গেলে তা বিষ হিসেবেই কাজ করে, কিন্তু অতি ক্ষুদ্র পরিমাণে ক্লোরিন শরীরে গেলে মানুষের কোনো ক্ষতি হয় না বরং কলেরার মতো রোগসৃষ্টিকারী অনেক ব্যাকটেরিয়া নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা উন্নত অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সহায়তায় ক্লোরিনসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের জীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা পরীক্ষা করতে সক্ষম হলেন। এ ধরনের অনেকগুলো পরীক্ষার পর, জন লিল নামক একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ জার্সি সিটির একটি জলাধারে সবার অগোচরে ক্লোরিন ঢেলে দেন। তার এ কাজের সাফল্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরে জলাধারগুলোতে ক্লোরিন মেশানো শুরু হয়।
একই সময়ে টিকার বিকাশ নিয়েও বিস্তর গবেষণা করা হয়। ১৯১৪ সালে হুপিং কাশির টিকা তৈরি হয়। এরপর ১৯২১ সালে যক্ষ্মা এবং দুবছর পরে ডিপথেরিয়ার টিকা তৈরি করতে শেখে মানুষ। এরপর ১৯৫০-এর দশকে পোলিওর টিকা আবিষ্কার করে বিখ্যাত হয়ে যান জোনাস সল্ক। ‘গ্রেট এস্কেপ’-এর ক্ষেত্রে টিকা ভূমিকা রাখলেও গতানুগতিক ওষুধপত্র খুব বেশি কাজে লাগেনি।
তখনো এখনকার মতো রাজ্যের ওষুধ ছিল, কিন্তু অনেক ওষুধই কাজ করত না। সেই সময় ওষুধ নির্মাণ, বিপণন ইত্যাদি দেখার জন্য আমেরিকাতেও কোনও সংস্থা ছিল না। বর্তমানে দেশটির সুপরিচিত ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) ১৯০১ সালে জন্মের পর থেকে দীর্ঘ সময় নখদন্তহীন বাঘ ছিলÑসেটা অবশ্য কোনো বাহ্যিক চাপে পড়ে নয়, বরং তখনকার ওষুধ খাতের পরিস্থিতির কারণে।
২০ শতকের মাঝামাঝি এসে অবশেষে ওষুধপত্র মানুষের আয়ু বাড়াতে ভূমিকা রাখতে শুরু করল। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বরে স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। এর ১৭ বছর পরে যুগান্তকারী এ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চাহিদার চাপে প্রচুর পরিমাণ পেনিসিলিন তৈরির জন্য মিত্রপক্ষ ম্যানহাটন প্রজেক্টের মতোই একটি কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছিল। তবে ফ্লেমিং নয়, পেনিসিলিনের জীবন রক্ষাকারী ভূমিকার কথা টের পেয়েছিলেন দুই অক্সফোর্ড বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরি ও আর্নস্ট বরিস চেইন।
পেনিসিলিনের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিয়ে সীমাবদ্ধতার মুখে পড়তে হয় তাদের। ফ্লোরি এ সমস্যা সমাধানে মার্কিনদের সাহায্য চান। রকফেলার ফাউন্ডেশন-এর প্রধান ওয়ারেন ওইভার তাকে এ গবেষণার তহবিল দিতে রাজি হন। ১৯৪১ সালের ১ জুলাই ফ্লোরি ও তার অক্সফোর্ড দল বিশ্বের মোট পেনিসিলিনের বড় একটি অংশ সঙ্গে নিয়ে আমেরিকার বিমানে চড়ে বসেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের পেরিয়া শহরের এক গবেষণাগারে তারা কাজ শুরু করার পর মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীও তাদের গবেষণায় সহায়তা করতে শুরু করে। কারণ, আমেরিকার তখন এমন এক ওষুধের প্রয়োজন, যা ইউরোপে তার সেনাদের প্রাণঘাতী সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করবে।
মোল্ড ছত্রাক থেকে পেনিসিলিন তৈরির কাজ শুরু করেন তারা। পরে তারা আরও দ্রুতহারে পেনিসিলিন তৈরির জন্য অন্য উপাদান খুঁজতে শুরু করলেন। মার্কিন সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাটি সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও এ অভিযান চলতে থাকে।
তবে ১৯৪২ সালে পেরিয়াতেই এক জাতের খরমুজের মধ্যে একধরনের ছত্রাক পাওয়া গেল, যা থেকে আরও দ্রুত পেনিসিলিন তৈরি করা সম্ভব। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির অগ্রসর উৎপাদনপ্রক্রিয়া ব্যবহার করে পর্যাপ্ত পরিমাণে পেনিসিলিন উৎপাদন করা হয়। ১৯৪৪ সালের ৬ জুন নরম্যান্ডিতে অবতরণের সময় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র-রসদের পাশাপাশি পেনিসিলিনও ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে পেনিসিলিনসহ অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হয়। বিশ্বব্যাপী মানবস্বাস্থ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে এসব আবিষ্কার। যক্ষ্মার মতো রোগ থেকে মানুষ প্রায় পুরোপুরি মুক্তি পায়। ছোটখাটো কাটাছেঁড়া মারাত্মক সংক্রমণে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি বন্ধ হয়। বড় বড় অস্ত্রোপচারের দ্বারও উন্মুক্ত করে দেয় এ অ্যান্টিবায়োটিকগুলো।
চিকিৎসকেরা এরপর থেকে কার্যকর ওষুধ রোগীর ওপর ব্যবহার শুরু করতে পারলেন। ছোটখাটো অস্ত্রোপচারের সময় কোনো প্রাণঘাতী সংক্রমণের কারণ হয়ে ওঠাও বন্ধ করে এসব অ্যান্টিবায়োটিক। আর মানুষ পায় দ্বিতীয় জীবন।
এসডব্লিউএসএস১২৪০
আপনার মতামত জানানঃ