প্রাচীন রোমের কথা শুনলেই কলোসিয়াম, গ্ল্যাডিয়েটর, কেন পরাক্রমশালী রোমান সাম্রাজ্যের পতন হলো- এমন সব চিন্তাভাবনা আমাদের ঘিরে ধরে। সেই ভাবনার পালে হাওয়া দিতেই আজ আলোচনা করা হবে প্রাচীন রোমের ভয়াবহ সব নির্যাতন নিয়ে।
সেই নির্যাতনগুলোর নৃশংসতা এতটাই লাগামছাড়া ছিলো যে, হাজার বছর পর আজ ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিনে সেসব নিয়ে পড়ে আপনার বুকের ভেতরটা সামান্য কেঁপে উঠলেও তাতে অবাক হবার কিছু থাকবে না!
গাধার ভেতর ঢুকিয়ে রাখা
দৈনন্দিন জীবনে সামনাসামনি গাধা নামক প্রাণীকে আমরা যত কমই দেখি না কেন, কাউকে কোনো প্রাণীর নামে সম্বোধনে সম্ভবত গাধাই সবচেয়ে উপরে অবস্থান করছে। অমানুষিক পরিশ্রম বোঝাতে আমরা বলি ‘গাধার মতো খাটুনি’, আবার কারো স্থূলবুদ্ধি বোঝাতে বলে থাকি ‘গাধার মতো কথাবার্তা/বুদ্ধি’ টাইপের কথাগুলো।
আজকের দিনে গাধাকে নিয়ে আমরা যতই রসিকতা করি না কেন, প্রাচীন রোমানদের কাছে কিন্তু গাধা ছিলো এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম! নিরীহ এ প্রাণীকে ভয়ের আসলে কিছু ছিলো না। ভয় ছিলো এক শাস্তির সাথে এই প্রাণীর সংশ্লিষ্টতার জন্যই। অ্যাপুলিয়াস (ল্যাটিন ভাষায় গদ্য রচয়িতা, প্লেটোনীয় দার্শনিক এবং বক্তা) ও লুসিয়ানের (গ্রীক ব্যঙ্গসাহিত্য রচয়িতা এবং বক্তা) সাহিত্যকর্ম থেকে এর প্রমাণ মেলে।
এ উদ্দেশ্যে প্রথমে একটি গাধাকে মারা হতো। এরপর এর পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করা হতো। এবার অপরাধীর পরনের জামা-কাপড় খুলে হাত-পা বেঁধে তাকে গাধার ভেতর ঢোকানো হতো, সেলাই করে দেয়া হতো গাধার পেট, শুধু বাইরে রাখা হতো মানুষটির মাথা। এটা তো ছিলো নির্যাতনের কেবলমাত্র শুরুর কথা। আসল কষ্ট তো এখনও শুরুই হয় নি।
এবার গাধার মৃতদেহ কিংবা গাধার ভেতরে লোকটিকে, যা-ই বলা হোক না কেন, রেখে দেয়া হতো উত্তপ্ত রৌদ্রের নিচে। সূর্যের তাপে আস্তে আস্তে মৃতদেহে পচন ধরতে শুরু করতো। ওদিকে ভেতরে থাকা মানুষটির তখন গরমে জান যায় যায় অবস্থা। পচা অংশে জন্ম নেয়া পোকামাকড় উঠতে শুরু করতো লোকটির শরীরেও, আকাশ থেকে নেমে আসা শকুনের দল ঠোকরাতে শুরু করতো তার শরীরে। এভাবে বেশ কিছুদিন অমানবিক কষ্ট ভোগের পর অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো সেই অপরাধী।
বুনো শূকরের খাবার
হেলিওপোলিস যখন রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিলো, তখনকার সময়ের একটি নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেছেন সেইন্ট গ্রেগরি।
যদি কোনো কিশোরী কিংবা তরুণী কোনো বড় ধরনের অপরাধে অভিযুক্ত হতো, তাহলে প্রথমে সবার সামনে তার পরনের জামা-কাপড় খুলে নেয়া হতো। এর পরপরই মেয়েটির পেট চিরে ফেলা হতো। মেয়েটি যখন যন্ত্রণায় আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করতে থাকতো, তখন শাস্তি প্রদানকারীরা ব্যস্ত থাকতো তার পেটের কাটা অংশটি যব দিয়ে ভরতে। ভরা হয়ে গেলে আবার পেট সেলাই করে দেয়া হতো। এত অত্যাচারের পর মেয়েটিকে ছেড়ে দেয়া হতো বুনো শূকরের সামনে। প্রাণীটি এরপর মেয়েটিকে টুকরো টুকরো করে ফেলতো।
এমন শাস্তির শিকার হয়েছিলেন সেইন্ট অ্যাগনেস, সেইন্ট প্রিস্কা ও সেইন্ট ইউফেমিয়া অফ অ্যাকুইলেইয়া। এখানে আরেকটা কথা আছে, সম্ভবত এটাই এ নির্যাতনের সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাস্তির মুখোমুখি মেয়েটি হতো কুমারী। ওদিকে রোমান আইনে কুমারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিলো না। এজন্য প্রথমে মেয়েটিকে তুলে দেয়া হতো একজন গ্ল্যাডিয়েটরের হাতে। সেই গ্ল্যাডিয়েটর মেয়েটিকে ধর্ষণ করার পরই তার উপর দিয়ে পরবর্তী ঝড়গুলো যেত।
ব্যারেলে নির্যাতন
৮১ থেকে ৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমের সম্রাট ছিলেন ডোমিশিয়ান। এ সাম্রাজ্যের একাদশ সম্রাট ছিলেন তিনি। তার শাসনামলে সেখানে বসবাসকারী খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেদের উপর নেমে এসেছিলো ভয়াবহ সব নির্যাতন।
নানা ধরনের নির্যাতনের মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিলো ব্যারেল সম্পর্কিত নির্যাতনটি। এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির পুরো দেহ প্রথমে মধু ও দুধ দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে দেয়া হতো। এরপর তাকে একটি ব্যারেলে আটকে রাখা হতো, খেতে দেয়া হতো পচে পোকা ওঠা সব খাবারদাবার। সেসব খাবার খেয়ে ধীরে ধীরে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়তো লোকটি। আনুমানিক দু’সপ্তাহ পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো সেই দুর্ভাগা।
জীবন্ত কবর
সম্রাট নিরো সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতেন মানুষকে জীবন্ত কবর দিয়ে। এ আনন্দ আরো বেশি হয়ে ধরা দিতো, যখন তিনি কোনো ভেস্টাল ভার্জিনকে তাদের সতীত্ব সংক্রান্ত শপথভঙ্গের জন্য এ শাস্তি দিতেন। একবার তিনি এমন শাস্তি দিয়েছিলেন যাজিকা রুব্রিয়াকে। তাকে একটি ছোট গুহায় আটক করে রেখে আসা হয়েছিলো কোনো রকম দানাপানি ছাড়াই। সেখানেই কিছুদিন পর না খেতে পেয়ে মারা যান তিনি।
আরেক ক্ষেত্রে অপরাধীকে প্রথমে নিজের কবর নিজেকেই খনন করতে হতো। এরপর সেই কবরে রাখা হতো সূক্ষ্ম প্রান্তযুক্ত একটি লাঠি। লোকটিকে হাত-পা বেঁধে এরপর কবরে ফেলা হতো। যদি তার অপরাধের মাত্রা কম হতো, তাহলে এমনভাবে নিক্ষেপ করা হতো, যেন লাঠির চোখা অংশটি সরাসরি তার হৃদপিণ্ড ভেদ করে চলে যায়, অর্থাৎ তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়।
আর যদি কারো অপরাধের মাত্রা কম হতো, তাহলে এমনভাবে নিক্ষেপ করা হতো, যেন সে মারাত্মক রকমের আহত হয়। এরপর তাকে সেখানেই ফেলে আসা হতো, কিংবা দেয়া হতো জীবন্ত কবর।
কলড্রন টর্চার
এ নির্যাতনের পদ্ধতিটি বেশ ভয়াবহ। এজন্য প্রথমে কোনো ক্ষুধার্ত ইঁদুর, কুকুর কিংবা বেড়ালকে ছোট কলড্রনে আটকে রাখা হতো। এরপর কলড্রনের খোলা প্রান্তটি অপরাধীর পেটের দিকে মুখ করে আটকে দেয়া হতো।
এবার শাস্তিদানে নিয়োজিত ব্যক্তি এসে কলড্রনের পেছনে আগুনের উত্তাপ দিতেন। ক্ষুধার্ত প্রাণীটি তখন জীবন বাঁচাতে সামনের দিকে ছুট লাগাতো। সামনে থাকা বন্দীর পেটের মতো নরম মাংস পেয়ে সে সেটা খেয়েই তার ভেতর দিয়ে পালাতে চাইতো!
চিন্তা করে দেখুন তো একবার অবস্থাটি- জীবিত অবস্থায় কেউ যখন টের পায় তার নাড়িভুঁড়ি খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে কোনো প্রাণী, তখন তার অবস্থা কেমন হতে পারে?
এসডব্লিউএসএস/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ