এ যেন এক অবিশ্বাস্য হাওয়া বদল! গত ১০ মার্চ চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরব তাদের দীর্ঘ বৈরী সম্পর্ক বান্ধুত্বে পরিণত করতে সম্মত হয়েছে সবাইকে অবাক করে দিয়ে। চীনও দেখিয়ে দিয়েছে তারা চাইলে বিশ্বমঞ্চে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে।
পশ্চিম এশিয়া ছিল ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ঘোষিত ‘কোহিনুর’। কিন্তু সম্প্রতি প্রায় সবার অলক্ষে সেই রত্ন আপাতত হলেও বেইজিং-এর হাতে গেল।
শি জিনপিং তৃতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার দু’সপ্তাহের মধ্যে ইরান এবং সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের সংঘাত চীন মেটানোর পরে এমনই মনে করছেন ভারতের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মঞ্চে চীন কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে সে প্রশ্নটা সবসময় ছিল এবং আছে। আছে নানান রকম বক্তব্য। কিন্তু সৌদি-ইরানের বৈরিতা দূর করতে চীন এমন একটা গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছে, যা নজর কেড়ে নিয়েছে সারা বিশ্বের। এই আশাতীত কাজটা হয়েছে এমন এক সময়, যখন সারা বিশ্ব একটা উত্তেজনাপূর্ণ সময় পার করছে।
একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অন্যদিকে বড় দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান শক্তি-প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। সবমিলিয়ে ভীষণ উত্তেজনা চারদিকে। এরমধ্যে এই মৈত্রীচুক্তি নিঃসন্দেহে একটা বড় সুসংবাদ!
প্রসঙ্গত, চীনের গত আনুষ্ঠানিক আইনসভার বার্ষিক সভা শেষে এক বক্তব্যে শি জিনপিং বলেছেন, চীনের উচিত ‘বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার সংস্কার ও নির্মাণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ’ এবং ‘বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ’ প্রচার করা।’
তিনি বলেছেন, এটি ‘বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নে ইতিবাচক শক্তি যোগ করবে এবং আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য একটি অনুকূল আন্তর্জাতিক পরিবেশ তৈরি করবে।’
সাত বছর আগে শিয়া আলেম নিমর-আল-নিমরকে ফাঁসি দেয় সুন্নি প্রধান সৌদি আরব। এই ঘটনার প্রতিবাদে তেহরানে সৌদি কূটনৈতিক প্রতিনিধিদলের উপর হামলা চালান ইরানের বিক্ষোভকারীরা।
এরপর ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব। দুই দেশের তিক্ততা তীব্র হয়। সম্প্রতি বিবদমান এই দুই দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠক করায় বেইজিং, তাদের মাটিতে। এরপর আবার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজি হয়েছে শিয়া ও সুন্নি প্রধান দুই দেশ। দু’মাসের মধ্যে দূতাবাস খুলতেও তারা রাজি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, তারা সংলাপ এবং কূটনীতিকেই সেরা পথ বলে মনে করে। সেইসাথে এই সত্যও সামনে চলে আসছে যে এই আপাত অসাধ্য কাজটি করে দেখিয়ে (নিজেদের অমিত অর্থনৈতিক এবং সামরিক বিক্রমকে সহায়তার টোপ হিসাবে ব্যবহার করে হলেও) পশ্চিম এশিয়ায় প্রভাব আপাতত বহুগুণ বাড়িয়ে ফেলল চীন।
বিষয়টি ইরানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আমেরিকার জন্য চরম অস্বস্তিকর তো বটেই। আমেরিকাকে বার্তা দেয়া বেইজিংয়ের লক্ষ্য ঠিকই, তবে এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র ভারতের অস্বস্তিও কম নয়।
ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্রের মতে, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে গত তিন বছর তেহরানের সাথে জ্বালানি-সম্পর্ক ঘুচিয়েছে মোদি সরকার। পশ্চিম এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সাথে (সৌদি-সহ) সম্পর্ক আগের তুলনায় অনেকটাই ঘনিষ্ঠ হলেও দিল্লি হারিয়েছে ইরানের বন্ধুত্ব।
ফলে চীন এই তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রটির অভিভাবক হয়ে দাঁড়াক, তা আদৌ কাম্য নয় নয়াদিল্লির কাছে। পাশাপাশি সৌদির কাছেও পৌঁছে গিয়েছে চীন।
ভারতীয় কূটনৈতিক শিবির বলছে, বহু বছর ধরেই চীন অন্য দু’টি দেশের সংঘাতে নাক না গলানোর কথা মুখে বলে। কিন্তু সম্প্রতি চীনের নীতিতে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টাই বেশি দেখা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংঘাতে সক্রিয় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালন করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। এক কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞের কথায়, চীন পশ্চিম এশিয়াকে এই বার্তা দিতে চাইছে যে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বদলি নীতি দিতে পারবে।
তাদের বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিক, একনায়কতন্ত্রের যে অভিযোগ পশ্চিম থেকে ওঠে, তারও মোকাবিলা করতে এই ‘শান্তির পৌরোহিত্য’ কাজে আসবে বেইজিংয়ের।
এসডব্লিউএসএস/১২১০
আপনার মতামত জানানঃ