গাছের ওপর বজ্রপাতের ঘটনা হামেশাই দেখা যায় এ-দেশে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মহীরুহও চোখের নিমেষে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় বজ্রপাতে।
তেমনটাই হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডার ছোট্ট শহর পোর্ট রিচিতে। বাজ পড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল আস্ত একটি গাছ। সেইসঙ্গে গাছের আশপাশের মাটি এবং পাথরেও তৈরি হয়েছিল অদ্ভুত সব চিহ্ন। বদলে গিয়েছিল রং।
ব্যাপারটা আকর্ষণীয় মনে হওয়ায় স্থানীয় এক ভূতত্ত্ববিদের হাতে অল্প টাকার বিনিময়ে এই পাথর তুলে দিয়েছিলেন জমির মালিক। কিন্তু কে-ই বা জানত এই সামান্য পাথুরে নমুনাই নতুন পথ দেখাবে বিজ্ঞানকে!
একটুও বাড়িয়ে বলা নয়। বজ্রপাতে ‘পোড়া’ পাথর এবং গাছের অবশিষ্টাংশ থেকেই এবার আবিষ্কৃত হল ফসফরাস সমৃদ্ধ সম্পূর্ণ নতুন এক খনিজ পদার্থ। যা সাধারণত মহাকাশ কিংবা বিভিন্ন ধূমকেতুতে পাওয়া গেলেও, পৃথিবীর বুকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি এর আগে।
আশ্চর্য এই খনিজটির আবিষ্কারের নেপথ্যে রয়েছেন ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাথিউ পাসেক এবং ইতালির ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ফটিকতত্ত্বের অধ্যাপক লুকা বিন্দি।
নতুন খনিজটির বিশ্লেষণ, আবিষ্কার তো বটেই, তাছাড়াও কৃত্রিমভাবে এই খনিজ প্রস্তুত করা সম্ভব কিনা—তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন লুকা এবং ম্যাথিউ। সম্প্রতি সেই গবেষণাপত্র প্রকাশ পায় ‘কমিউনিকেশন আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ জার্নালে।
প্রশ্ন থেকে যায়, পৃথিবীর বুকে কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই বিশেষ খনিজটি? ম্যাথিউ-এর কথায়, বজ্রপাতের কারণে গাছ কিংবা সেই গাছের আশেপাশে অবস্থিত ঘাস পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার ঘটনা অতিসাধারণ।
তবে কখনও কখনও উচ্চবিভবের বজ্রপাতে আশেপাশের মাটি, পাথর কিংবা বালির মধ্যে দিয়েও প্রবাহিত হয় বিদ্যুৎ। উচ্চবিভবের বিদ্যুতের প্রভাবে সেই মাটি কিংবা পাথরের উপাদানের সঙ্গে গাছের পুড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ। এই ঘটনাকে বলা হয় ‘ফসিলাইজড লাইটনিং’।
আর এ-ধরনের বজ্রপাতের ফলে বদলে যাওয়া পাথর বা জন্ম নেওয়া নতুন পদার্থদের বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘ফালগুরাইট’।
পোর্ট রিচিতে বজ্রপাতের ফলে মূলত তৈরি হয়েছিল এইধরনের ফালগুরাইট। তবে তার গঠন পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হওয়া অন্যান্য ফালগুরাইটের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায়, গবেষণা শুরু করেছিলেন ম্যাথিউ এবং বিন্দি।
নমুনার বিশ্লেষণে উঠে আসে, সংশ্লিষ্ট ফালগুরাইটে তৈরি হওয়া পদার্থটি আদতেই সম্পূর্ণ নতুন একটি খনিজ। পৃথিবীর বুকে যা পাওয়া যায়নি এর আগে। পাশাপাশি ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করেও অনুরূপ স্ফটিক তৈরি করতে ব্যর্থ হন গবেষকরা।
তাদের অভিমত, বিশেষ সময়ের জন্য, বিশেষমাত্রার শক্তির প্রভাবেই তৈরি হয়েছিল এই খনিজটি।
গবেষকদের মতে, প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীতে এই-ধরনের ফালগুরাইট তৈরি হত বজ্রপাতের কারণে। সম্ভবত সেভাবেই পৃথিবীর বুকে জন্মায় ফসফাইট জলাধার। তবে ক্রমশ মুক্ত ফসফরাসের মাত্রা কমে যাওয়ায় এ-ধরনের খনিজ তৈরির প্রক্রিয়া বর্তমানে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই।
বজ্রপাতের সঙ্গে খনিজের সম্পর্ক, প্রকৃতি ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে বজ্রপাতের প্রভাব—ইত্যাদি একাধিক বৈজ্ঞানিক বিষয়কে আগামীদিনে বুঝতে বিশেষভাবে সাহায্য করবে এই সদ্য-আবিষ্কৃত খনিজটি, জানাচ্ছেন গবেষকরা। সবমিলিয়ে বিজ্ঞানকে এক নতুন দিগন্তের অনুসন্ধান দিল এই নতুন আবিষ্কার।
এসডব্লিউএসএস/২১৩০
আপনার মতামত জানানঃ