২২শে অক্টোবর ১৯৪৩ সাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হওয়ার প্রায় দু’বছর পূর্ণ হতে চলছে। ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রান্ত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চুপ করে বসে থাকেনি। তারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
এই আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে মার্কিনিরা। একের পর এক অবিশ্বাস্য সব পরীক্ষণ চালায় মানব জাতির উপর। যার মধ্যে ছিলো ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট ও ৯ই আগস্ট জাপানীদের উপর প্রথম নিউক্লিয়ার বোমা লিটলবয় ও ফ্যাটম্যান ব্যবহার। এরূপ আরেকটি পরীক্ষণ ছিলো ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট।
ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট বা ফিলাডেলফিয়া গবেষণা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়া এলাকায় ইউএস নেভির ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস এল্ড্রিজ (USS Eldridge DE-173) -এ করা একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ। এটি প্রজেক্ট রেইনবো নামেও পরিচিত। এই পরীক্ষণটির মূল উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর চোখে জাহাজকে কীভাবে অদৃশ্য করা যায়। একটি জাহাজকে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে শত্রু চোখে অদৃশ্য রেখে একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তর করার একটি প্রক্রিয়া। যেটি গড়ে উঠেছে আইনস্টাইনের ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি এর উপর ভিত্তি করে।
ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি এমন একটি তত্ত্ব যাতে বলা হয়েছে− যদি কোনস্থানে কোনভাবে আলোকে এমন অবস্থায় বেধে রাখা যায় যে, সেখান থেকে আলো কোনভাবে বের হতে পারবে না আবার সে স্থানে আলো ঢুকতেও পারবে না তাহলে পৃথিবীর সময়কে বেধে ফেলা সম্ভব। এমনটি ওই স্থানে মহাকর্ষ বলও কাজ করবে না।
আইনস্টাইন নিজে এই তত্ত্বের প্রবক্তা হলেও তিনি এর সফল ব্যবহারিক কোন প্রমাণ দেখাতে পারেন নি। কিছু গবেষকদের ধারণা এই যে, বড় ইলেকট্রিক্যাল জেনারেটর ব্যবহার করে নির্দিষ্ট বস্তুর চারপাশের আলোকে বেধে ফেলা সম্ভব। আর এতে করেই সাধারণের কাছে অদৃশ্য হয়ে যাবে বস্তুটি। এক্ষেত্রে উঠে আসে বিখ্যাত নিকোলা টেসলা’র নাম।
ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণ আদৌ হয়েছিলো কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এই পরীক্ষাটি আমেরিকা সরকার প্রকাশ করেনি কারণ এতে অনেক ক্রুদের প্রাণহানী হয়েছিলো। এতে সামরিক বাহিনীর মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে তাই পরীক্ষণটির ব্যপারে মার্কিন সরকার কোন মন্তব্য করেন নি।
আবার কেউ কেউ মনে করেন- প্রকৃতার্থে ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণটি করাই হয়নি বা হলেও তাতে মার্কিনিরা সফল হতে পারে নি। যাই হোক, বিভিন্নভাবে পরীক্ষণটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে টেনে আনা হয়েছে বিখ্যাত সার্ব-আমেরিকান ইনভেন্টর নিকোলা তেসলাকে। তিনি এই কাজটি করার জন্য উচ্চমানের একটি জেনারেটরের সাহায্য নেন। এবং কয়েল দিয়ে জাহাজটিকে জড়িয়ে নেন।
১৯৪৩ সালের ২২শে অক্টোবর। এবার বিজ্ঞানীরা জাহাজে ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। একটি বড় বৈদ্যুতিক জেনারেটর থেকে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ডেস্ট্রয়ার এল্ড্রিজকে কয়েল দিয়ে জড়িয়ে প্রচুর উচ্চ বিভবের বিদ্যুৎ পরিবাহিত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল জাহাজের চারপাশে প্রচুর শক্তিসম্পন্ন একটি চুম্বকক্ষেত্র তৈরী করা। তবে ফলাফল যেন বাস্তবতাকেও হার মানিয়ে দিচ্ছিল। উচ্চমাত্রার বিভবের ফলে জাহাজের চারপাশে সবুজাভ ধোঁয়া দেখা যায় এবং জাহাজটি প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু এই পর্যায়ে তারা ব্যর্থ হয়। এল্ড্রিজ যখন পুনরায় দৃশ্যমান হয় তখন জাহাজে থাকা ক্রুদের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়, তারা বমিভাব অনুভব করে। কিছু ক্রু মারা যায় বলেও বলা হয়। তখন তেসলা জানায় কিছু ত্রুটি হয়েছিলো তাই এরূপ হয়েছে। এবং নৌবাহিনীর অনুরোধে সরকার পরবর্তী পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করে ১৯৪৩ সালের ২৮ অক্টোবর।
প্রথমবার যন্ত্র সাজানোতে ভুল ছিল বলে জাহাজটি শুধুমাত্র কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়েছিলো। এবার নতুন করে সকল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম সাজানো হলো। নিকোলা জেনেরেটর স্টার্ট করে বিভবের মাত্রা বাড়াতে থাকলেন। একপর্যায়ে উচ্চমাত্রার বিভব তৈরী হলে জাহাজের চারিপাশে নীল আলোর মত কিছু একটা দেখা যায়। এবং জাহাজটি অদৃশ্য হয়ে যায়।
এবার শুধুমাত্র অদৃশ্যই হয়ে যায়নি। টেলিপোর্টের মাধ্যমে ফিলাডেলফিয়া থেকে ২০০ মাইল দূরে ভার্জিনিয়ার নরফোক শিপইয়ার্ডে চলে যায়। এবং পুনরায় ফিলাডেলফিয়াতে ফিরে আসে। জানা যায যে, নরফোকে এসএস আন্ড্রু ফুরুসেইথ নামক জাহাজের সামনে ইউএসএস এলড্রিজ কিছু সময় সম্পূর্ণ দৃশ্যমান ছিল। নরফোকে এলড্রিজকে দেখা যায় মাত্র ১০ সেকেন্ডের জন্য। এরপর এটি পুনরায় যে স্থান থেকে অদৃশ্য হয়েছিল ঠিক সেই স্থানেই ফিরে আসে।
ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল ছিলো খুবই ভয়ানক। পরীক্ষণটির পর জাহাজে থাকা অনেক ক্রু মৃত্যুবরণ করে। অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বেশ কিছু ক্রু চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। যাদেরকে আর কখনোই পাওয়া যায় নি। আর কিছু ক্রু অদৃশ্য সব ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়। যেমন, যেকোন বস্তু ভেদ করে চলাফেরার ক্ষমতা লাভ করে। এবং এটিও জানা যায় যে কিছু ক্রু যারা বেঁচে ফিরে এসেছিলেন তাদের ব্রেনওয়াশ করা হয়। ফলে পরীক্ষণ সম্পর্কে তারা কিছুই মনে করতে পারে নি।
ফিলাডেলফিয়া পরীক্ষণটি মার্কিন সরকার কর্তৃক কখনোই স্বীকার করা হয় নি। সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে একে সম্পূর্ণ ফাপরবাজি এবং অতিপ্রাকৃত একটি ঘটনা বলে মনে করা হয়। অনেকে আবার মনে করেব, কিছু একটা ঘটেছিল সেদিন ফিলাডেলফিয়াতে। কিন্তু বিজ্ঞান বলে, এ ধরনের পরীক্ষণ এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এমনকি এক্সপেরিমেন্টটিতে আইনস্টানের সম্পৃক্ততারও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তাহলে কি পরীক্ষণটি আসলেই গুজব? নাকি এড়িয়ে চলা হচ্ছে মানব সভ্যতার অন্যতম এক নব আবিষ্কারকে!
এসডব্লিউএসএস/২২২৫
আপনার মতামত জানানঃ