জন ফ্রান্সোঁয়া গিসিম্বা ১৯৯৪ সালের ৬ই এপ্রিল বিকেলে রেডিওতে কাজ শেষে বাড়ি যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। তার অন্য সহকর্মীরা তখন অফিসে বসে আফ্রিকান কাপ ফুটবলের খেলা দেখছিল। তখনই বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠে রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালি। গিসিম্বা বলেন, তখন কিছু একটা বিস্ফোরণ ঘটলো। কিগালি ছোট শহর। আমরা সবাই বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম।
যে বিস্ফোরণের কথা বলছিলেন গিসিম্বা তা ছিল রুয়ান্ডার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানাকে বহনকারী বিমান ভূপাতিত করার শব্দ। তিনি ছিলেন সংখ্যাগুরু হুতু সম্প্রদায়ের। এর পরপরই রুয়ান্ডা জুড়ে শুরু হয় ব্যাপক সহিংসতা ও হত্যাযজ্ঞ। সংখ্যাগুরু হুতু সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের উপর।
মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে প্রায় আট লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিল সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের। গণহত্যার প্রভাবে রুয়ান্ডায় যেসব পরিবর্তন এসেছিল তার অন্যতম একটি হলো দেশটিতে ইসলাম ধর্মের উত্থান।
মনে করা হয়, তখন মুসলিমরা যে ভূমিকা রেখেছিল তা সেখানকার সাধারণ জনগণের মনে প্রভাব ফেলেছিল। ফলে আস্তে আস্তে ওই দেশে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটেছে।
সহিংসতার সময় বহু মানুষকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানেই হত্যা করা হয়েছে। হুতুদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য তুতসিরা দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। আমজা মুতোবোরিকা ছিলেন টুটসি সম্প্রদায়ের। তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর। তার বাবা-মা, দাদী, বোন সকলকে হত্যা করা হয়।
হত্যাযজ্ঞ শুরু হবার পর আমজা পালিয়ে আশ্রয় নেন তার সৎ মায়ের বাড়িতে, যিনি ছিলেন একজন মুসলিম। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় তিন মাস ওই বাড়ির মধ্যেই ছিলেন আমজা। সেসময় আমজা জানতেন না তার পরিবারের সবাই মারা গেছেন।
সংখ্যাগুরু হুতু সম্প্রদায়ের নারী ছিলেন আমজার সৎ মা। ওই বাড়িতে আরও অনেকে আশ্রয় নিয়েছিলেন যাদের মধ্যে অনেক শিশু ছিল। প্রতিবেশী বাড়িগুলোতেও আশ্রয় নিয়েছিল তুতসি সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ।
আমজা বলেন, “আমার সৎ মায়ের বাড়িতে অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। সবাইকে খাবার দেওয়ার জন্য উপায় খুঁজে নিয়েছিলেন তিনি, যেন কেউ তাকে সন্দেহ না করে। যেন কেউ না বুঝে বাড়িতে মানুষজন লুকিয়ে আছে। যাদের টার্গেট করা হয়েছিল তিনি তাদের মধ্যে ছিলেন না। আমার সৎ মায়ের জাতিগত পরিচয়ের জন্য তাকে টার্গেট করা হয়নি।”
মুসলিম স্কলার ও লেখক সুরিমোয়ান হোয়ারি বলেন, মুসলিমরা রুয়ান্ডায় প্রথম আসে জার্মান উপনিবেশের সেবক হিসেবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বেলজিয়াম এ অঞ্চল দখল করে নেয়ার পর মুসলিমরা সংখ্যায় কম হলেও তারা সংগঠিত হয়ে ব্যবসায়িক ও সামাজিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল সুন্দরভাবে।
গণহত্যায় মুসলিমরা যেন কোনভাবে জড়িত না হয় তা নিয়ে যে সতর্কবার্তা দিয়েছিল মুসলিম ধর্মীয় নেতারা। তিনি বলেন, প্রতিটি মুসলিম পরিবারে তুতসিদের কেউ না কেউ আশ্রয় নিয়েছিল প্রাণে বাঁচার জন্য।
“গণহত্যার প্রথম দিন একটি ফতোয়া জারি করা হয় মানুষকে সতর্ক করার জন্য, হত্যাযজ্ঞে কোনওভাবে অংশ নেয়া যাবে না। মুসলিমরা মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে।”
সুরিমোয়ান হোয়ারি বলেন, রুয়ান্ডার সরকার তুতসিদের ওপর নিপীড়ন শুরু করেছিল এবং হুতু চরমপন্থীরা তুতসিদের হত্যা করে প্রথম ১৯৯২ সালে। তখন মুসলিম নেতারা একটি চিঠিতে প্রথম সতর্ক করে দেয় যে এ ধরনের কোনও কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়া যাবে না।”
গণহত্যার দুই বছর আগেই মুসলিম নেতারা এই সতর্কবার্তা দিলেও সবাই যে সেটা মেনে চলেছে তা বলা যাবে না। হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল কিছু মুসলিমও, যাদের পরে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
“এটা ভিন্ন একটা ঘটনাপ্রবাহ ছিল খ্রিস্টানদের জন্য। যেখানে চার্চ ও চার্চের যাজকরা হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল। চার্চে আশ্রয় নিতে আসা মানুষদের হত্যা করেছিল। কিন্তু মুসলিম কমিউনিটিতে এমনটা ঘটেনি। তারা হত্যাযজ্ঞকে নিষিদ্ধ করেছে। মুসলিমরা মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, বাঁচিয়েছে।”
রুয়ান্ডায় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সহিংস আচরণ ও গণহত্যার যে ইতিহাস মানুষ দেখেছে তাতে মুসলিমদের প্রশংসাই ঘুরে ফিরে এসেছে। ওই হত্যাযজ্ঞে মুসলিমরা অংশ নেয়নি, তাদের মানবিক ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ রুয়ান্ডার সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ফলে তারা এই ধর্মের প্রতি আগ্রহী হয়েছে।
রাজধানী কিগালির আয়মাতি আল কুদস মসজিদের প্রধান মুফতি শেখ সেলিম হিতিমানা জানান, বিভিন্ন গ্রামে দলে দলে লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। রুয়ান্ডার মুসলিম কমিউনিটির তথ্যানুসারে দেশটির জনসংখ্যার ১২ থেকে ১৫ শতাংশ মুসলিম যাদের অধিকাংশই সুন্নী। খুব অল্প সংখ্যক (২০০-৩০০) মানুষ শিয়া মতাবলম্বী।
১৯৯৪ সালের আগে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ২ লাখ আর ২৫ বছর পর সেই সংখ্যা ৭ লাখে দাঁড়ায় বলে জানান শেখ সেলিম। যখন সরকার হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা করছিল তখন তারা ধর্মীয় নেতাদেরও ডাকে এতে সমর্থন দেয়ার জন্য। কিন্তু সেসময় আমাদের মুফতিরা না করে দেয় যে তারা এমন পরিকল্পনায় অংশ নেবে না। তখন মানুষ ভাবলো ইসলাম এটা কেমন ধর্ম?
মুফতি শেখ সেলিম হিতিমানা জানান, “গণহত্যার পরে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল তারা তখন এক বিবৃতিতে বলেছিল মুসলিমরা এই হত্যাযজ্ঞে জড়িত ছিল না। এছাড়া ১৯৯৪ সালের পর আমরা আমাদের ধর্ম চর্চা করার স্বাধীনতা পাই। গ্রামগুলোতে ইসলাম শিক্ষা পড়ানো ও শেখানোর বিষয়েও কোনও বাধা ছিল না। রুয়ান্ডায় মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ার পেছনে এটাও একটা কারণ।”
রাজধানীর কিগালিতে অবস্থিত আল মদিনা মসজিদটি অনেক পুরাতন একটি মসজিদ। এর সেক্রেটারি ইব্রাহিম লুইমানা জানান “অনেকে এই মসজিদে আসেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য। তারা বলে যে তারা অনেকদিন ধরে ভেবেছে এবং তারা মনে করে ইসলাম ভালো ধর্ম। সে কারণে তারা এই ধর্ম গ্রহণ করতে এসেছে।”
কয়েকটি এলাকায় ঘুরে বিবিসি সাংবাদিক দেখেছেন বক্তারা ইসলামিক নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, এই ধর্ম কতটা ভালো সেই বিষয়ে তারা প্রচার করছেন।
রুহুঙ্গা নামের একটি গ্রামের ইমাম বারাহিরো উমর, যিনি ক্যাথলিক হয়ে জন্মালেও কিশোর বয়সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন গণহত্যার ঘটনার পর এবং উমর আবু সালেম ও তার পরিবারকে উৎসাহিত করেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য।
উমর বলছিলেন “১৫ বছর বয়সে আমি দেখেছি গণহত্যা চলার সময় রুয়ান্ডার মুসলিমরা কেমন ব্যবহার করেছে। কীভাবে মানুষকে তারা সাহায্য করেছে, বাঁচিয়েছে। আমার পরিবারের দুই ভাই মুসলমান হয়েছে। তবে বোন এখনও হয়নি।”
উমর ও আবু সালেম দুজনেই চল্লিশের কোঠা পার করেছেন এবং ইসলাম ধর্মের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করতে তারা দুজনেই সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৯৪ সালের গণহত্যার ঘটনা তাদের মনে এতটাই দাগ কেটেছে যে তারা পুরোপুরিভাবে এই ধর্মের প্রসারে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন।
প্রায় ১০০ দিন ধরে চলা ঐ হত্যাকাণ্ডে মানুষজনকে বাড়িতে, উপাসনালয়ে ঢুকে হত্যা করা হয়েছে। স্কুলে ঢুকে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। আশ্রয়ের জন্য চার্চে ছুটে যাওয়া মানুষদের রক্ষা করা যায়নি। চার্চের যাজক এবং নানদের বিরুদ্ধেও হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে।
গণহত্যার ২৫ বছর পর রুয়ান্ডার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখেন বিবিসির সাংবাদিক অড্রে ব্রাউন। তিনি কয়েকজন রুয়ান্ডার নাগরিকের সাথে কথা বলেছেন। উনিশ চুরানব্বই সালের ঘটনাবলী তাদের মনে এতটাই ছাপ ফেলেছিল যে তারা পরবর্তীতে খ্রিস্টান ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
তাদের একজন আবু সালেম, যিনি গণহত্যার ৫ বছর পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। রুয়ান্ডায় গণহত্যা চলাকালে ১৫ বছর বয়সে মি. সালেম দেখেছেন খ্রিস্টান চার্চগুলো মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে কীভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেছেন “চার্চগুলোতে যেভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখেছি, মসজিদে কোনও হত্যার ঘটনা দেখিনি আমি। গণহত্যার সময় দেখেছি একজন মানুষ কীভাবে আরেকজন মানুষকে হত্যা করেছে। চার্চে যারা নিরাপত্তার আশায় আশ্রয় নিচ্ছিল তাদের হত্যা করা হয়েছে চার্চগুলোতে।”
ক্যাথলিক চার্চগুলোতে এসব ঘটনা দেখেছেন বলে উল্লেখ করেন আবু সালেম।
এসডব্লিউএসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ