পাবনায় নির্মানাধীণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেশিনারি পণ্যের আরও একটি চালান মোংলা বন্দরে এসে পৌঁছেছে। গত মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে বন্দরের ৮ নম্বর জেটিতে এসে ভেড়ে দুই হাজার ৫২২ মেট্রিকটন মেশিনারি পণ্য নিয়ে রুশ পতাকাবাহী ‘এম ভি ইয়ামাল ওরল্যান’ জাহাজটি। জাহাজটিতে ১৭ জন রাশিয়ান নাবিক রয়েছেন। মালামাল খালাস করে জাহাজটি ভারতের উদ্দেশ্যে বন্দর ত্যাগ করার কথা রয়েছে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার বিভাগ এই তথ্য জানিয়েছে।
জাহাজটির স্থানীয় শিপিং এজেন্ট কনভেয়ার শিপিং এজেন্টের খুলনার ব্যবস্থাপক অপারেশন সাধন কুমার চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, ‘গত মাসের ২৮ তারিখ জাহাজটি রাশিয়ার নোভরোসিস্ক বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে ছেড়ে আসে। জাহাজটিতে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ৩০০ প্যাকেজের ২ হাজার ৫২২ মেট্রিকটন মেশিনারি পণ্য আনা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর থেকে থেকে এই পণ্য খালাস শুরু হয়েছে।’ তিনদিনের মধ্যে খালাস শেষে এসব পণ্য সড়ক পথে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, গত বছরের শুরুতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান ঘিরে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে নতুন করে যে ‘শীতল যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে, তার রেশ এবার এসে পড়েছে বাংলাদেশে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জারি করা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার নানামুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দুনিয়ার দেশে দেশে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ওই নিষেধাজ্ঞা যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশ বাস্তবায়ন না করে সেজন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে অব্যাহতভাবে তদবির করছে ঢাকাস্থ রাশিয়ান দূতাবাস। তবে মার্কিন দূতাবাসও কম যাচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বিষয়ে তারা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশকে সতর্ক করে চলেছে। উভয় পক্ষের এই পাল্টাপাল্টিতে বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশের দায়িত্বশীল কূটনীতিকরা।
নিয়মিত বিরতিতে ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি সেগুনবাগিচাকে এ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা বলছেন, ইউক্রেনে হামলার কারণে মস্কোকে আরও চাপে ফেলতে চায় ওয়াশিংটন। তারই ধারাবাহিকতায় রাশিয়ার ৮০ প্রতিষ্ঠান ও একক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সদ্য দেয়া এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় অন্যতম প্রতিষ্ঠান রোসাটম।
এতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে রোসাটমের তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন নিয়ে। সম্প্রতি রোসাটমের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ঢাকাকে কূটনৈতিক পত্র পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। যদিও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে রোসাটমের বক্তব্য হচ্ছে- রোসাটম-সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকে প্রভাবিত করবে না বরং এই প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে তারা। রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে।
এতে বলা হয়, রাশিয়ার যেসব প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা অন্য দেশের প্রতিষ্ঠান ইউক্রেন যুদ্ধে মদত দিয়েছে বা দিচ্ছে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে মদত দেয়ার অভিযোগ তুলে চীনের প্রতিষ্ঠান ‘হেড অ্যারোস্পেস টেকনোলজি’র বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। চীনের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছেÑ তারা ইউক্রেনের ওপর থেকে স্যাটেলাইট দিয়ে ছবি তুলে রাশিয়াকে সরবরাহ করেছে। গত ১২ই এপ্রিল ৮০ প্রতিষ্ঠান ও একক ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তালিকা প্রকাশ করা হয়।
এ তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশে থাকা সম্পদ, ব্যাংক হিসাবসহ সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা রাশিয়ার অন্যতম ধনকুবের ও ওলিগার আলিসের উসমানোভের বিশ্বের অন্যতম দামি প্রমোদতরী ইতিমধ্যে জব্দ করেছে জার্মানি।
রোসাটমের সংশ্লিষ্ট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান এবং রোসাটম ওভারসিসের প্রেসিডেন্ট ইভজেনি পাকেরমানভের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞায় থাকা রোসাটমের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- দ্য ফেডারেল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড প্রোডাক্টশন সেন্টার এম.ভি. প্রোটসেনকো স্টার্ট প্রোডাকশন এসোসিয়েশন, রোসাটম ওভারসিস, কভরভ মেকানিক্যাল প্ল্যান্ট (কেএমজেড), ভøাদিমির টচম্যাশ এবং জেএসসি নাউচানো-ইসলেডোভাটেলস্কি আই কনস্ট্রাক্টর স্কাই ইনস্টিটিউট মনটাজনয় টেকনোলজি অ্যাটোমসট্রয়। দ্য ফেডারেল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড প্রোডাক্টশন সেন্টার এম.ভি. প্রোটসেনকো স্টার্ট প্রোডাকশন এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠানকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে রাশিয়ার অর্থনীতিতে প্রতিরক্ষা এবং এ-সংক্রান্ত পণ্য সহযোগিতার জন্য।
এ প্রতিষ্ঠানটি পরমাণু নিয়ে একটি জটিল প্রযুক্তি উৎপাদন করেছে বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। মার্কিন নথি মতে, রোসাটম ওভারসিস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাশিয়ার সরকারের হয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি রোসাটমের রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র উন্নয়ন, নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি বৈশ্বিক পরমাণু বাজারে রাশিয়াকে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সহযোগিতা করছে। এ প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ইভজেনি পাকেরমানভের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ভøাদিমির টচম্যাশ ও কভরভ মেকানিক্যাল প্ল্যান্ট (কেএমজেড) পরমাণু বিদ্যুৎ ও পরমাণুসংক্রান্ত সামগ্রী ও সরঞ্জাম উৎপাদন করে। যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাশিয়া সরকারকে সহযোগিতা করছে। ফলে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
মার্কিন নথিতে আরও বলা হয়, জেএসসি নাউচানো-ইসলেডোভাটেলস্কি আই কনস্ট্রাক্টর স্কাই ইনস্টিটিউট মনটাজনয় টেকনোলজি অ্যাটোমসট্রয় পরমাণু সংক্রান্ত প্রযুক্তি উন্নয়ন, নতুন অবকাঠামো নির্বাচনসহ ডিকমিশনিংয়ের কাজে জড়িত। যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাশিয়া সরকারকে সহযোগিতা করছে। ফলে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রোসাটমের যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তাদের সঙ্গে কাজ না করতে পারলে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ কে এগিয়ে নেবে, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ৭০ শতাংশের ওপর কাজ সম্পন্ন হলেও এখনো অনেক পণ্য ও যন্ত্রাংশ আমদানি বাকি রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব সামগ্রী কীভাবে এবং কোথা থেকে জোগাড় হবে তা অনিশ্চিত। শুধু এক রুশ জাহাজের নিষেধাজ্ঞার কারণে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু সরঞ্জাম পেতে প্রায় তিন মাস দেরি হয়েছে। এখন এ নিষেধাজ্ঞা প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়নে বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে। সমস্যা নিয়ে দরকষাকষি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। মার্কিন এ নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের বিষয়ে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
সেই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞায় থাকা কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে সুবিধা, তাদের ব্যবসায় অবদান রাখা, অর্থায়ন, পণ্য ক্রয় বা সেবাগ্রহণ করে থাকলে সেই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি একই ধরনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। তবে কেউ যদি যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে লাইসেন্স নিয়ে থাকে অথবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট কার্যালয় থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হবে না।
রোসাটমের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশে কি প্রভাব পড়বে- জানতে চাইলে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র শন ম্যাকিনটোশ সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক পত্র আদান-প্রদান করে থাকে। পত্রের বিষয়বস্তু সাধারণত গোপনই থাকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, মার্কিন দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে রোসাটমের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে যে কূটনৈতিক পত্র দেয়া হয়েছে, সেখানে রূপপুরের অর্থ পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করতে চায় তারা।
বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানাতে গত মঙ্গলবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা সিদ্ধান্ত নেবে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক ঠিক রাখতে কাজ করবে এবং করছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ কখনো কারও কাছে দেনায় পড়েনি। কিন্তু রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ দেনায় পড়ে গিয়েছিল। তা কাটিয়ে উঠতে চীনের মাধ্যমে রাশিয়ার দেনা পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রূপপুরের অর্থ পরিশোধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে নিশ্চিত করেছে সেগুনবাগিচা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ