ভাইকিংরা সমুদ্রের ত্রাস ছিলেন। তারা কলম্বাসের অনেক আগেই আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন এবং রাশিয়ার দূরবর্তী অঞ্চলে যতদূর পূর্বে যাওয়া যেতো প্রথম তাদের পায়ের ছাপই পাওয়া গিয়েছিলো। আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১ শতক পর্যন্ত, বিপুল সংখ্যক স্ক্যান্ডিনেভিয়ান তাদের ভাগ্যের অন্বেষণে জন্মভূমি ছেড়ে সমুদ্রে যাত্রা করে।
প্রথমে তারা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূলীয় স্থানগুলোতে, বিশেষ করে অরক্ষিত স্থানগুলোতে অভিযান চালায়। পরবর্তী তিন শতাব্দীতে তারা জলদস্যু, আক্রমণকারী, ব্যবসায়ী এবং বসতি স্থাপনকারী হিসেবে ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় মহাদেশের বেশিরভাগ অংশে আক্রমণ করে এবং আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড এবং নিউফাউন্ডল্যান্ডের কিছু অংশ তাদের দখলে নিয়ে নেন।
নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডে ভাইকিংরা বসতি স্থাপনের পাশাপাশি অভিযানের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত করে ইংল্যান্ড দখল করা। ভাইকিংসরা স্কটল্যান্ডের উত্তর দ্বীপপুঞ্জ (শেটল্যান্ড এবং অর্কনিস), হেব্রাইডস এবং মূল ভূখণ্ডের বেশিরভাগের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা প্রথমে আয়ারল্যান্ডের ব্যবসায়িক শহর: ডাবলিন, ওয়াটারফোর্ড, ওয়েক্সফোর্ড, উইকলো এবং লিমেরিক প্রতিষ্ঠা করেন এবং আয়ারল্যান্ডের মধ্যে এবং আইরিশ সাগর পেরিয়ে ইংল্যান্ডে আক্রমণ চালানোর জন্য আইরিশ উপকূলে তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করেছিলো। যদিও তারা পরবর্তীতে ইংল্যান্ড দখল করতে ব্যর্থ হয়।
এদের হাত থেকে ব্রিটিশরা বাঁচার পথ খুঁজতে থাকে এবং সমুদ্রগামী ব্যবসায়িক জাহাজের নিরাপত্তা দিতে ব্রিটিশ সরকার সমুদ্রে তাদের নিজস্ব নৌবাহিনী নিয়োজিত করে। তাদের সাথে ভাইকিংদের ইঁদুর বিড়ালের মতো সারা বছর যুদ্ধ লেগেই থাকতো। যা আমরা ডেপ-এর সিনেমাতে দেখেছি।
এবাফ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর সেই ভাইকিংদের সম্পর্কে নতুন করে তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত যুদ্ধজাহাজ, গণকবর ইত্যাদি থেকে পাওয়া মানুষের দাঁত ও বিভিন্ন অস্থি থেকে ভাইকিংসদের বিষয়ে নতুন তথ্য পাবেন বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৩০০ বছর আগে সুইডেনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে ডুবে গিয়েছিল একটি যুদ্ধজাহাজ। সেই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া গেছে বেশ কিছু মানুষের কঙ্কাল।
এ ছাড়াও সুইডেনের স্যান্ডি বর্গ দ্বীপের একটি গণকবর থেকেও পাওয়া গেছে বেশ কয়েকজনের হাড়। ধারণা হয়, পঞ্চম শতকে সংঘটিত ইতিহাসখ্যাত স্যান্ডি বর্গ গণহত্যার পরও তাদের একসঙ্গে পুতে ফেলা হয়েছিল।
সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ জন মানুষের এসব অস্থি বিজ্ঞানীদের ভাইকিংসদের উত্থান, বিকাশ এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়া সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করবে বলে ধারণা।
আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘সেলে’ এই বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই নিবন্ধে বলা হয়েছে, ৭৫০ সাল থেকে ১০৯৯ সাল পর্যন্ত ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ড থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষ স্থানান্তরিত হয়। এর ফলে সেখানকার ভাইকিংদের মধ্যে ব্যাপক জেনেটিক পরিবর্তন আসে।
একইসঙ্গে ভাইকিংরা সেই সময়টাতে ব্যাপকহারে আশপাশের এলাকাগুলো নিজেদের করে নিচ্ছিল। সোজা কথায় বললে, যে সময়টাতে নর্সমেনরা নিজেদের বিজয়কেত উড়াচ্ছিল ঠিক একই সময়ে তাদের জেনেটিক পরিবর্তনও সাধিত হচ্ছিল ব্যাপকভাবে।
এই বিষয়ে সুইডেনের আপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক নিল প্রাইস বলেছেন, ‘এই গবেষণা দেখিয়ে দেবে যে, ভাইকিংরা কেবল নিজেদের অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাইরের জগত সম্পর্কেও তারা অবগত ছিল।’
এই গবেষণার বিষয়ে কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনমূলক নৃতত্ত্বের অধ্যাপক মার্ক কলার্ড বলেছেন, ‘প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক নথি থেকে স্পষ্ট যে ভাইকিংরা অন্যদের বন্দী করেছিল। একই সঙ্গে এটিও নির্দেশ করে যে, বিপুল সংখ্যক দাস স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বাইরের অঞ্চলগুলো থেকেও আনা হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই সময়টিতে পূর্বদিকের দেশগুলো থেকে বিপুল পরিমাণে নারী ও শিশু স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। যার থেকে প্রমাণিত হয়, ভাইকিংরা নারী ও শিশুদেরও দাস হিসেবে প্রাধান্য দিত।’
এই নিবন্ধের অন্যতম গবেষক এবং স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের আণবিক নৃতত্ত্বের অধ্যাপক অ্যান্ডারস গোথারস্ট্রম বলেন, ‘এর বাইরেও অবশ্য কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় ভাইকিংদের অঞ্চলে চলে এসেছিল। এদের মধ্যে ছিল, খ্রিস্টান মিশনারী, কূটনীতিবিদ, সওদাগরসহ বিভিন্ন পেশার লোকেরা।’ তবে এসব বাহিরাগতরা স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি।
নতুন প্রাপ্ত এসব মানুষের জিন ভাইকিংসদের বিষয়ে নতুন তথ্য দিলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাত্র ৩০০ জনের নমুনা থেকে পুরো ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। তবে এই নমুনাগুলো ভবিষ্যতে আরও গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করে দিল।
এসডব্লিউএসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ