নিষ্ঠুরতায় তার সমকক্ষ শাসক না কি খুব কমই ছিল ভারতবর্ষে। একের পর এক নরমেধ যজ্ঞের রক্ত লেগে ছিল তার হাতে। ভারতের ইতিহাসে সবথেকে আলোচিত মুসলিম শাসকদের মধ্যে আকবর আর ঔরঙ্গজেবের পরেই উঠে আসে তার নাম। তিনি আর কেউ নয় খিলজি বংশের দ্বিতীয় শাসক আলাউদ্দিন খিলজি।
দিল্লির খিলজি বংশের সবচেয়ে বিতর্কিত শাসক আলাউদ্দিন। অনেকক্ষেত্রেই তাকে নৃশংস, অমানবিক হিন্দু-নিপীড়নকারী এক সুলতান হিসাবে তুলে ধরা হয়। প্রশ্ন হল, এর কতটা সত্যি?
ইতিহাস বলে, শাসক হিসাবে আলাউদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত সাহসী আর পরাক্রমশালী। তার শাসনকালে মধ্য এশিয়ার যাযাবর যুদ্ধবাজ মোঙ্গলেরা ভারত আক্রমণ করেছে বারবার। একবার দুবার নয়, ছ-ছবার এই দুর্ধর্ষ মোঙ্গলজাতির আক্রমণ থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করেছিলেন আলাউদ্দিন।
মোঙ্গলদের হত্যালীলা ও লুঠতরাজের বিরুদ্ধে সেদিন আলাউদ্দিন খিলজি যে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তা না থাকলে ভারতবর্ষের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হত আজ।
ছ’বার মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করেন আলাউদ্দিন। তারপরেও আলাউদ্দিন খিলজিকে এক অমানবিক নিষ্ঠুর শাসক হিসাবে তুলে ধরা হয় বারবার। কেন? কেমন ছিলেন শাসক আলাউদ্দিন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের প্রাচীন ভারতবর্ষের কাছে
আলাউদ্দিনের শৈশব সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়না। তবে ইতিহাস বলে, তিনি বহিরাগত নন। ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই ভারতের বুকে তৎকালীন বঙ্গদেশের বীরভূমে জন্মেছিলেন আলাউদ্দিন। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম আলি গুরশপ। খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান জালালউদ্দিনের বড়ভাই শিহাবুদ্দিন মাসউদের প্রথম সন্তান তিনি। অর্থাৎ সোজা কথায়, আলাউদ্দিন ছিলেন খিলজি বংশের প্রথম সুলতান জালালুদ্দিন খিলজি’র ভাইয়ের ছেলে।
ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি, কূটনীতি ও সমরকৌশলে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন আলাউদ্দিন। খুব অল্প বয়সেই চাচা জালালুদ্দিন খিলজির বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে জায়গা করে নেন তরুণ আলাউদ্দিন। তার সাহস ও যুদ্ধকৌশলে মুগ্ধ হয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসার পর ভাইপো’কে আমির-ই-তুজুখ বা উদযাপন মন্ত্রী পদে বহাল করেন জালালুদ্দিন।
এরপর ১২৯১ সাল নাগাদ একটি বিদ্রোহ দমন করে সুলতান কর্তৃক ‘আলাউদ্দিন’ উপাধি পান তিনি। শুধু তাই নয়, কানপুরের কাছাকাছি কারা নামক অঞ্চলের শাসনভারও পুরস্কারস্বরূপ তুলে দেওয়া হয় আলাউদ্দিনের হাতে। আলাউদ্দিনের উপর সুলতান এতটাই নির্ভর করতেন, যে নিজের মেয়ে মালিকা-ই-জাহান’এর সঙ্গে তার বিয়ে দিতেও দুবার ভাবেননি।
রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য ভাইবোনের বিয়ে মুসলিম সমাজে নতুন কিছু নয়। তবে যতদূর জানা যায়, এই দাম্পত্যসম্পর্ক একেবারেই সুখের হয়নি জালালুদ্দিন-কন্যার জন্য।
ঐতিহাসিকদের মতে, ছোটোবেলা থেকেই আলাউদ্দিনের নজর ছিল দিল্লির তখৎ ও তাজের উপর। প্রথম প্রথম জালালুদ্দিনের অনুগত থাকলেও ধীরে ধীরে তার আসল চেহারা প্রকাশ পেতে শুরু করে। এই সময় থেকেই চাচা জালালুদ্দিনকে সরিয়ে দিল্লির সিংহাসন দখল করার জন্য গোপনে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন আলাউদ্দিন।
সম্রাট হিসাবে জালালুদ্দিন খুব খারাপ ছিলেন না। আগ্রাসী মনোভাবের বদলে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। শোনা যায়, নিজের শত্রুদেরও না কি রাজপ্রাসাদে ডেকে এনে খোশগল্প করতেন তিনি। রাজস্বের বেশিরভাগ অংশই দান করে দিতেন গরীব-দুঃখীদের মধ্যে।
বিদ্রোহ দমনেও খুব কঠোর আর হিংস্র ভূমিকায় দেখা যেত না তারকে। তার এই নরম স্বভাবের জন্য রাজসভায় অনেকেরই অপছন্দের হয়ে উঠেছিলেন জালালুদ্দিন। থমকে গেছিল খিলজি বংশের সাম্রাজ্য বিস্তারও।
খিলজি বংশের প্রথম সুলতান জালালুদ্দিন। দয়ালু জালালুদ্দিনের বিরুদ্ধে মনে মনে চটেছিলেন সভাসদদের অনেকেই। তারদের সেই বিরূপ মনোভাবের সুযোগ নিয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে গোপনে চক্রান্ত শুরু করেন আলাউদ্দিন। জালালুদ্দিনকে সরিয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসার ফন্দি আঁটতে থাকেন। আর সেই উদ্দেশ্যেই সুলতানের বিরুদ্ধে থাকা সভাসদদের একত্র করে একটি শক্তিশালী বিরোধীপক্ষ তৈরি করেন।
সুলতানের অনুমতি ছাড়াই অভিযান প্রেরণ করে দক্ষিণের দেবগিরি সাম্রাজ্য দখল করে নেন আলাউদ্দিন। এই আচমকা হামলার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র। আলাউদ্দিনের বাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হন তিনি। দেবগিরি লুঠ করে প্রচুর ধনদৌলত নিয়ে আসেন আলাউদ্দিন।
খবর যায় সুলতান জালালুদ্দিনের কাছে। সুলতানের অনুমতির তোয়াক্কা না করে এভাবে একের পর এক আগ্রাসনে ক্রুদ্ধ জালালুদ্দিন জবাবদিহি চেয়ে ডেকে পাঠান জামাতাকে। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন আলাউদ্দিন। সাক্ষাতের নাম করে রাজপ্রাসাদে ঢুকে শ্বশুর জালালুদ্দিনকে খুন করে ১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন আলাউদ্দিন খিলজি। ২১ অক্টোবর রাজ্যাভিষেক হয় তার।
সুলতান হিসাবে অসম্ভব উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন আলাউদ্দিন। গ্রিক বীর আলেকজেন্ডারের মতো বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতেন তিনিও। খিলজি বংশের ছাতার নীচে গোটা ভারতবর্ষকে নিয়ে আসাই তার লক্ষ্য ছিল। তিনি চেয়েছিলেন গ্রিক ইতিহাসের আলেকজেন্ডারের মতো ভারত ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকুক তার নাম।
নিজের পরিচয় দিতেন সিকান্দার-এ-সানি বা দ্বিতীয় আলেকজেন্ডার বলে। সেসময় উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে মোঙ্গলদের আক্রমণ ছিল ভারতবর্ষের অন্যতম ত্রাস। লুঠতরাজ, ধর্ষণ, গণহত্যার নামে তাণ্ডব চালানোই ছিল বর্বর, নৃশংস মোঙ্গলদের বৈশিষ্ট্য। এই অপ্রতিহত মোঙ্গল আক্রমণ রুখে দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন। দিল্লির বুকেই প্রায় তিন লক্ষ মোঙ্গল সেনা খতম করেছিলেন তিনি। এই বিপুল পরাজয়ের পর আর ভারত আক্রমণ করার সাহস করেনি মোঙ্গলরা।
সিংহাসনে বসেই একে একে গুজরাটের রাজা কর্ণদেব, রণথম্বোরের রাজপুত রাজা হামিরদেব, মেবারের নরপতি রতনসিং আর মালবের অধিপতি মহ্লক দেবকে পরাজিত করেন আলাউদ্দিন। এরপর নিজের বিশ্বস্ত সেনাপতি মলিক কাফুরের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতেও অভিযান প্রেরণ করেন।
কাফুর দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র, বরঙ্গলের কাকতীয়রাজ প্রতাপ রুদ্র, দোরসমুদ্রের হোয়্সলরাজ তৃতীয় বল্লালকে পরাজিত করবার পর ভ্রাতৃ-বিরোধের সুযোগ নিয়ে পান্ড্য রাজ্য অধিকার করেন। দক্ষিণে রামেশ্বরম পর্যন্ত প্রসারিত হয় খিলজি সাম্রাজ্য।
রাস্তাঘাট বা গণপরিবহন দুইই খুব অনুন্নত আর বন্ধুর ছিল সেসময়। উত্তরের রাজ্যগুলো থেকে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে যাতায়াতে লেগে যেত সুদীর্ঘ কয়েক মাস। বহু দূর দিল্লিতে বসে দক্ষিণভারত শাসন করা যে প্রায় অসম্ভব, তা ভালোই বুঝেছিলেন আলাউদ্দিন। তাই সরাসরি সাম্রাজ্য স্থাপনের বদলে দক্ষিণের রাজ্যগুলোকে দিল্লির অনুগত করদ রাজ্যে পরিণত করেন তিনি।
ভারতবর্ষের মুসলিম শাসকদের মধ্যে বিজেতা হিসাবে শ্রেষ্ঠ ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজি। দৃঢ়তা ও অসীম সাহসিকতা পূর্ণ যুদ্ধকৌশলের জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন তিনি। তার কূটনীতিজ্ঞানও ছিল প্রশংসা করার মতো। উত্তর ও দক্ষিণভারতে তার আলাদা রাষ্ট্রনীতি যে কাজে লেগেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে এ-ও ঠিক এদেশের বুকে সুলতানি সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসননীতির সূচনা হয়েছিল আলাউদ্দিনের হাত ধরেই। বিজেতা হিসাবে যত সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, প্রশাসক হিসাবে ততটা স্থির বুদ্ধিমত্তার পরিচয় রাখেননি তিনি। তাহলে কি শাসক হিসাবে ব্যর্থ ছিলেন আলাউদ্দিন?
ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সমস্ত প্রজার প্রতি সমান মনোভাব, আদর্শ শাসকের এই চরিত্রবৈশিষ্ট্য আলাউদ্দিনের মধ্যে ছিল না। শাসক হিসাবে এখানেই পিছিয়ে পড়েন আলাউদ্দিন। আকবর মহান হয়েছিলেন তার উদারনৈতিক পরধর্মসহিষ্ণু শাসন কৌশলের জন্য।
ঠিক এর উলটো ছবি পাওয়া যায় আলাউদ্দিনের শাসনকালে। সহিষ্ণুতার লেশমাত্র ছিল না আলাউদ্দিনের চরিত্রে৷ সত্যি কথা বলতে, তার রাজত্বকাল ভারতবর্ষের অমুসলিম প্রজাদের জন্য খুবই অন্ধকার একটা সময়।
আলাউদ্দিনের আগে ভারতে সম্রাটদের স্থায়ী সেনাবাহিনী থাকত না। সেনাশক্তির জন্য সামন্তরাজাদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন সম্রাটেরা। আলাউদ্দিন প্রথম সেই নিয়ম বদলে দেন। সামন্তরাজাদের খুব একটা বিশ্বাস করতেন না আলাউদ্দিন। তাই নিজের তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রের বেতনভোগী এক সশস্ত্র সেনাদল তৈরি করেন তিনি।
সামন্তরাজাদের উপর এই অবিশ্বাসের কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেক ঐতিহাসিকই একটা আশ্চর্য তথ্য তুলে ধরেছেন। আলাউদ্দিন তার শ্বশুর এবং চাচা জালালুদ্দিনকে গদি থেকে সরাতে একদা এইসব সামন্তরাজাদের সাহায্য নিয়েছিলেন। কাজ মিটে যাওয়ার পর দিল্লির সিংহাসনে বসে আশ্চর্য পুরস্কার দেন সেই সহযোগী সামন্তরাজাদের।
অতীত সম্রাটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার অপরাধে একে একে খুন করেন সেই বন্ধুরাজাদের। তিনি জানতেন, যারা জালালুদ্দিনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা যেকোনওদিন অন্য কোনও শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার বিরুদ্ধেও চক্রান্তে লিপ্ত হতে পারে। ক্ষমতার দ্বিতীয় কেন্দ্র যাতে তৈরি না হয় সেদিকে সবসময় সতর্ক দৃষ্টি ছিল আলাউদ্দিনের।
আর তাই সম্রাটের নিজের অধীনে সেনাবাহিনী থাকা প্রয়োজন বুঝেছিলেন তিনি। কিন্তু এই বিপুল সেনাবাহিনীর খরচ আসবে কোথা থেকে? সেনাবাহিনীর খরচ চালাতে গিয়ে সাধারণ প্রজাদের উপর করের মাত্রা বাড়িয়ে দেন সুলতান। এই অতিরিক্ত করের বোঝা সাধারণ মানুষের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছিল।
ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে বিরাট ধ্বস নামে আলাউদ্দিনের রাজত্বকালে। কৃষিকাজ পণ্ড হয়। বিপুল ক্ষতি হয় বাণিজ্যেরও। গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান অঞ্চলের অমুসলিম কৃষকদের অবস্থা হয় সবচেয়ে শোচনীয়। যুদ্ধ-বিগ্রহের খরচ সামলাতে সম্রাটের হুকুম অনুযায়ী জমির উপর ৫০% কর ধার্য করা হয়।
তার পাশাপাশি জিজিয়াসহ নানান ধর্মীয় কর তো ছিলই। এতে সম্রাটের কোষাগার ভরলেও অনাহারে অর্ধাহারে পথে বসে সাধারণ চাষির দল। কর দিতে না পারায় দাসহাটে বিক্রি করা হয় হাজার হাজার নারীপুরুষকে। ইতিহাস বলে, আলাউদ্দিনের শাসনকালের প্রথম ১০ বছরের মধ্যেই তার রাজ্যের প্রায় অর্ধেক প্রজা সর্বস্ব হারিয়ে দাসে পরিণত হয়। এদের বেশিরভাগই ছিল অমুসলিম চাষি বা ভাগচাষির দল।
আলাউদ্দিনের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, হিন্দুদের এমন বিপাকে ফেল, যাতে তাদের কাছে ঘোড়া কেনার পয়সা অব্দি না থাকে। যাতে কোনওভাবেই সুলতানের বিরুদ্ধে কোনও হিন্দু বিদ্রোহ ঘনীভূত না হয়ে ওঠে, সেদিকে কড়া দৃষ্টি রেখেই কি তবে একের পর এক অমানবিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন আলাউদ্দিন?
আপাতদৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক মনে হলেও আলাউদ্দিন খিলজির বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই ছিল কূটনৈতিক অভিসন্ধিতে ভরা। উত্তর আর দক্ষিণের হিন্দু রাজ্যগুলোর প্রতি তার নীতিগত বৈষম্য থেকেও সেটা বোঝা যায়। উত্তরের একাধিক হিন্দু রাজ্য দখল করে ছাড়খার করে দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন।
শুধু চিতোর অভিযানেই ৩০ হাজার হিন্দু হত্যা করেন তিনি। কিন্তু দক্ষিণের দেবগিরি, চাচাটিয়া, হোসলা প্রভৃতি রাজ্যে সে অর্থে কোনও তাণ্ডব চালানো হয়নি। সুলতান তাদের পরাজিত করে বন্ধুভাবাপন্ন করদ রাজ্যে পরিণত করেছেন মাত্র। এই কূটনৈতিক ভিন্নতা লক্ষ্য করার মতো।
আলাউদ্দিন কি শুধু হিন্দুদের উপরেই অত্যাচার করতেন? না। আলাউদ্দিনের শাসনকাল ভারতবর্ষের ধনী মুসলিমদের জন্যও দুঃস্বপ্নের অধ্যায়। তাদের সমস্ত ক্ষমতায় রাশ টেনেছিলেন সুলতান। শুধু তাই নয়, বাজারে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে জিনিসপত্রের দাম স্থির করে দেন তিনি। মদ, জুয়া নিষিদ্ধ করেন।
উঁচুপদের সরকারী কর্মচারীদের উপর নজর রাখার জন্য গুপ্তচরও নিয়োগ করেন। কালোবাজারিদের জন্য অপেক্ষা করে থাকত ভয়ংকর শাস্তি। ওজনে গণ্ডগোল করে সাধারণ ক্রেতাকে ঠকালে নির্মম শাস্তি দেওয়া হত অসাধু ব্যবসায়ীদের। যতটা ওজন মারা হয়েছে, ঠিক ততটা ওজনের মাংস কেটে নেওয়া হত সেই ব্যবসায়ীর শরীর থেকে।
আলাউদ্দিন যে অত্যন্ত নিষ্ঠুর চরিত্রের সম্রাট ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেই যুগে যখন সুলতানের বিরুদ্ধে গোপনে একের পর এক খুনের চেষ্টা, ষড়যন্ত্র হত, তখন নিষ্ঠুরতা ছাড়া মসনদে টিকে থাকা অসম্ভব। শোনা যায়, নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে না কি এক দিনে দিল্লিতে বসবাসকারী ৩০ হাজার মোঙ্গলকে হত্যা করেছিলেন আলাউদ্দিন।
মনে রাখতে হবে, এই মোঙ্গলেরা কিন্তু সকলেই ছিলেন মুসলিম ধর্মাবলম্বী। শ্বশুর জালালুদ্দিনকে হত্যা করার পর তার মুণ্ডু কেটে শালাকে উপহার পাঠিয়েছিলেন আলাউদ্দিন। মৃত জালালুদ্দিনের চোখ উপড়ে পাঠিয়েছিলেন তার বিধবা স্ত্রী মানে নিজের শাশুড়ির কাছে।
যেখানে নিজের কাছের আত্মীয়স্বজনদেরই নৃশংসভাবে খুন করতে হাত কাঁপেনি তার, সেখানে সাধারণ প্রজাদের প্রতি তিনি মমত্ব দেখাবেন, এ কথা বিশ্বাস করাও মুশকিল। কিন্তু কথায় বলে, পাপের শাস্তি না কি একজীবনেই জোটে। এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুলতানের শেষজীবনটা দেখলে সেই কথাই যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
জীবনের শেষের দিকটা যারপরনাই কষ্টের কেটেছে আলাউদ্দিনের। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিকভাবে অসুস্থ আর দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। নানা আদিব্যাধি তো ছিলই, পাশাপাশি অসুখে-অসুখে মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে যায়। রাজকর্মচারীদের সারাক্ষণ সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেন। কাউকেই প্রায় বিশ্বাস করতে পারতেন না।
কেবলমাত্র একজন মানুষকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতেন আলাউদ্দিন। সে আর কেউ নয়, আলাউদ্দিনের এতকালের সহচর সেনাপতি মালিক কাফুর। রাজপরিবারের অন্দরে সেসময় আলাউদ্দিনের অজান্তে এক নির্মম ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তোলা হচ্ছিল, যার মধ্যমণি ছিলেন এই মালিক কাফুর৷ সুলতান ততদিনে কাফুরের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছেন।
আলাউদ্দিনের অন্ধ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে নিজের পথের সমস্ত কাঁটা সরিয়ে দিয়েছেন কাফুর। তার অপছন্দের রাজকর্মচারীদের অপসারিত অথবা হত্যা করা হয়েছে। এরপর ১৩১৬ সালের জানুয়ারি মাসের এক অন্ধকার রাত্রে নিজের বিশ্বস্ত ও প্রিয় সহচর মালিক কাফুরের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন ইতিহাসের অন্যতম স্পর্ধিত বীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি।
তবে এই কাফুরকে নিয়েই ইতিহাসবিদদের মধ্যে আছে বিতর্ক। মালিক কাফুর ছিলেন দিল্লি সুলতানির অন্যতম প্রধান শাসক আলাউদ্দিন খিলজির একজন দাস সেনাপতি। একটি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণকারী মালিক কাফুর ছিলেন অসাধারণ দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী। অথচ তাকে একজন নপুংসক ক্রীতদাস হিসাবে বিবেচনা করা হতো। মালিকের চোখে অদ্ভুত জাদু ছিল। শোনা যায়, ওই চোখ দিয়েই যে কোনও মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলতে পারতেন তিনি।
ক্রীতদাস হিসাবেই জন্ম হয়েছিল মালিক কাফুরের। যৌবনে খাম্বাটের এক ধনী খাজার দাস হিসাবে জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। মনে করা হয় যে, মালিক কাফুরের সৌন্দর্য দেখে তার প্রভু তাকে হাজার দিনারে কিনেছিলেন। সেই জন্য মালিককে উপাধি দেওয়া হয়েছিল ‘হাজার-দিনারী’ বলে। ইতিহাস তাকে সদা সর্বদা মনে রেখেছে ‘হাজার-দিনারী’ নামে।
১২৯৯ সালে গুজরাট আক্রমণের সময় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি নুসরত খান বন্দর শহর খাম্বাট থেকে কাফুরকে বন্দি করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে দিল্লিতে সুলতানের কাছে উপস্থাপিত করেন। তারপর থেকে মালিক হয়ে ওঠেন সুলতানের দাস।
এরপর শুরু হয়েছিল মালিক কাফুরের সামরিক জীবন। ১৩০৬ সালে আলাউদ্দিন চাঘতাই খানাতে থেকে মঙ্গোল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাকে পাঞ্জাব পাঠান। সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে সফল হয়েছিলেন মালিক। এই সময়কালে তাই তিনি পরিচিতি পান নায়েব-ই বারবাক উপাধিতে। এইভাবে ধীরে ধীরে একাধিক সামরিক বিজয় হাসিল করেছিলেন কাফুর।
অন্যান্য সভাসদদের তুলনায় আলাউদ্দিনের কাফুরের উপর বেশি আস্থা ছিল কারণ অন্যান্যদের মতো কাফুরের কোনও পরিবার বা অনুসারী ছিল না। ইসামির মতে, আলাউদ্দিনের রাজত্বের শেষ দিনগুলিতে, কাফুর কাউকে সুলতানকে দেখতে পর্যন্ত দেননি। সুলতান হয়ে পড়েছিলেন মালিকের হাতের পুতুল।
এবার আসা যাক অন্য একটি প্রসঙ্গে। আলাউদ্দিন খিলজির সঙ্গে মালিক কাফুরের সম্পর্ক কি শুধুই সুলতান আর সামরিক আধিকারিকের ছিল? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। আলাউদ্দিন অসুস্থ হওয়ার আগেই কাফুরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাকে অন্যান্য বন্ধু এবং সাহায্যকারীদের থেকে পৃথক চোখে দেখতেন সুলতান স্বয়ং।
ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানির বর্ণনার উপর ভিত্তি করে, পণ্ডিত রুথ ভানিতা এবং সেলিম কিদওয়াই বিশ্বাস করেন যে আলাউদ্দিন এবং কাফুরের মধ্যে সমকামী যৌন সম্পর্ক ছিল। অন্যান্য ঐতিহাসিক এবং পণ্ডিতদেরও একই বিশ্বাস।
এসডব্লিউ এসএস /১১২০
আপনার মতামত জানানঃ