ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড়ের সুবিধা তুলে নেওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন (জানুয়ারি-মার্চ) মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। এতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। খেলাপির এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
গতকাল রোববার (২৮ মে) বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত মার্চ-২০২৩ প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
করোনার প্রভাব মোকাবিলায় ঋণ পরিশোধে দফায় দফায় ছাড় এবং ঋণ পুনঃতফশিলের নতুন নীতিমালা করে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী সেটি কার্যকর বা ফলপ্রসূ হয়নি। এখন ঋণ পরিশোধে সব ধরনের সুবিধা তুলে নেওয়ায় খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয় বলে ধরা হয়।
খেলাপিদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়, এ কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে দাবি করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, যারা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছেন না তাদের শাস্তি না দিয়ে নানাভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ কারণে খেলাপিরা ঋণের টাকা শোধ করছেন না। বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে খেলাপি বাড়তে থাকবে। তাই যারা খেলাপি তাদের ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। ঋণ আদায় নিশ্চিত করতে হবে। যারা ঋণ পরিশোধ করবে না তাদের শাস্তি দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। তিন মাস আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ হাজার কোটি টাকা।
এর আগে ২০২২ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা সেই সময়ের মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ ছিল।
সেই হিসাবে গত বছরের মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় এ বছরের একই প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আর দুই বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
২০২০ সালে করোনার প্রভাব মোকাবিলা ও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় দেয়। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও ‘খেলাপি’ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। পরের বছর ২০২১ সালে বলা হয় একজন গ্রাহকের যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা কেউ তার মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে খেলাপি হবেন না।
করোনার প্রভাব কমে আসলে গত বছরের জুনে সার্কুলার দিয়ে জানানো হয়, ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে কিস্তির ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধ করলে খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচা যাবে। পরে অবশ্য রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই হার কমিয়ে ৫০ শতাংশ করে। এ সিদ্ধান্তের প্রভাবে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকে। চলতি বছর থেকে ওইসব সুবিধা তা তুলে নেওয়ায় আবারও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
আইএমএফের শর্তের কী হবে?
গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে বাজেট-সহায়তা হিসেবে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয় এবং অর্থছাড়ও শুরু করে। এই ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করা। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে বিশেষ তাগিদ দেয় আইএমএফ। যাতে দেশের ব্যাংক খাত বড় ধরনের কোনো ঝুঁকিতে না পড়ে।
আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের অবস্থা খুবই শোচনীয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ মাস শেষে সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ খেলাপি হয়ে আছে।
বেসরকারি ব্যাংকে আলোচিত সময়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ১১ লাখ ৫ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে আছে ৬৫ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ২৭ কোটি টাকা; যার মধ্যে ৩ হাজার ৪১ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ খেলাপি এবং বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলোর ৩৬ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ বা ৪ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে।
দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে ঋণখেলাপীরা
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। কেউ কেউ আবার বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। কেউ ঋণখেলাপি হয়ে দেশত্যাগের পথ খুঁজছেন। ইতোমধ্যে অনেকে পালিয়ে গেছেন। একবার পালিয়ে গেলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে অর্থ আদায়। এমন পরিস্থিতিতে ঋণখেলাপি গ্রাহকদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। তাদের বিদেশে পালানো ঠেকাতে পুলিশের সহযোগিতা চাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কমার্স (আইএফআইসি) ব্যাংকের গ্রাহক মোহাম্মদ আলী। খেলাপির অভিযোগে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালতে তার নামে মামলা করে আইএফআইসি ব্যাংক। মামলায় তার স্ত্রী ও সন্তানকেও আসামি করা হয়। তার খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬১ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের মহাখালী শাখার গ্রাহক মো. মনির উদ্দিন। তার কাছে ব্যাংকের পাওনা ২৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বাধ্য হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। কিন্তু দীর্ঘদিন মনির উদ্দিন মামলায় হাজিরা না দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জমা দেওয়া পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম আদালতে বিচারাধীন শীর্ষ ঋণখেলাপিদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী অন্যতম। ২০টির বেশি মামলায় চট্টগ্রামের ইমাম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ আলী ও সংশ্লিষ্টদের কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা দেড় হাজার কোটি টাকার ওপরে।
একই অভিযোগে পেনিনসুলা স্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম, তার স্ত্রী রাশেদা জাফর, ছেলে জুনায়েদ আলম ও ভাই আবুল আলমের পাসপোর্ট জব্দের আদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালত এ আদেশ দেন।
এসডব্লিউএসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ