বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কি রাজনীতি করতে পারবেন? বিষয়টি নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই, তবে নির্বাচন করতে পারবেন না বলে গত রোববার আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্যে নতুন করে সামনে এসেছে এ প্রশ্ন।
রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের কেউ বলছেন, তিনি রাজনীতি করতে পারলে এত দিন কেন তারা বলেননি? এখন যদি তিনি রাজনীতি করেন, তাহলে তার সাজা স্থগিতের আদেশ বহাল থাকবে কি? আবার কেউ বলছেন, এসব রাজনৈতিক বক্তব্য। অসুস্থতাজনিত কারণে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার অলিখিত শর্তেই তিনি সাময়িক মুক্তি পেয়েছেন। তাই শর্ত মেনেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন না। অবশ্য আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম।
দলটির নেতারা বলছেন, এ ধরনের বক্তব্য নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ। এ বক্তব্যের বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে প্রয়োজনে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেবেন বলে জানিয়েছেন তারা। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে ফিরে আসা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই যাচ্ছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া জেলে যান ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। এই মামলায় তার পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয়। একই বছর ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় তার সাত বছর জেল হয়।
সেই হিসেবে খালেদা জিয়ার কারাবাসের মেয়াদ পাঁচ বছর হলো ৮ ফেব্রুয়ারি। একটি মামলায় উচ্চ আদালত তার শান্তির মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিএনপির দাবি, দুটো মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। খালেদা জিয়া কোনো দুর্নীতি করেননি।
দুটো মামলায় হাইকোর্ট রায়ের পর লিভ টু আপিল দায়ের করলেও তিন বছর ধরে তা ঝুলে আছে। বিএনপি একটিরও নিষ্পত্তির জন্য চেষ্টা করছে না। তাদের ভয়, আপিল বিভাগে নাকচ হলে আইনি লড়াইয়ের শেষ সুযোগটিও থাকবে না। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বিএনপিই খালেদা জিয়ার মুক্তি চায় না বলে লিভ টু আপিলের নিষ্পত্তি করছে না।
এই প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না করার বিতর্ক সামনে আসে। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনি এখনো দলের চেয়ারপারসন এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছেন, তা-ও তার সিদ্ধান্তে।
বিএনপি নেতারা প্রথমে আওয়াজ তুলেছিলেন, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন। কিন্তু সেই কাজটি তারা করতে পারেননি। এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষিতেও বিষয়টি সেভাবে তুলে ধরতে পারেননি।
বিএনপি নেতারা তখন বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এরপর বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়েছে। যখন দেখা গেল, বিএনপির আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন না, তখন তার পরিবার থেকে নির্বাহী আদেশে শাস্তি স্থগিত করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়।
সরকার সেই আবেদন গ্রহণ করে এবং ছয় মাস পরপর তার শাস্তি স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একাধিকবার দেখাও করেন।
প্রশ্ন উঠেছে, একজন শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেন কি না। এর উদাহরণ বাংলাদেশেই আছে। জিয়াউর রহমানের আমলে জাসদের সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবের শাস্তিও নির্বাহী আদেশে স্থগিত করা হয়েছিল।
তিনি শাস্তির স্থগিতাদেশ নিয়েই বিদেশে চিকিৎসার জন্য জার্মানি (তখন এটি পশ্চিম জার্মানি নামে অভিহিত ছিল) গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে এসেও রাজনীতি করেছেন।
খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে কী হবে? যে ধারায় খালেদা জিয়ার শাস্তি স্থগিত করা হয়েছে, সেই ধারা শর্তযুক্ত হতে পারে। আবার শর্তমুক্তও হতে পারে। আ স ম রবের ক্ষেত্রে শর্ত ছিল না। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সরকার দুটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে, যথাক্রমে তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা করাবেন এবং বিদেশে যেতে পারবেন না।
বিএনপির নেতারা তার শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে সরকারের কাছে বারবার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন করলেও সরকার তা গ্রাহ্য করেনি। সরকার বলেছে, দেশে থেকেই তাকে চিকিৎসা করাতে হবে।
মাসখানেক আগে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য যখন জাতীয় সংসদে বললেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না মর্মে মুচলেকা দিয়ে শাস্তি স্থগিত করিয়েছেন, তখন বিএনপির নেতারা জোরগলায় প্রতিবাদ জানালেন। আমরা ধরে নিয়েছিলাম সেই বিতর্ক সেখানেই শেষ হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো শেষ হয়েও হলো না শেষ।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আবার বিষয়টি সামনে এনেছেন। পাঠকের সুবিধার জন্য তার পুরো বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরছি।
১৯ ফেব্রুয়ারি, রোববার ঢাকায় নবনিযুক্ত সহকারী জজদের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী ‘অসুস্থতার গ্রাউন্ডে দুটি শর্তে তাকে (খালেদা জিয়া) মুক্ত করা হয়েছে। তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না বা রাজনীতি করা থেকে বন্ধ থাকতে হবে, এ রকম শর্ত সেটার (খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে করা আবেদন) মধ্যে ছিল না।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আরও বলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) একজন স্বাধীন মানুষ, তিনি কী করবেন, সেটা আমার বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু তাকে যখন (ফৌজদারি কার্যবিধি) ৪০১ ধারায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায় মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অসুস্থ বলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সেখানে লিখে রাখিনি তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না।
আইনি প্রক্রিয়ায় যদি কার্যক্রমের কথাই বলি, তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কি না, তাহলে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে যেতে হবে। ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, যদি নৈতিক স্খলনের দায়ে কেউ দুই বছর বা তার বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, তাহলে তিনি সাজা ভোগের পর পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
তাহলে কি খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন? এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির সময় যে চিঠি লেখা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, ওনার শারীরিক অবস্থা এমন, সুচিকিৎসা না হলে তার জীবন বিপন্ন হবে। আপনারাই বিচার করেন, যিনি অসুস্থ, তিনি কি রাজনীতি করতে পারেন? যদি আপনাদের (সাংবাদিকদের) বিবেচনায় মনে হয় তিনি রাজনীতি করতে পারেন, তাহলে আপনাদের বিবেচনা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তিনি অসুস্থ, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, এটাই মনে হচ্ছে বেস্ট জাজমেন্ট।’ (প্রথম আলো, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে এ নিয়ে টেলিফোনে কথা হয় মঙ্গলবার। তারাও বলছেন, বিএনপি যখন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, তখন খালেদা জিয়ার প্রশ্নটি সামনে আনার উদ্দেশ্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলা। এটা বিএনপির জন্য এক ধরনের টোপ। কেননা তার প্রতি দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রচণ্ড আবেগ আছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে। সরকারি দলের নেতারা বলবেন, সরকার তো খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা দিচ্ছে না। দ্বিতীয়ত খালেদা জিয়ার আবেগ ব্যবহার করে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আনার চেষ্টাও করবে সরকার। তৃতীয়ত খালেদা জিয়া যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন, তখন সরকার দেখাতে চাইবে যে শর্তে সাজা
স্থগিতের আবেদন করেছিলেন, সেই শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে। তিনি এখন আর অসুস্থ নন। ফলে তার শাস্তি স্থগিত রাখারও যুক্তি নেই। আর যদি বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে ছাড় দেয় বা অনড় না থাকে, তখন শর্তের বিষয়টি শিথিলও করতে পারে।
বিএনপি যে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন, সেটি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফের মন্তব্যেও টের পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, আইনমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হবে। আবার বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করেন, নিজের মতো করে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগ অনেক টোপ দেবে। এটাও একটা টোপ হতে পারে।
তাহলে কি খালেদা জিয়া আবার রাজনীতিতে আসতে পারেন- এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার এ আইনজীবী বলেন, অবশ্যই পারেন। এত দিন সরকারের পক্ষ থেকে তার রাজনীতি করার স্বাধীনতার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এখন খোলাসা করা হয়েছে। তাই খালেদা জিয়া সুস্থবোধ করলে এবং ইচ্ছা পোষণ করলে রাজনীতিতে আসতে পারেন।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার সাজা সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু এটি দুদক আইন ও উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সিদ্ধ হয়নি। উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে, দুদকের মামলায় সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই। তার মতে, সরকার করোনা পরিস্থিতি বা মানবিক দিক বিবেচনায় হয়তো খালেদা জিয়ার সাজা সাময়িক স্থগিত করেছে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, সাধারণত মুচলেকা দেওয়া হয় অপরাধমূলক বা অপরাধজনিত কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি হিসেবে। রাজনীতি নিঃসন্দেহে একটি অপরাধমূলক কার্যক্রম নয়। তাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করার জন্য খালেদা জিয়ার মুচলেকা দেওয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে না। আইনমন্ত্রী সম্ভবত এই ধারণাকে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন।
তার মতে, খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবেন কিনা, এটা সম্পূর্ণ তার সিদ্ধান্ত। তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার যে সাজা স্থগিত করা হয়েছে, সেটার সংশ্নিষ্ট কাগজপত্র এবং আইনি দিক বিশ্নেষণ করে তিনি পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।
এসডব্লিউএসএস/১৮১০
আপনার মতামত জানানঃ