প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার আলোকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা জানি, পৃথিবীতে আধুনিক মানুষের বিকাশ হয় আজ থেকে প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগে। বিজ্ঞানিরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত মানব ফসিল গবেষণা করে ও আধুনিক মানুষের DNA টেস্ট সহ অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে।
পক্ষান্তরে ইসলাম অনুসারে আদমের কাহিনী বড়োজোর আনুমানিক ৬০০০ থেকে ১০ হাজার বছর আগের। কোথায় ৩ লক্ষ বছর আর কোথায় ৬ বা ১০ হাজার বছর। এখন প্রশ্ন হল, আদমই যদি আদি মানব হয় তো এতশত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা কি মিথ্যা? প্রাপ্ত ফসিলগুলো কি মিথ্যা?
উল্লেখ্য, গবেষণাগারে দুনিয়ার জীবকুলের জেনেটিক কোড বিশ্লেষণের মাধ্যমেই দ্ব্যর্থহীন ভাবেই প্রমান করা যাচ্ছে যে- দুনিয়ার সকল জীবের উত্থান ঘটেছে কোন এক সরল এককোষী জীব থেকে। তার অর্থ বিবর্তনতত্ত্ব মোতাবেক, পৃথিবীতেই সকল জীবের উদ্ভব ঘটেছে আর যা তারা বংশগতি বিদ্যা দ্বারা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমান করে দিতে পেরেছেন। অর্থাৎ বিবর্তনতত্ত্ব আদম-হাওয়া তত্ত্বকে ভুল প্রমান করে দিয়েছে সন্দেহাতীত ভাবেই।
মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস থেকে আমরা জানি, আজ থেকে প্রায় সত্তর হাজার বছর আগেও মানুষ ছিল প্রাণিজগতের আর দশটা প্রাণীর মত সাধারণ একটি প্রাণী। তাদের বিচরণও সীমাবদ্ধ ছিল কেবল আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যেই। পরবর্তী সময়টুকুতে মানুষ হয়ে উঠেছে সমস্ত পৃথিবীর শাসক এবং তাবৎ পৃথিবীর বাস্তু সংস্থানের জন্য হুমকিস্বরূপ।
যারা বিবর্তন মানতে চান না তাদের অন্তত এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা এই তথ্য কোন বিবর্তনবাদ তত্ত্ব থেকে আসেনি, এসেছে অন্যান্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে। এখন আমার প্রশ্ন হল আদমের কাহিনী কি ৭০ হাজার বছরেরও আগের। উত্তর, মোটেও না। তাহলে এই লক্ষ লক্ষ বছর আগেই মানুষ সৃষ্টি হওয়ার ইতিহাস কী আদমের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়!
হাদিসের দাবি অনুযায়ী, আদমের উচ্চতা ৬০ হাত (৯০ ফুট) ছিল, পরে ধীরে ধীরে মানুষের উচ্চতা কমতে কমতে ৫-৬ ফুটে নেমে এসেছে। এই তথ্যটা যদি মেনে নেই, তো এটাও তো বিবর্তনবাদকেই সমর্থন করছে, নাকি? এখন প্রশ্ন হল, সত্যি যদি মানুষের উচ্চতা ৬০ হাত থেকে কমতে কমতে বর্তমানের পর্যায়ে আসে, তবে তো বিভিন্ন সময়ে ৬০ হাত, ৫০ হাত, ৪০ হাত, ৩০ হাত, ২০ হাত, ১০ হাত সহ আরও নানান উচ্চতার মানুষ পাওয়া যাবে। লক্ষ লক্ষ বছর আগের ডাইনসরের ফসিল পেয়েছে বিজ্ঞানীরা, কিন্তু বিভিন্ন উচ্চতার মানুষের ফসিল কিন্তু পায়নি।
অথচ বিবর্তন কিন্তু হয়েছে ঠিক উল্টো নিয়মে। ফসিল রেকর্ডগুলো এটাই প্রমাণ দেয় যে, মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে অনুন্নত থেকে উন্নত হয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে।
এছাড়াও বিভিন্ন সায়েন্স জার্ণাল ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইটে আপনারা বিভিন্ন সময়ে আদিম মানুষের প্রাপ্ত ফসিল সম্পর্কে সচিত্র তথ্য পাবেন।
সেখানের কোথাও মানুষের উচ্চতা ৬০ হাত থাকার দাবি করা হয়নি, বরং তাদের সবার আকৃতিই কম বেশী আধুনিক মানুষের কাছাকাছিই ছিল, তবে বুদ্ধিতে তারা ছিল আমাদের চেয়ে হাজার গুণ পিছিয়ে।
Homo Habilis এর তথ্য দেখুন। মানুষের এই প্রজাতিটি প্রায় ২.৩ থেকে ১.৫ মিলিয়ন বছর আগে বাস করতো। মানুষের পূর্ববর্তী প্রজাতিদের চেয়ে এদের মস্তিষ্ক বড় ছিল। তবে এদের দৈহিক আকার আকৃতি সহ আরও অনেক বৈশিষ্ট্য অন্যান্য অস্ট্রালোপিথেসিয়ান প্রজাতিদের মতই ছিলো। এদের দৈহিক উচ্চতা ছিল পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৩০ সে.মি (৪.২৬৫ ফুট) এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১১০ সে.মি (৩.৬ ফুট)।
এদের মস্তিষ্কের গড় আকার ছিল ৬১০ ঘন সেন্টিমিটার, যা তাদের দেহের ওজনের ১.৭% কে উপস্থাপন করে। অন্যান্য অস্ট্রোলোপিথেসিন মস্তিষ্কের তুলনায় এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
Homo Neanderthalensis বর্বর গুহামানব হিসেবে পরিচিত। মানুষের এই প্রজাতিটি ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ২ লক্ষ বছর যাবৎ রাজত্ব করেছে। প্রায় ২৮ হাজার বছর পূর্বে দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হওয়ার আগেও দীর্ঘ সময়ের জন্য আধুনিক মানুষের সাথে সহাবস্থান করেছিল তারা। এরা সাধারণত খাটো ছিল এবং এদের আধুনিক মানুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী কঙ্কাল এবং পেশীবহুল দেহ ছিল। এদের পুরুষদের গড় উচ্চতা ছিল প্রায় 168 সেন্টিমিটার (৫.৫১ ফুট) এবং মহিলারা 156 সেন্টিমিটার (৫.১ ফুট) যা মোটামুটি আধুনিক মানুষদের মতই। [5]
অথচ হাদিসে বলা হচ্ছে মাত্র ৬ বা ১০ হাজার বছর আগের আদমের উচ্চতা নাকি ৬০ হাত ছিল। আর ৩ লক্ষ বছর আগের মানুষের পূর্বপুরুষের প্রাপ্ত ফসিল তো বলে যে তাদের সাইজ কম বেশী আমাদের মতই ছিল, আর যাই হোক অন্তত ৬০ হাত বা এমন কি ১০ হাতও ছিল না, বরং আমাদের মতই ছিল। তাহলে কি আদমের কাহিনী আরও আগের, মানে ৩ লক্ষ বছরেরও আগের? ইসলামের ইতিহাস কিন্তু বলে খুব জোর ১০ হাজার বছর আগের হতে পারে।
পাশাপাশি স্কেল ল’ কিন্তু বলছে পৃথিবীতে ৯০ ফুট বা ৬০ হাত লম্বা কোন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা কখনোই সম্ভব না। স্কেল ল’ অনুযায়ী কোন প্রাণী বা বস্তুর দেহের ওজন বাড়ে তার দেহের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির হারের ঘনফল হিসাবে। সাধারণত একজন সুস্হ সবল সুঠাম দেহের ৫ ফুট উচ্চতার পুরুষের ওজন মোটামুটি ভাবে ১১৫ পাউন্ডের মত হয়। এখন কোন মানুষের উচ্চতা যদি ১৫ ফুট হয় তবে আমরা জানি স্কেল ল’ অনুযায়ী তার দেহের ওজন বেড়ে যাবে দেহের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির হারের ঘনফল হিসাবে।
মানে মাত্র তিন গুন বেশী লম্বা হওয়ার কারণে ঐ মানুষটির ওজন হবে 3^3 = 27 গুন বেশি। অর্থাৎ ১৫ ফুট মানুষটির ওজন হবে (১১৫ >< ২৭) = ৩১০৫ পাউন্ড। যা কিনা ক্যালেন্ডারে দেখা স্বাস্হ্যবান দুই কিংবা তিনটা অস্ট্রেলিয়ান গরুর ওজনের সমান। তাও আবার তাদের দেহের ওয়েট সাপোর্টের জন্য চারটা করে পা আছে এবং সোজা হয়ে দাড়াতে হয় না। [৬০ ফুট কোন প্রাণীর ওজন হবে ১২×১২×১২= ১৭২৮ গুন বা ১,৯৮,৭২০ পাঊন্ড বা ১০০ টন আর ৯০ ফুট আদমের হবে ১৮×১৮×১৮×১১৫= ৬৭ হাজার ৬৮০ পাঊন্ড]
আবার ১৫ কিংবা ৬০ কিংবা ৯০ ফুট লম্বা মানুষটির দেহের পেশী কিংবা হাড় যে পরিমাণ ভার বহন বা শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে তা বৃদ্ধি পাবে হাড় এবং পেশীর পুরুত্বের আনুপাতিক হারে। ১৫ ফুট মানুষটির দেহের ভার বহন কিংবা শক্তি প্রয়োগ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে তার হাড় এবং পেশীর ক্রস সেকশনাল এরিয়া’র (cross sectional area) বর্গ হিসাবে। অর্থাৎ তার শক্তি হবে ৫ ফুট মানুষটির তুলনায় মাত্র
৩×৩ = ৯ গুন বেশি। মানে হল তিন গুন লম্বা হওয়ার কারণে তার ওজন বৃদ্ধি পাবে ২৭ গুন আর দেহের শক্তি বৃদ্ধি পাবে মাত্র ৯ গুন। অর্থাৎ তুলনামূলক বিচারে (দেহ এবং শক্তির) ৫ ফুট মানুষটির তুলানায় ১৫ ফুট মানুষটি হবে অনেক অনেক বেশী দুর্বল (এক তৃতীয়াংশ) এবং তার বডি স্ট্রাকচার তাকে খুব একটা সাপোর্ট দিতে পারবে না। ফলে হাটাহাটি কিংবা দৌড়াদৌড়ি করতে গেলেই তার হাঁড়গোড় ভেঙ্গে পরে থাকবার ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত থাকা যেতে পারে। শিশু থেকে পূর্ন বয়স্ক জীবনে পৌছানো তো অনেক পরের কথা।
এ কারনেই লম্বা খেলোয়ারদের মাঝে আঘাতের হার অনেক বেশী থাকে। ৬০ ফুট কারও ক্ষেত্রে অনুপাতটা হবে ১৭২৮ বনাম ১৪৪ গুণ আর ৯০ ফুট আদমের ক্ষেত্রে সেটা হবে ২৭০০০ গুণ বনাম ৯০০। কিংকং কিংবা আদম এক পা হাটার আগেই হাড়গোর ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে থাকবে।
উদাহরণ হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড বুকে নাম লেখানো পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বাটে মানুষগুলোর দিকে তাকালেই সেটা বুঝা যায়। যেমন, পৃথিবীর জানা ইতিহাসের সবচাইতে লম্বা পুরুষ মানুষ ৮ ফুট ১১ ইঞ্চির আমেরিকান রবার্ট ওয়াল্ডো বেঁচে ছিলেন মাত্র ২২ বছর আর তাকে বিশেষ ধরণের লেগ ব্রেস ব্যবহার করে হাটতে হত। আর সবচাইতে লম্বা মহিলা চীনের জেং জিনলিয়ান বেঁচে ছিলেন মাত্র ১৭ বছর। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা জীবিত মানুষ তুরস্কের ৮ ফুট ৩ ইঞ্চির সুলতান কোসেনও স্বাভাবিক নন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে লম্বা (৮ ফুট ৬ ইঞ্চি) মানুষ জিনাত আলিও মারা গেছেন মাত্র ২৫ বছর বয়সে।
এসডব্লিউএসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ