বাংলাদেশে পুলিশের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পর চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে যে গতিতে গ্রেফতার ও কারাগারে পাঠানো হয়েছে সেই একই ভাবে তার করা অভিযোগ কেন গুরুত্ব পাচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে পুলিশের মধ্যম পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের তদন্ত হয় না বরং কেউ অভিযোগ করলে উল্টো তিনিই হয়রানির শিকার হন।
“কিছু কর্মকর্তার এ ধরণের ক্ষমতা দেখানোটা পুরো বাহিনীকেই মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। তারা বিষয়টিকে পুলিশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ খুব একটা আমলে নেয়া হয় না।”
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান শনিবারই বলেছেন, মাহিয়া মাহির অভিযোগও তদন্ত করে যাচাই করা হবে। এদিকে, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও পুলিশের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান অবশ্য বলছেন যে অভিযোগ আসলেই হবে না কারণ অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিষয়ে ঢালাও অভিযোগ আসে।
পাশাপাশি তিনি বলেন, “তবে সরেজমিন কাজ করার ক্ষেত্রে পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে করে এ ধরণের অভিযোগ না আসে। আর আসলেও সেটি তারা যাচাই করে দেখতে পারে সত্যতা আছে কিনা।”
শনিবার সকালে আটকের পর রাতে জামিনে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মাহিয়া মাহি স্পষ্ট করে বলেছেন, তার অভিযোগ গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে, পুরো পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়।
তিনি ঘুষ নেয়ার অভিযোগ করেছিলেন সেটি তদন্ত করার আহবান জানিয়ে বলেন, “আমি যে কথাটা বলেছি, দেড় কোটি টাকার কথাটা বলেছি, সেটা নিয়ে তদন্ত হোক।”
তবে পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আগেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘’তিনি (মাহিয়া মাহি) আমার বিরুদ্ধে, আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করে তিনি ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন।”
আমার বিরুদ্ধে, আমার পরিবারের বিরুদ্ধে, আমার বাহিনীর বিরুদ্ধে, আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তারা যেসব মিথ্যাচার করেছেন, সেজন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করা হয়েছে।‘’
শুক্রবার রাতেই গাজীপুরের বাসন থানার পুলিশের একজন কর্মকর্তা মাহিয়া মাহি ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে। এছাড়া মারধর, ভাংচুর, চাঁদাবাজি ও জমি দখলের অভিযোগে মাহিয়া মাহি ও তার স্বামীসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন ইসমাইল হোসেন নামের একজন ব্যবসায়ী।
এসব মামলায় শুক্রবার রাতেই নয়জনকে আটক করে গাজীপুর পুলিশ। আর শনিবার সকালে মাহিয়া মাহি দেশে ফিরলে বিমানবন্দর থেকেই তাকে আটক করে গাজীপুরে নিয়ে যায় পুলিশ।
দুপুরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠালেও বিকেলে আবার তিনি জামিন পান ও রাতেই জেল থেকে ছাড়া পান মাহিয়া মাহি।
অভিযোগ করলেই আটক করা যায়?
প্রশ্ন উঠছে যে পুলিশের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলেই অভিযোগকারীকে আটক করা যায়? সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, গ্রেফতারের আইনগত এখতিয়ার পুলিশের আছে।
তিনি জানান, “এখানে মামলার বাদী পুলিশ নিজেই। আর ঘুষের অভিযোগের কারণে মামলাটি হলে জনমনে প্রতীয়মান হতে পারে যে এ ধরণের অভিযোগ করাই যাবে না। তাই পুলিশেরই উচিত অভিযোগটি তদন্ত করে দেখা।”
তবে মাহিয়া মাহির ক্ষেত্রে তিনি সন্তান-সম্ভবা এবং তার সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় থানা থেকে জামিন দেয়ার সুযোগ ছিলো বলে মনে করেন তিনি। নূর খান লিটন বলছেন, এই ঘটনায় যার বিরুদ্ধে অভিযোগটি এসেছে তিনিই তার বাহিনী দিয়ে অভিযোগকারীকে গ্রেফতার করলেন।
“পুলিশ দ্রুততম সময়ে অ্যাকশন নিয়েছে এবং এখানেও যার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তিনি ঢাল হিসেবে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তিকে সামনে এনেছেন।”
মোখলেসুর রহমান বলছেন, এ ধরণের অভিযোগ যেন না আসতে পারে তেমন সতর্ক হয়েই পুলিশের কাজ করা উচিত।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে আসে কতটা?
বাংলাদেশে অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কথিত ক্রসফায়ার, হেফাজতে নির্যাতন-মৃত্যু, চাঁদাবাজি, ঘুষ বাণিজ্য ও ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি এবং ছিনতাইসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ শোনা গেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।
এমনকি পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকা থেকে একজন ব্যবসায়ীকে তুলে নেয়ার অভিযোগও গণমাধ্যমে বেশ আলোড়ন তুলেছিলো কয়েক বছর আগে। টেকনাফে সাবেক সেনা কর্মকর্তা রাশেদ সিনহা হত্যাসহ কিছু ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিচারও হয়েছে।
নূর খান লিটন বলছেন, পুলিশের অনেকে শাস্তি পাচ্ছেন আবার কিছু কর্মকর্তার ক্ষমতা দেখানোর বিষয়টিও প্রতিনিয়ত ঘটছে যদিও তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগই উঠে আসে গণমাধ্যমে।
বিশ্লেষকেরা সবসময়ই দাবি করে থাকেন যে ভয়ের কারণ বহু বছর ধরেই পুলিশ সমাজে ক্ষমতার চর্চা করে আসছে। সে কারণেই পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার ঘটনা একটা সময় পর্যন্ত বিরল ছিল।
তবে এখন অনেক ক্ষেত্রেই মামলা হয়। যদিও মামলা হলেও এই মুহূর্তে পুলিশের বিরুদ্ধে সারাদেশে কতগুলো ফৌজদারি মামলা চলছে তার কোন তথ্য পাওয়া যায় না। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে কতগুলো অভিযোগ অভ্যন্তরীণ বিচার প্রক্রিয়ায় রয়েছে সে বিষয়েও তথ্য পাওয়া যায়না পুলিশে বিভাগের পক্ষ থেকে।
দু’হাজার সতের সাল পর্যন্ত বাহিনীর মধ্যে কত সংখ্যক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কী ধরণের অভিযোগ এবং কী বিচার প্রক্রিয়াধীন ছিল, তার বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করা হত।
দু’হাজার সতের সালে সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা গিয়েছিল বাহিনীর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজারের মত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যূতিসহ নানা ধরণের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ