পৃথিবীর ইতিহাসে মহান শাসকদের অন্যতম আকবর দি গ্রেট। মুঘল সম্রাটদের সেরা সম্রাটের পুরো নাম জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। নিজের শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে সম্রাট আকবর ইতিহাসকে যতটা প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, ততটা খুব কম ভারতীয় শাসকই করতে পেরেছিলেন। তাকে ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে ধরা হয়। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট ছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে আকবর ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন।
ইতিহাস বইতে ‘মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক’ হিসেবে তাঁর ছবিটিই উঠে এসেছে বারবার। দিল্লি, আগ্রা জুড়ে অসংখ্য কীর্তি তাঁর। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ ভিড় জমান সেসব জায়গায়। এদেরই মাঝে আগ্রার ওয়াজিরপুরের পাশে, সিভিল লাইনস কমলা নগরের ঠিকানায় দাঁড়িয়ে আছে আরও একটি স্থাপত্য। হলুদ-সাদা রঙের একটি গির্জা; নাম ‘চার্চ অফ পিয়েটা’। তবে এটা তো পোশাকি নাম। আগ্রার মানুষের কাছে এর পরিচয় ‘আকবর চার্চ’ বা আকবরের গির্জা হিসেবে।
চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই স্থাপত্যটি। পেছনে ফিরে তাকালে উঠে আসবে নানা ঘটনা। কোনটি ভালো, আবার কোনটির গায়ে অন্ধকারের স্পর্শ পড়েছে। ইতিহাসে আকবর পরিচিত ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম শাসক হিসেবে। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য ধর্মকে অবজ্ঞা করেননি তিনি। ‘দীন-ই-ইলাহি’র প্রবক্তা চেয়েছিলেন অন্যান্য ধর্মের গভীর দর্শনকেও উপলব্ধি করতে। এইভাবেই একবার খ্রিস্টধর্মের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হল।
ততদিনে ভারতে চলে এসেছে খ্রিস্টীয় মিশনারিরা। গোয়ায় জেসুইট পাদ্রিরা যিশুর বাণী প্রচার করতেও শুরু করে দিয়েছেন। এমন সময় স্বয়ং মুঘল বাদশাহর তলব এল তাঁদের কাছে। জেসুইট মিশনারিদের কাছে খ্রিস্ট ধর্ম এবং দর্শন সম্পর্কে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন আকবর। সেইমতো তাঁরাও চলে এলেন আগ্রায়। বাদশাহর কাছে হাজির করলেন যিশুর বাণী। সময়টা ছিল ষোড়শ শতকের শেষের পর্যায়। কেবলই কি তত্ত্বকথা শোনানোর জন্যই এই আগমন? খ্রিস্টান মিশনারিদের লক্ষ্য, যদি স্বয়ং আকবরের অনুমতি পাওয়া যায়, তাহলে আগ্রার বুকেও খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করা যাবে।
আগ্রায় আগমনের পর মিশনারিরা লক্ষ্য করলেন, শহরের বুকে ধীরে ধীরে বিদেশি ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়ছে। বেশিরভাগই আর্মেনিয় খ্রিস্টান। কেমন হয়, যদি উপাসনার জন্য একটি গির্জা প্রস্তুত করা যায়? আকবরের কাছে একসময় প্রস্তাবটি দেওয়া হল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনুমতি দিলেন বাদশাহ। কেবল অনুমতিই নয়; সঙ্গে দিলেন বেশ কিছু অর্থও। শুরু হল গির্জা তৈরির কাজ। ১৫৯৮ সাল। নতুন একটি শতাব্দী উপস্থিত দোরগোড়ায়। আর তখনই আগ্রায় মাথা তুলে দাঁড়াল ‘চার্চ অফ পিয়েটা’। খ্রিস্টান পাদ্রিদের ওপর আকবরের অনুগ্রহের কথাও জনমহলে গোপন রইল না। দেখতে দেখতে ‘চার্চ অফ পিয়েটা’ হয়ে উঠল ‘আকবরের গির্জা’। একজন মুসলিম শাসক হয়ে উঠলেন খ্রিস্টান চার্চের পরিচায়ক।
কেবল আকবরই নন, তাঁর পুত্র বাদশাহ জাহাঙ্গিরও এই গির্জার জন্য বহু অর্থ দান করেছিলেন। গির্জাটি যাতে আরও সমৃদ্ধ হয়, সেই চেষ্টাও করেছিলেন। আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, ১৬১০ সালে, দানিয়াল মির্জার পুত্র এবং জাহাঙ্গিরের তিন ভাইপো – তাহমুরাস, বৈসানঘর এবং হোশান মির্জাও এই গির্জাতেই খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন! খ্রিস্টান হওয়ার পর তাঁদের নামও বদলে যায়। তখন তাঁদের পরিচিতি হয় যথাক্রমে ডন ফিলিপ, ডন কার্লোস এবং ডন হেনরিকে নামে। শোনা যায়, খোদ জাহাঙ্গিরের আদেশেই নাকি তাঁরা খ্রিস্টান হয়েছিলেন। যদিও এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মুঘল আমলে, খোদ রাজপরিবারের কোনো ব্যক্তি ধর্ম পরিবর্তন করে খ্রিস্টান হয়েছেন, এমন নিদর্শন কি খুব একটা দেখা যায়? অবশ্য বেশিদিন খ্রিস্ট ধর্মের ভেতর থাকেননি তাঁরা। চার বছর পর আবারও মুসলিম ধর্মে ফিরে আসেন। শোনা যায় পরবর্তীকালে ফারজানা জেব-উন-নিসা, ওরফে বেগম সামরুও এই গির্জাতেই খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন।
ঠিকঠাকই চলছিল সব। সিংহাসনে এখন জাহাঙ্গির-পুত্র শাহজাহান । এমন সময় তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হল পর্তুগিজদের। সেইসঙ্গে আগ্রায় ক্রমবর্ধমান জেসুইট পাদ্রিদের নিয়ে বিরক্ত মুঘল প্রাসাদ। ১৬৩৫ সাল। শাহজাহান ঠিক করলেন, অনেক হয়েছে আর নয়। জেসুইট পাদ্রিদের বন্দি তো করলেনই; সেইসঙ্গে কোপ বসালেন ‘আকবর চার্চ’-এর ওপর। পুরো ভেঙে দিলেন সেই স্থাপত্য। অবশ্য পরবর্তীতে খ্রিস্টান মিশনারিরা শাহজাহানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর, বাদশাহ নিজের উদ্যোগে, এক বছর পরেই আবার গির্জাটি তৈরি করার বন্দোবস্ত করেন।
তবে ধ্বংসলীলা এখনও বাকি আছে। ১৭৬১ সাল। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ দেখে ফেলেছে ভারত ভূখণ্ড। মারাঠার বিপরীতে হাজির আফগান শাসক আহমেদ শাহ আবদালি। কেবল যুদ্ধ করেই ক্ষান্ত হলেন না তিনি; সেইসঙ্গে চলল প্রভূত লুঠতরাজ। আগ্রাও তাঁর গ্রাস থেকে বাইরে গেল না। আহমেদ শাহ হাজির হলেন ‘আকবর গির্জা’য়। তিনি এবং তাঁর সৈন্যরা মিলে ব্যাপক লুঠ করল। গির্জাটি আরও একবার ধ্বংসলীলা দেখল। এখন তো মুঘলদেরও জোর কমে গেছে। ভাগ্যক্রমে, ওয়াল্টার রেইনহার্ট নামের এক ইউরোপীয় গির্জাটির মেরামতে সাহায্য করেন।
এসডব্লিউ/এসএস/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ