গোপালস্বামী ছিলেন এক জন ভারতীয় উদ্ভাবক এবং ইঞ্জিনিয়ার। ভারতে প্রথম বৈদ্যুতিক মোটর তৈরি–সহ বেশ কয়েকটি আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত গোপালস্বামীর নাম। শিল্পক্ষেত্র ছাড়া কৃষি (হাইব্রিড চাষ) এবং অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রেও তার অবদান অনস্বীকার্য।
ভারতের প্রথম বৈদ্যুতিক মোটর তৈরি ছাড়াও গোপালস্বামী কেরোসিন চালিত পাখা, প্রজেকশন টিভি, যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর, বৈদ্যুতিক রেজার এবং টিকিট কাটার মেশিন আবিষ্কার করে তাক লাগিয়েছিলেন।
১৮৯৩ সালের ২৩ মার্চ তামিলনাড়ুর কোয়ম্বত্তূরের কলঙ্গায় এক তেলুগু কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন গোপালস্বামী। জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি মাকে হারান।
স্কুলে যাওয়া একেবারেই নাপসন্দ ছিল গোপালস্বামীর। ক্লাস চলাকালীন শিক্ষকদের উত্যক্ত করার জন্য তাকে বহু বার শাস্তি পেতে হয়। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই তিনি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেন।
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে গোপালস্বামী তার বাবাকে কৃষিকাজে সাহায্য করতে শুরু করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে এক ব্রিটিশ আধিকারিকের কাছে রুজ মোটরবাইক দেখে তিনি আকৃষ্ট হন। কিন্তু সেই সময় মোটরবাইক কেনার সামর্থ তার ছিল না।
মোটরবাইকের নেশায় গ্রাম ছেড়ে কোয়ম্বত্তূরে চলে আসেন গোপালস্বামী। উদ্দেশ্য প্রচুর টাকা রোজগার করে মনের মতো বাইক কেনা। সেখানে প্রায় তিন বছর ধরে এক জন হোটেলে কর্মী হিসাবে তিনি কাজ করেন। তিন বছরের কঠোর পরিশ্রমে একটি মোটরবাইক কেনার মতো অর্থ সঞ্চয় করে আবার বাড়ি ফিরে যান।
টাকা সঞ্চয় করার পর গোপালস্বামী ওই ব্রিটিশ আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ৩০০ টাকার বিনিময়ে তার কাছ থেকে ঐ রুজ মোটরবাইক কিনে নেন। তবে মোটরবাইক চেপে ঘোরার বদলে ইঞ্জিনের নকশা এবং গঠন খতিয়ে দেখার জন্য তিনি সেটিকে খুলে ফেলেন। এটিই ছিল গোপালস্বামীর মোটর ইঞ্জিন বোঝার প্রথম প্রচেষ্টা।
মোটরবাইকের গঠন এবং সজ্জা ভালোভাবে বুঝে নেয়ার পর গোপালস্বামী একজন মেকানিক হিসাবে কাজ করা শুরু করেন। কোয়ম্বত্তূরের বুকে একটি ছোট গ্যারেজও চালু করেন। ১৯২০ সালে আরও এক ধাপ এগিয়ে ‘ইউনিভার্সাল মোটর সার্ভিসেস’ নামে একটি পরিবহণ সংস্থা শুরু করেছিলেন গোপালস্বামী। এর মধ্যেই একটি চারচাকা গাড়িও কিনে ফেলেন তিনি। সেই গাড়ির সাহায্যে পোলাচি থেকে পালানি পর্যন্ত যাত্রী পরিবহণ শুরু করে তার সংস্থা।
কয়েক বছরের ব্যবধানে গোপালস্বামী এতটাই সফল হয়ে ওঠেন যে তার মালিকানাধীন সংস্থা দেশের সব চেয়ে বড় যাত্রী পরিবহণ সংস্থায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে তিনি কোয়ম্বত্তূরের পিলামেদুতে ‘ন্যাশনাল ইলেকট্রিক ওয়ার্কস’ নামে আরো একটি নতুন সংস্থা শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে ডি বালাসুন্দরম নাইডুর সহযোগিতায় ভারতে প্রথম বৈদ্যুতিক মোটর তৈরি করে ফেলেন।
এরপর একের পর এক আরও অনেকগুলো সংস্থা চালু করেছিলেন গোপালস্বামী। যার মধ্যে ইউনিভার্সাল রেডিয়েটরস ফ্যাক্টরি, গোপাল ক্লক ইন্ডাস্ট্রি, কোয়ম্বত্তূর ডিজেল প্রোডাক্টস, কোয়ম্বত্তূর ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড, কোয়ম্বত্তূর আর্মেচার উইন্ডিং ওয়ার্কস, ইউএমএস রেডিয়ো ইন্ডাস্ট্রি অন্যতম। বৈদ্যুতিক মোটরের সাফল্যের বালাসুন্দরামের সঙ্গে ‘টেক্সটুল’ এবং ‘লক্ষ্মী মেশিন ওয়ার্কস’ও তৈরি করেন।
ভারতে দাড়ি কাটার প্রথম আধুনিক বৈদ্যুতিন যন্ত্র গোপালস্বামীই আবিষ্কার করেন। নাম দেন ‘হেইলব্রন’। এ ছাড়াও দাড়ি কাটার জন্য অতি পাতলা ব্লেড, ক্যামেরার বেশ কয়েকটি যন্ত্র, ফলের রস বার করার মেশিন, ভোটিং মেশিন এবং কেরোসিন চালিত পাখা আবিষ্কার করেন তিনি।
১৯৪১ সালে একটি আধুনিক রোডিয়ো আবিষ্কার করেছিলেন গোপালস্বামী। যাতে সাধারণ মানুষ কিনতে পারেন, তাই খুব কম দামে সেই রেডিয়ো বাজারে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। গোপালস্বামীর ছোটবেলা দারিদ্রে কেটেছিল। আর সেই কারণেই তার তৈরি সকল পণ্য বাজারে কম দামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে একটি দুই আসনযুক্ত পেট্রল চালিত গাড়ি তৈরি করে গোপালস্বামী দেশবাসীকে তাক লাগিয়ে দেন। যাতে সেই গাড়ি সাধারণের নাগালে আসতে পারে, তাই মাত্র মাত্র ২০০০ টাকার বিনিময়ে সেই গাড়ি বাজারজাত করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সরকার তাকে প্রয়োজনীয় অনুমোদনপত্র (লাইসেন্স) দিতে অস্বীকার করে। পরবর্তীতে এই গাড়ি তৈরি বন্ধও করে দেওয়া হয়।
একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং ব্যবসায়ী ছাড়া, চিত্রগ্রাহক হিসাবেও গোপালস্বামীর খ্যাতি ছিল। দেশে বিদেশে ভ্রমণের শখ ছিল তার। আর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে বহু বিশিষ্ট মানুষকে তিনি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন।
গোপালস্বামী যে খ্যাতনামীদের ছবি তুলেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু। জার্মানিতে গিয়ে অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে দেখা করে তার ছবিও তুলেছিলেন গোপালস্বামী। ১৯৩৫ সালে লন্ডনে গিয়ে রাজা পঞ্চম জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ছবিও তিনি তুলে এনেছিলেন।
১৯৪৪ সালের শেষের দিকে গোপালস্বামী সমস্ত ব্যবসা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। সংস্থাগুলোর দায়িত্ব পুত্র-কন্যাদের হাতে তুলে দিয়ে তিনি শিক্ষামূলক কাজে নিজের বাকি জীবন অতিবাহিত করার সিদ্ধান্ত নেন।
দেশের প্রথম পলিটেকনিক কলেজ তৈরির কৃতিত্বও গোপালস্বামীর। জওহরলাল নেহরুর প্রচেষ্টায় ১৯৪৫ সালে ভারতের প্রথম পলিটেকনিক কলেজ, আর্থার হোপ পলিটেকনিক এবং আর্থার হোপ কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং তৈরি করিয়েছিলেন তিনি। কলেজটির নামকরণ করা হয় তৎকালীন মাদ্রাজের গভর্নর আর্থার হোপের নামে।
পরে কলেজটির নাম দেওয়া হয় গভর্নমেন্ট কলেজ অফ টেকনোলজি (জিসিটি)। গোপালস্বামী নিজে ঐ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তবে অধ্যক্ষ পদে বসে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কলেজ পরিচালনা নিয়ে তার মতবিরোধ বাধে। গোপালস্বামীর যুক্তি ছিল চার বছর ধরে পলিটেকনিক পড়িয়ে ছাত্রদের সময় নষ্ট করা হচ্ছে।
এর বদলে যদি ডিগ্রি অর্জনের সময় কমানো যায়, তা হলে পড়ুয়ারা বাইরে কাজ করে বেশি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে। তবে ব্রিটিশ সরকার তার সঙ্গে মতপোষণ না করায় গোপালস্বামী নিজের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
গোপালস্বামী ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেবার ওয়েলফেয়ার কমিটি’(বর্তমানে জিডি নাইডু চ্যারিটিস নামে পরিচিত) তৈরি করেন। এই প্রতিষ্ঠান তৈরির লক্ষ্য ছিল উচ্চশিক্ষায় ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করে পড়ুয়াদের আরো দক্ষ করে তোলা। গবেষণার জন্যও বেশ কয়েকটি বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিল গোপালস্বামীর ট্রাস্ট।
ভারতীয় বি়জ্ঞানী সি ভি রমন তার সম্পর্কে এক বার বলেছিলেন, ‘গোপালস্বামী এক জন মহান শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী এবং উদ্যোক্তা। তার হৃদয় ছিল উষ্ণ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। সহকর্মীদের প্রতি তিনি সহমর্মী ছিলেন। তাদের কেউ সমস্যায় পড়লেই তিনি ছুটে যেতেন।’
সূত্র: আনন্দবাজার
এসডব্লিউএসএস/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ