মানবদেহের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ হল মস্তিষ্ক। দুর্ঘটনায় শরীরের বাকি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও, মস্তিষ্কে সামান্য আঘাতই অনেকক্ষেত্রে হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী। আর করোটিতে যদি সরাসরি আঘাত করে বন্দুকের গুলি, তাহলে মৃত্যুই একমাত্র পরিণতি।
তবে আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েও অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের এক সেনা।
নাম তার জ্যাকব মিলার। নবম ইন্ডিয়ানা পদাতিক বাহিনীর ইউনিয়ন আর্মির সৈনিক ছিলেন জ্যাকব। ১৮৬১ সাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছিলেন তিনি। অংশ নিয়েছিলেন পশ্চিম ভার্জিনিয়া, করিন্থ প্যাসেজ, কেনটাকি পেরিভিল, স্টোনস রিভার-সহ একাধিক যুদ্ধক্ষেত্রে। তবে যুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটেছিল চিকামগায়।
ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ছিল ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৬৩। সদ্য কেনটাকি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে চিকামগায় এসে হাজির হয়েছিলেন জ্যাকব। আর দ্বিতীয় দিনেই ঘটে যায় সেই আশ্চর্য ঘটনা। বিপক্ষ দল অর্থাৎ কনফেডারেট সৈনিকদের মাস্কেট থেকে একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় তার কপালে, ঠিক দুই চোখের মধ্যবর্তী অংশে। তৎক্ষণাৎই মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন জ্যাকব। কোনোক্রমে তাঁর দেহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে।
অবশ্য তখন দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে মিলারের। এমনকি তার ক্যাপ্টেনও মৃত হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিল তাকে। কিন্তু কে-ই বা জানত মৃত্যুর মুখ থেকেও জীবনে ফিরে আসবেন তিনি। হ্যাঁ, কয়েক মুহূর্ত পরেই প্রাণ ফিরে আসে মিলারের শরীরে।
এমনকি পরবর্তীতে তিনি এও জানিয়েছিলেন, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া অবস্থায় তিনি নাকি শুনতে পেয়েছিলেন, তাঁর ক্যাপ্টেনের সেনা চিকিৎসককে বলছেন, ‘জ্যাকব যেহেতু মৃত, তাঁর মাথা থেকে বুলেট অপসারণ করার কোনো অর্থই হয় না।’ জ্যাকবের এই বক্তব্য যে মনগড়া নয়, তা পরে নিশ্চিত করেছিলেন তাঁর ক্যাপ্টেন এবং সেনা চিকিৎসক।
অবশ্য অলৌকিকভাবে প্রাণে বাঁচলেও, বারুদের জেরে নষ্ট হয়ে যায় জ্যাকবের একটি চোখ। এক চোখে সম্পূর্ণভাবে দৃষ্টিশক্তি হারান তিনি। জখম হয়েছিল অন্য চোখটিও। আর মাথায় বিদ্ধ হয়ে থাকা বুলেটটি? সে-যুগের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত ছিল না আজকের মতো।
ফলে অধিকাংশ চিকিৎসকই জানিয়েছিলেন, বুলেটটি জ্যাকবের করোটি থেকে অপসারণ করলেই অনিবার্যভাবে মৃত্যু হবে তার। শুরু হবে অনিয়ন্ত্রিত রক্তক্ষরণ। ফলে, সেলাই করে দেওয়া হয়েছিল ক্ষতস্থান। অন্যদিকে করোটির হাড়ের মধ্যেই থেকে যায় মাস্কেট বলটি।
শুধুমাত্র ড্রেসিং এবং ওষুধের ওপর ভরসা করেই পরবর্তী ১৭ বছর কাটিয়েছিলেন জ্যাকব। সবসময় সমস্যা না-হলেও, মাঝেমধ্যই অসহ্য মাথা যন্ত্রণার শিকার হতেন তিনি। একমাত্র সমাধান ছিল পেইন-কিলার। শেষ পর্যন্ত ১৮৮০ সালে লোগানস্পোর্টের চিকিৎসক গ্রাহাম ফিচ এবং হেনরি কোলম্যান জ্যাকবকে প্রতিশ্রুতি দেন বুলেট অপসারণের।
তবে সম্পূর্ণ সফল হননি তারাও। নিষ্কাশন সম্ভব হয়েছিল মাস্কেট বলটির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। সেইসঙ্গে অপসারিত হয়েছিল মস্তিষ্কের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা করোটির হাড়ের টুকরো।
এরপর প্রায় ২৭ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। ১৯১৭ সালে ৮৮ বছর বয়সে প্রয়াত হন জ্যাকব। মৃত্যুর আগে নিজের ডায়েরিতে লিখে গিয়েছিলেন, প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার গভীর ক্ষতটিকে দেখতেন তিনি। এই ক্ষতই নাকি হয়ে উঠেছিল তার অন্যতম পরিচয়।
এসডব্লিউএসএস২১০০
আপনার মতামত জানানঃ