সত্যকথা শুধু অপ্রিয়ই হয় না, আত্মঘাতীও হয়। হাড়ে হাড়ে বুঝছেন রাহুল গান্ধী। ভারতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামো যত বেশি করে একদলীয় শাসনের দিকে এগোচ্ছে, তত বেশি করে স্বৈরাচারী দাঁতনখ বেরিয়ে পড়ছে।
আসলে আদানি কেলেঙ্কারির পরে সংসদের বাজেট অধিবেশনে রাহুল যেভাবে মোদীকে বিঁধেছিলেন, তার এক তৃতীয়াংশ লোকসভার রেকর্ড থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ ওম বিড়লা দিলেও রাহুলকে বাঁধতে পারা যাচ্ছে না। মোদীকে বার বার জবাবদিহির জন্য জিগির দিচ্ছেন। সংসদের ভিতরে ও বাইরে, দেশের ভিতরে ও বাইরে ভারতের কণ্ঠের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
আর এখানেই ঘোর আপত্তি মোদী-শাহদের। সফল ভারত জোড়ো যাত্রায় যে মাইলেজ পেয়েছেন রাহুল, তাতে তাঁকে আর ‘পাপ্পু’ বলা যাচ্ছে না, আদানি ইস্যুতে বেইজ্জত হওয়া ভারত সরকারকে রাহুল যেভাবে বিঁধছেন, আর বিরোধীদের জড়ো করছেন, তাতে তাঁর ডানা ছাঁটাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল দেশের শাসকদলের কাছে। ২০২৪-এ ভোটের আগে রাহুল যাতে বিরোধীদের মুখ না হয়ে উঠতে পারে, তাই বড্ড তাড়া পড়ে গিয়েছিল মোদির।
গুজরাতের এক আদালতে ফৌজদারী মানহানির মামলায় দুই বছরের জেলের সাজা হওয়ার পরে আইন অনুযায়ীই রাহুল গান্ধীর পার্লামেন্ট সদস্য পদ খারিজ হয়ে গেছে।
চার বছর আগে নির্বাচনী প্রচারে কর্ণাটকে গিয়ে রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, “নিরাভ মোদী, ললিত মোদী, নরেন্দ্র মোদী .. মোদী পদবীধারীরা সবাই কী করে চোর হয়!”
ওই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাটের বাসিন্দা মোদী পদবীধারী এক বিজেপি নেতা এই যুক্তিতে মানহানির মামলা করেন যে গান্ধী একথা বলে সব মোদী পদবীধারীর মর্যাদাহানি করেছেন।
এই মানহানির মামলায় বিরোধীদল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীর কারাদণ্ড আর লোকসভার সদস্যপদ হারানোর ঘটনা অনেকটা হঠাৎ করেই দেশটির রাজনীতিতে সৃষ্টি করেছে এক বিরাট আলোড়ন। এর প্রতিবাদে শনিবার ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কংগ্রেস কর্মীরা বিক্ষোভ করেছেন, পাঞ্জাবে হয়েছে রেল অবরোধ।
দেশের ১৪টি বিরোধী দল; যাদের মধ্যে অন্য প্রশ্নে খুব একটা সহমত হতে দেখা যায় না, তারাও রাহুল গান্ধীর প্রতি সহমর্মিতা জানাতে এক হয়েছে। এছাড়া এমপির পদ খোয়ানোর পরে শনিবারই প্রথম সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হন রাহুল গান্ধী, আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে বিজেপি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, লোকসভা ভোটের যখন বছরখানেক বাকি, তখন এ ঘটনার ভেতর দিয়ে রাহুল গান্ধীই মূল রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তাতে কোন দলের লাভ, কার ক্ষতি হতে পারে?
‘মোদী-আদানির সম্পর্ক’
শুক্রবার ওই গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশিত হওয়ার পরে রাহুল গান্ধী শনিবারই প্রথমবার সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হন। রাহুল গান্ধী বলেন, “আমার সদস্য পদ খারিজ হয়েছে কারণ আমার পরের ভাষণকে প্রধানমন্ত্রী ভয় পাচ্ছেন। ওই ভাষণটা আমি আদানির ব্যাপারে দিতাম। আমি তার চোখে আতঙ্কের ছাপ দেখেছি। তিনি কিছুতেই চাননি যেন ভাষণটা সংসদের কক্ষে দিতে পারি।“
নরেন্দ্র মোদী ও আদানি গোষ্ঠীর সম্পর্ক নিয়ে তিনি যে তথ্যবহুল ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটা সংসদের কার্যবিবরণী থেকে কেন বাদ দেয়া হলো, সেই প্রশ্ন বারবার জানতে চেয়েও তিনি জবাব পাননি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন গান্ধী।
মোদী ও আদানির মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে রাহুল গান্ধীকে শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে একাধিকবার মুখ খুলতে শোনা গেছে। তিনি বলেন, “আদানি গোষ্ঠীর সংস্থাগুলির কাছে যে ২০ হাজার কোটি টাকা এসেছিল, কেউ জানে না এই অর্থের উৎস কী! প্রধানমন্ত্রী ভয় পাচ্ছেন যে মোদী-আদানি সম্পর্কটা মানুষের সামনে ফাঁস হয়ে যেতে পারে। সেজন্যই আমাকে আটকানো হচ্ছে। কিন্তু আমি থামব না। মোদী-আদানি সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন আমি তুলবই।“
বিশ্লেষকরা বলছেন, এতদিন রাহুল গান্ধী-সোনিয়া গান্ধীকেই নিশানা করে রাজনীতি করে এসেছে বিজেপি। এবার যদি রাহুল গান্ধী নাই থাকেন, তাহলে কী নিয়ে রাজনীতি করবে বিজেপি?
‘লোকসত্তা’ পত্রিকার সম্পাদক গিরীশ কুবেরের কথায়, “এটা কংগ্রেসের কাছে একটা বড় সুযোগ নতুন কোনো চেহারা সামনে নিয়ে আসার। গান্ধী সবসময়েই বিজেপির ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’ হয়ে থেকেছেন। এখন তিনিই যদি না থাকেন, তাহলে বিজেপির তো নিশানা করারই কেউ থাকবে না। তাই কংগ্রেসকে খুব ভেবে চিন্তে এগোতে হবে।“
আবার রাহুল গান্ধীর সংসদ সদস্য পদ খারিজের প্রশ্নে বিজেপি বিরোধী সব দলগুলিই একজোট হয়ে প্রতিবাদ করছে। বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলছেন, রাহুল গান্ধীকে নিশানা করা বিজেপির তো একটা অ্যাজেন্ডা বটেই। তাই বিজেপি-আরএসএসের মধ্যে দুটো মতই আছে।
একটা অংশ চাইছে রাহুল গান্ধীই থাকুন তাদের প্রধান নিশানা হয়ে। আরেকটা মত বলছে রাহুল গান্ধী সামনে থাকলেই বারেবারে আদানি ইস্যুটা তুলবেন, আর তাতে নরেন্দ্র মোদীর ইমেজের বড়সড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
কংগ্রেস এবং বিরোধী দলগুলো যেমন একদিকে রাহুল গান্ধীকে ‘পরিস্থিতির শিকার’ বা তার সংসদ সদস্য পদ খারিজকে ‘গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ’ ধরনের শব্দ বন্ধে অভিহিত করছে, অন্যদিকে বিজেপি যে কোনোভাবে আদানি গোষ্ঠীর সাথে নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্ককে সামনে আসতে দিতে চায় না।
কংগ্রেসের রাজনৈতিক কৌশল
রাহুল গান্ধীর সংবাদ সম্মেলনের জবাব দিতে বিজেপি নেতা রভি শঙ্কর প্রসাদ একটি জবাবী সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশের ওপরে স্থগিতাদেশ নেয়ার কোনো চেষ্টাই কেন করল না কংগ্রেস?
কংগ্রেস কেন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করল না, তাহলে কি সত্যিই এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা কাজ করছে, এই প্রশ্ন উঠছে বিশ্লেষকদের মনেও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলছিলেন, “বৃহস্পতিবার রায় দিয়েছে আদালত, তারপরে শুক্রবার আজ শনিবার চলে গেল। এই কয়দিনে কংগ্রেস তো উচ্চতর আদালতে যেতেই পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। নিঃসন্দেহে এর পেছনে একটা রাজনৈতিক কৌশল কাজ করছে।”
“উচ্চতর আদালতে না যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে রাহুল গান্ধীকে একজন শহীদ বা পরিস্থিতির শিকার হওয়া এক ব্যক্তির মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেটা তাদের পক্ষে লাভজনক তো হবেই। তাদের আইনি পরামর্শদাতারাও কিন্তু এখনো এটা স্পষ্ট করেননি।”
সবমিলিয়ে লোকসভা নির্বাচনের একবছর আগে এবং কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনের বছরেই ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন রাহুল গান্ধীই। রাহুল গান্ধীর সংসদ সদস্য পদ খারিজ হয়ে যাওয়ায় শনিবার সারা দেশেই কংগ্রেস কর্মীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।
তিনি যে আসন থেকে সংসদ সদস্য ছিলেন, কেরালার সেই ওয়েনাডে কংগ্রেস কর্মীদের বিক্ষোভ যেমন হয়েছে, তেমনই কর্ণাটকেও বিক্ষোভ দেখিয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা। রাজ্যের রাধানী বেঙ্গালুরুতে ওই বিক্ষোভ আটকিয়ে দেয় পুলিশ। আবার পাঞ্জাবে রেল অবরোধ করেন কংগ্রেস কর্মীরা। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসসহ বিরোধী জোটের বিধায়করা মুখে কালো কাপড় বেঁধে বিধানসভা চত্ত্বরেই বিক্ষোভ দেখান।
এসডব্লিউএসএস/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ